Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
100 Days Work

এ বারও কি জেলায় কাজের সুযোগ বাড়বে না?

সবার জন্য ১০০ দিনের কাজ ও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করলে হয়তো ভিন্ রাজ্যে যাওয়ার এই ঝুঁকি নেওয়া কমানো যেতে পারে। তৎপর হতে হবে প্রশাসনকে। ১৯৯১ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি।

আসিকুল খান
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২০ ০১:৩৯
Share: Save:

বিস্কুট খেয়ে কয়েক দিন কাটল আব্দুল্লাহর। লকডাউনে কাজ বন্ধ। টাকা পয়সা তেমন হাতে না থাকায় খাবার কিনে রাখতে পারেননি। অভাবের সংসার। চার বছরের ছেলেটার মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে মুম্বইতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। কিন্তু সেই যে আটকে পড়লেন, আর ছোট্ট ছেলেটার মুখ দেখা হল না। ৫ এপ্রিল মুম্বইয়ের চার্চগেট হাসপাতালে মারা যান আবদুল্লাহ শেখ। বয়স ৪০ বছর, বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার মেদিনীপাড়া গ্রামে। তাঁর সঙ্গী অন্য শ্রমিকেরা জানান, শারীরিক দুর্বলতা সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। ক’দিন বাদে ছেলে হাবিবুর, বছর চব্বিশের স্ত্রী বিলকিস খাতুন এবং বৃদ্ধা মায়ের কাছে ফিরল ঘরের একমাত্র রোজগেরে ছেলের নিথর দেহ।

১৯৯১ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষ জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। ন্যাশনাল কমিশন অন রুরাল লেবার-এর নথি থেকে জানা যায়, এর মধ্যে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যান এবং ৬০ লক্ষের কাছাকাছি সংখ্যক শ্রমিক নিজের রাজ্যেই ভিন্ জেলায় কাজ করেন। বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্কতার প্রেক্ষাপটে সামনে এল সেই ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্য সঙ্কটের ছবিটা। দেশ জুড়ে লকডাউনের কারণে কর্মস্থলে আটকে বেঁচে থাকাটাই যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, তখন রোগের ভয় উড়িয়ে ঘরে ফেরাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লকডাউন শুরুর এক সপ্তাহ আগেই প্রথম কাজের খোঁজে পঞ্জাবে গিয়েছিলেন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের সুকুমার দাস। ভেবেছিলেন কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর একেবারে পুজোর সময় বাড়ি ফিরবেন। অমৃতসরে একটি কম্বল তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। সেখানেই ১২ এপ্রিল আত্মঘাতী হন সুকুমার। টাকার অভাবে তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পাননি প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু সন্তান। গত রবিবারও মুম্বইয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় চাঁচলের কালীগঞ্জের সুলতান আলির।

ভারতে ভিন্ রাজ্যে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা উত্তরপ্রদেশ, বিহারে সবচেয়ে বেশি। বিহারের অনেক শ্রমিক মহারাষ্ট্রে যান রিকশা চালাতে, ‘মজদুরি’ (দিনমজুরি) করতে। মরাঠিদের কাছে দিনরাত শুনতে হয়, ‘এক বিহারি শ বিমারি’। শুধু তো আর্থিক বা স্বাস্থ্যের অনিশ্চয়তা নয়, প্রতিদিন যুঝতে হয় জাতি-বর্ণ-ধর্ম-ভাষাবিদ্বেষের সঙ্গে। রাজস্থানে মালদহের শ্রমিক আশরাফুলকে পুড়িয়ে মারার নৃশংস ভাইরাল ভিডিয়ো আমরা এখনও ভুলে যাইনি। দিল্লি, মুম্বই, কেরলে ‘বাংলাদেশি’ বলে উঠতে-বসতে হেনস্থা করা হয়, অযথা মামলায় ফাঁসানো হয় বাঙালি শ্রমিকদের। বিহারের পরেই পরিযায়ী শ্রমিকের নিরিখে উল্লেখযোগ্য রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হুগলি ও মালদহ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক ভিন্ রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজে যান। মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ শ্রমিককে দেখা যায় কেরল এবং চেন্নাইয়ে নির্মাণ কাজে যেতে। হুগলি ও মেদিনীপুর জেলার অনেক শ্রমিক বংশানুক্রমিক ভাবে হিরে কাটার কাজ করেন মুম্বই ও গুজরাতে। গুজরাতে মার্বেল নির্মাণের সঙ্গেও যুক্ত মুর্শিদাবাদের অনেকে।

লকডাউনে মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থানার গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের ৮ জন শ্রমিক আটকে রয়েছেন কেরলের ইয়ারনাকুলাম জেলার প্রেম্বাবু থানার একটি সংস্থার কর্মস্থলে। খুরশেদ, সবিরুল ইসলাম, জহরুল খান, আশরফ খান, বাপি খান, কাবিল খান ছাড়াও আটকে জলঙ্গির ৪৫ জন শ্রমিক। গঙ্গাপ্রসাদের ওই শ্রমিকেরা ফোনে জানান, এখন একবেলা আলুসেদ্ধ-ভাত খেয়ে দিন কাটছে তাঁদের। অথচ জেলায় বা রাজ্যে ঠিক মতো মজুরি মেলে না বলে ভিন্ রাজ্যে শ্রম দিতে গিয়েছিলেন পেটের দায়েই। জানালেন, বসতি অঞ্চল থেকে দূরে পাহাড়ি এলাকায় তাঁদের থাকার জায়গায় কেরল সরকারের ত্রাণ পৌঁছচ্ছে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বলে মিলছে না রেশনের সুবিধাও। মালিকপক্ষের তরফে এর মধ্যে এক বার গাড়িতে বেশ কিছু চাল, আলু, তেল, সয়াবিন পাঠানো হয়েছিল। গঙ্গাপ্রসাদের জহরুল জানান, তাঁর দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে তিনি কেরলে গিয়েছেন। তিন বেলা রান্না করতেন অন্য শ্রমিকদের জন্য। ছ’মাস হয়ে গিয়েছে সেখানে, বাড়ি ফেরার টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লকডাউনে ট্রেন বাতিল হয়ে যায়। তাঁর ছেলে কলকাতায় পড়ে, সেও ফিরতে পারেনি। স্ত্রী সারিকা বিবি একাই এখন মাঠের কাজ দেখাশোনা করেন। পড়শির সাহায্য নিয়েই গম চাষের পরে পাটের বীজ ছড়িয়েছেন। একাই জমিতে সেচ দেন, প্রতি সপ্তাহে রেশনের লাইনেও দাঁড়ান। জহরুলের বয়স হয়েছে।

লকডাউনে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার অজুহাতে এই শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি দিতেও এখন অস্বীকার করছেন মালিকপক্ষ। জহরুল জানান, সংস্থার কাছ থেকে তিনি ১৫ হাজার টাকা পান। তার উপরে কাজ হারালেন। এখন কী করে সংসার চালাবেন, সেই চিন্তায় তাঁদের ঘুম উড়েছে। তার পরে রয়েছে রয়েছে ভিন্ রাজ্যে থাকা খাওয়ার অনিশ্চয়তা। আজকে এ রাজ্যে কলকারখানা, শিল্পের সঠিক পরিকাঠামো থাকলে এই শ্রমিকদের এ ভাবে ঘরছাড়া হতে হত না।

নিজের রাজ্যে কাজের অনিশ্চয়তা, মালিকপক্ষের আমানবিক দর কষাকষি ও যৎসামান্য পারিশ্রমিকে উপায় না দেখে বছরের পর বছর তাঁরা কেরলে, মুম্বই বা চেন্নাইয়ে কাটিয়ে দেন। তা ছাড়া মরসুমি কাজের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারো মাস চাষের কাজের পরিকাঠামো না থাকাতেও তাঁরা ভিন্ রাজ্যে যেতে বাধ্য হন।

‘সেকেন্ডারি সেক্টর’ অর্থাৎ, কারখানার কাজে তাঁরা কেউ কেরলের রবার কোম্পানিতে, প্লাইউড কোম্পানিতে, কেউ বা আহমদাবাদে কাপড় কারখানায় কাজ করেন। আর ‘টারশিয়ারি সেক্টরে’ চেন্নাইয়ে, মুম্বইয়ে তাঁরা ভবন নির্মাণের কাজে যান। অনেকে যান ভিন্ দেশে।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপায় নেই। তাই ভিন্ রাজ্যে একটা ঘরেই ২০-২৫ জন মিলে গাদাগাদি করে থাকছেন এই শ্রমিকেরা।

অথচ, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিস্তারিত কোনও পরিসংখ্যান নেই কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির কাছে। এই শ্রমিকদের ফিরিয়ে এনে সবার আগে তাঁদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া উচিত রাজ্য সরকারের। শ্রম দফতরের তরফে তাঁদের সঠিক নথি তৈরি হোক, যাতে যে কোনও বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো যায়। সবার জন্য ১০০ দিনের কাজ ও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করলে হয়তো ভিন্ রাজ্যে যাওয়ার এই ঝুঁকি নেওয়া কমানো যেতে পারে।

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy