মন্দ-সময়: বন্দরের গৌরব মেলার সুযোগ ছিল গেঁওখালির। নিজস্ব চিত্র
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি বাংলায় প্রথম বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন চালু করেছিল হাতিয়াড়া থেকে। ১৮৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। হুগলি নদীর তীরে সেই হাতিয়াড়া গ্রামই আজকের হাওড়া স্টেশন। ইংরেজ বণিকদের ব্যবসার রমরমা বাড়তে থাকায় এবং বাংলা থেকে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে রেল পরিবহণ ব্যবসা লাভজনক হল। লন্ডনের ১৩২ নম্বর ওল্ড ব্রড স্ট্রিটের গ্রেসাম হাউসে জন্ম নিল আর এক কোম্পানি। ১৮৭৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নথিভুক্ত হল বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানি (বিএনআর)। প্রথম চেয়ারম্যান ও এমডি ছিলেন স্যর টি আর ওয়াইনি। নাগপুর-ছত্তীসগঢ় রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ন্যারো গেজ লাইনকে ব্রড গেজ লাইনে পরিণত করল বিএনআর। তা শেষ হয় ১৮৮৮ সালে। এর পর নাগপুর থেকে আসানসোল পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ সম্পূর্ণ হলে ১৮৯১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম মালবাহী রেল চলেছিল বলে আর পি সাক্সেনার ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হিস্ট্রি’ থেকে জানা যায়। তার পর খড়্গপুর হয়ে হাওড়া-মুম্বই লাইন পাতার কাজ শুরু হল।
খড়্গপুরের দমদমায় খড়্গপুর জংশন উদ্বোধন হল ১৮৯৯ সালের ১ জানুয়ারি। ডিভিশন অফিস হল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দা কর্মসূত্রে এলেন। তৈরি হল ‘মিনি ভারত’। হাতিয়াড়া থেকে কাজ শুরু করল ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। নাগপুরের দিক থেকে কাজ শুরু করল বিএনআর। বিংশ শতকের গোড়ায় এই লাইনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। তখনই পরিকল্পনা হয় পাঁশকুড়া-গেঁওখালি এবং দিঘা-বেলদা রেল লাইনের। তখন সাহেবেরা কাঁথি থেকে জুনপুট, খেজুরি আর দিঘা যেতেন বেলদা থেকেই। বোধহয় সেই জন্যই বেলদা স্টেশনের নাম ছিল কন্টাই রোড স্টেশন।
হুগলি, রূপনারায়ণ আর হলদি নদীর সংযোগস্থল গেঁওখালি। বিংশ শতকের গোড়ায় কলকাতার এক কয়লা কোম্পানি মহিষাদলের কাছে গেঁওখালিতে বন্দর নির্মাণের জন্য বিএনআর-এর কাছে প্রস্তাব দেয়। তারা রানিগঞ্জ, ঝরিয়া থেকে রেলে কয়লা এনে কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাঠাত। কয়লা গেঁওখালি হয়ে পাঠালে পরিবহণ খরচ অনেক কমে যাবে। তাই কোম্পানি পাঁশকুড়া থেকে গেঁওখালি পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর জন্য আবেদন করে। রেলও ব্যবসা করতে এসেছে। প্রকল্পটি লাভজনক দেখে বিএনআর কোম্পানির পরিকল্পনাটি ব্রিটিশ সরকারের পোর্ট কমিশনারের কাছে সমীক্ষার জন্য পাঠায়। কমিশনার শর্ত দিলেন, রেললাইন করা যেতে পারে। তবে প্রস্তাবিত নতুন গেঁওখালি বন্দরের যাবতীয় দায়িত্ব ও অধিকার পোর্ট কমিশনারের হাতে থাকবে। কয়লা কোম্পানি শর্তে রাজি না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা আর রূপায়িত হয়নি। শেষ পর্যন্ত পাঁশকুড়া-দুর্গাচক লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১৯৬৮ সালে।
১৯০৬ সালে হাওড়া স্টেশন টার্মিনাল পুনর্গঠিত হলে সেটাই হল ভারতের বৃহত্তম টার্মিনাল। তখন মাত্র ৬টি প্ল্যাটফর্ম ছিল। ১৯০৮ সালে ৭ লক্ষ টাকা ব্যয় করে কলকাতার গার্ডেনরিচে গড়ে উঠল বিএনআর ভবন। কলকাতা-চেন্নাই রেললাইন পাতার সময়ে বিএনআর কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কন্টাই রোড স্টেশন থেকে কাঁথি পর্যন্ত রেলপথ চালু করবে। ১৯১০ সালে কোম্পানি জরিপের কাজ শুরু করে। তার পর প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনাটি সাময়িক স্থগিত হয়ে যায়। আবার বছর দশেক পরে নতুন করে সমীক্ষা শুরু হয়। ১৯২২-২৩ সালে আবার বিএনআর জরিপের কাজ শুরু করে। তখনই দাবি ওঠে কাঁথি নয়, দিঘা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত করতে হবে। সেই সময় ইংরেজ সাহেবরা পুরীর পরিবর্তে খেজুরি ও দিঘাতে তাঁদের স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলেন। রেললাইন দিঘা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে সর্বসাধারণের উপকার হবে বলে ১৯২৩ সালে ২০ নভেম্বর কাঁথির সাপ্তাহিক ‘নীহার’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল হয়। সেই সময় দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। ১৯২০ সালে ইউনিয়ন বোর্ড বর্জন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে কাঁথি। ১৯২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলার স্বায়ত্বশাসন বিভাগ ৫০২৫ নম্বর মেমোতে মেদিনীপুর জেলার ২২৭ ইউনিয়ন বোর্ডের মধ্যে ২২৬টি বাতিল করে। ১৯২২ সালে ১ মার্চ পাঁশকুড়ার গোপালনগর ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ শাসকরা কোম্পানিকে এই পরিকল্পনা রূপায়ণ করার অনুমতি দেয়নি বলে পুরাতত্ত্ব গবেষক তারাপদ সাঁতরা লিখেছেন।
নাগপুর থেকে রেলের লাইন যখন বাংলা সীমানায় প্রবেশ করছে, তখন হাওড়া-মেদিনীপুর রেল লাইনের পরিকল্পনা হয়। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞপ্তি জারি হল। জমি অধিগ্রহণের নোটিস পাঠাল বিএনআর। চাষি, রায়ত বা জমিদারদের কোনও আপত্তি থাকলে কালেক্টরের কাছে আসতে বলা হল। কিন্তু ইংরেজ সাহেবদের বিরুদ্ধে বলার সাহস সকলের ছিল না। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল বিঘে প্রতি মাত্র পৌনে ছ’টাকা। খড়গপুরের কৌশল্যা গ্রামের লোককবি লক্ষণচন্দ্র নাটুয়া রেললাইন নিয়ে তাঁর গানে লিখেছেন, ‘লক্ষণচন্দ্র ভনে, স্টেশন আদি যথা/পঁয়ত্রিশ শত বিঘা মালিক ছিলেন পিতা/বিএনআর গ্রহীতা, পিতা হয়ে দাতা/ বিশ হাজার টাকায় দিলেন বিক্রি করে’।
১৯০০ সাল। হাজার হাজার শ্রমিক ঝুড়ি কোদাল বেলচা নিয়ে নেমে গেল কাজে। মাটি পড়তে শুরু করল পশ্চিম থেকে পূর্বে। তৈরি হল রেলের রাস্তা। যাঁরা জমি দেননি তাঁদের জমির উপরও পড়ল মাটি। যাঁরা কালেক্টরের কাছে আপত্তি করতে গেলেন তাঁরা গলা ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলেন। রেললাইন পাতা শেষ হল। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও জমিদারদের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন স্থানে স্টেশন তৈরি করা হল। দোতলা, তিনতলা বাড়ি হল। রাতে বাতি জ্বলল। গোকুলপুরে জলের কূপ থেকে খড়গপুর শহরে জল সরবরাহ শুরু হল। কোলাঘাটে রূপনারায়ণ নদের উপর সেতু উদ্বোধন হল ১৯০০ সালের ১৯ এপ্রিল। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হল ১৯০০ সালের জুনে। বাঁশি বাজিয়ে ছুটল রেলগাড়ি। মেদিনীপুর থেকে হাওড়া। দূরদূরান্ত থেকে ‘অপু-দুর্গা’দের ভিড় জমল স্টেশনে স্টেশনে। তখন তো প্ল্যাটফর্ম টিকিট ছিল না। তাই রেল ঠিক করল, খুব কাছ থেকে রেলগাড়ি দেখতে চাইলে দু’পয়সা জমা দিতে হবে। রেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখলে এক আনা দিতে হবে। কেউ যদি রেলে ওঠতে চান, তাহলে তাঁকে নগদ দু’আনা জমা দিয়ে উঠতে হবে। রেলের টিকিট-মাস্টার মাথায় পাগড়ি বেঁধে বাসের কন্ডাক্টরের মতো রেলগাড়িতেই বসতেন। এভাবেই ১৯০৭ সালে হাওড়া থেকে নাগপুর পর্যন্ত বিএনআর রেল গাড়ি চালাতে শুরু করল।
তখন হাওড়া স্টেশনের মালিক ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে। বিএনআর-এর রেলগাড়ি দাঁড়াবে কোথায়? সেলামি দিয়ে হাওড়ায় দু’টো প্ল্যাটফর্ম তাদের ভাড়া নিতে হল। রামরাজাতলায় তাদের টিকিট চেকিং স্টেশন হল। ১৯৩০ সালের মধ্যে বিএনআর সারা দেশে সবচেয়ে বেশি ন্যারো গেজের মালিক হয়ে গেল। ১৯৪৪ সালের ১ অক্টোবর বিএনআর কোম্পানির পরিচালন পর্ষদ ব্রিটিশ ভারত সরকারের হাতে এল। ১৯৫২ সালের ১৪ এপ্রিল বিএনআর ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সঙ্গে মিশে গেল। ১৯৫৫ সালের ১ অগস্ট এর নাম হল দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ে। এখনও রেলযাত্রীরা বিএনআর-কে ভুলতে পারেননি। খড়্গপুর রুটে ট্রেন দেরি করলেই যাত্রীরা বলেন ‘বি নেভার রেগুলার’। বিএনআর-এর মজার, সংক্ষিপ্ত রূপ।
লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy