কেন্দ্রীয় সরকার ভুলিয়াছে যে অবশিষ্ট ভারত হিন্দি বলয়ের উপনিবেশ নহে। শিক্ষা বিলের মাধ্যমে হিন্দি চাপাইয়া দেওয়ার অপচেষ্টা হইতে পিছু হটিলেও সরকার যে হাল ছাড়ে নাই, তাহার প্রমাণ মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রীর নির্দেশিকা। অতঃপর তাঁহার নিকট যত নোট ও ফাইল পাঠানো হইবে, তাহার সবই হিন্দিতে লেখা চাই। অনুমান করা চলে, পারিষদ দলের শত গুণ বলিবার শাশ্বত নিয়ম মানিয়াই তিনি এ হেন ফরমান জারি করিয়াছেন— আশা, কর্তারা প্রসন্ন হইবেন। হিন্দি ভাষার প্রতি তাঁহার, অথবা তাঁহাদের, অনুরাগ থাকিতেই পারে। ইংরাজিতে অধিকার না থাকাও দূষণীয় নহে। তেমন হইলে, ফাইল অনুবাদ করাইয়া লইলেই চলে। মন্ত্রিবর তেমন কোনও পরিকল্পনার কথা জানান নাই। অনুমান করা চলে, হিন্দিতে ফাইল পড়িবার বাসনাটি হিন্দির প্রতি অনুরাগ বা ইংরাজিতে দুর্বলতাপ্রসূত নহে। এই ফরমান আধিপত্যবাদসঞ্জাত— হিন্দি যে হেতু হিন্দু-হিন্দুস্থানের ভাষা হিসাবে রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত, অতএব অ-হিন্দিভাষী ভারত তাহাকে মানিতে বাধ্য। শিক্ষা বিলের ক্ষেত্রে যে হেতু বৃহত্তর জনসমাজ জড়িত ছিল, ফলে প্রতিরোধের প্রাবল্যে কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হটিতে বাধ্য হইয়াছে। বর্তমান ক্ষেত্রে ফরমানটি যে হেতু শুধু সরকারি কর্মীদের মধ্যেই সীমিত, তেমন প্রতিরোধের সম্ভাবনা নাই বলিয়াই নেতাদের আশা বলিয়া অনুমান করা চলে।
শিক্ষা বিলের ক্ষেত্রেও হিন্দির অন্তর্ভুক্তি যেমন পাঠ্যক্রমের প্রশ্ন ছিল না, বর্তমান ক্ষেত্রেও তেমনই তাহা প্রশাসনিকতার প্রশ্ন নহে। প্রশ্নটি নিতান্তই আধিপত্যের। দেশের শাসকরা ভুলাইয়া দিতে ব্যাকুল যে হিন্দি ভারতের জাতীয় ভাষা বা ‘রাষ্ট্রভাষা’ নহে। তাঁহারা গণচেতনা হইতে এই কথাটি মুছিয়া দিতে চাহেন যে ভারতে কোনও একক রাষ্ট্রভাষা নাই— কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে ইংরাজি ও হিন্দির গ্রহণযোগ্যতা সমান। গোটা দেশের স্কন্ধে হিন্দি চাপাইবার রাজনীতিটি নূতন নহে। দেশ স্বাধীন হওয়া ইস্তক সেই প্রচেষ্টা চলিতেছে। সৌভাগ্যক্রমে জওহরলাল নেহরু গণতন্ত্রকে সম্মান করিতে জানিতেন, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা তাঁহার নিকট বাহুল্যমাত্র ছিল না। ফলে, তাঁহার প্রাথমিক ভাবে ঘোষিত অবস্থান হইতে কয়েক পা পিছাইতে বাধ্য হইলেও হিন্দিকে গোটা দেশের উপর চাপাইতে দেন নাই। বস্তুত, তিনি পিছাইয়া আসিবার পরও ভারত যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, তাহাতেই বোঝা সম্ভব, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সম্মানার্থে তিনি কতখানি আগাইয়াছিলেন। বর্তমান নেতৃত্বের নিকট সেই বহুত্বের গুরুত্ব নাই। বিবিধের মাঝে মিলন দেখিবার সুশিক্ষা তাঁহাদের পাঠশালায় হয় নাই। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে বিসর্জন দিয়া তাঁহারা হিন্দি চাপাইতে ব্যাকুল।
ইহা হিন্দির প্রতি ভালবাসা, না কি, ইউনিফর্মিটি বা একরূপতার প্রতি অলঙ্ঘ্য আকর্ষণ, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান আবশ্যিক। কেহ বলিতেই পারেন, তাঁহারা যেমন, বর্তমান শাসকদের নিকট ভারত বলিতে ঠিক সেটুকুই বোঝায়। ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক সম্পর্ক, যৌনতা হইতে ভাষা, কোনও ক্ষেত্রেই ‘অপর’-এর অস্তিত্বকে বৈধতা দিতে তাঁহারা নারাজ। নাগপুরের পাঠশালায় সম্ভবত তাঁহারা শেখেন নাই যে ভারত বলিতে এই বিভিন্নতাকেই বুঝায়— ‘ভারতীয়’ নামক কোনও একশৈল অস্তিত্ব নাই। তাঁহারা সেই অলীক ‘নির্বিকল্প ভারতীয়’ নির্মাণ করিতে নামিয়াছেন। এবং, শুধু ব্যক্তিই নহে, গোটা দেশকেই তাঁহারা ‘এক’-এর সূত্রে বাঁধিতে চাহেন। গত সপ্তাহের বাজেটে নির্মলা সীতারামন কত বার ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান অমুক’-এর উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা লক্ষণীয়। ভারতের সামগ্রিক অস্তিত্ব এই কৃত্রিম একতার বিরোধী ছিল। যে সূত্র এই বিবিধ ভারতকে একত্র করিয়াছিল, তাহার মাহাত্ম্য অনুধাবন করা নাগপুরের পক্ষে অসম্ভব। অতএব, হাতে থাকিল এই আগ্রাসী কৃত্রিমতা। হিন্দির আগ্রাসন তাহার একটি পর্বমাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy