আরিব্বাস! পাঁচ লক্ষ কোটি ডলার। পাঁচের পরে একটা নয়, দুটো নয়— একেবারে এক ডজন শূন্য! তার পর আবার টাকা নয়, ডলার! আর মাত্র পাঁচ বছর। তার পরেই নরেন্দ্র মোদীর বাহাদুরিতে এত্ত বড় হয়ে উঠবে ভারতের অর্থনীতি! ভাবলে অনেকেরই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ছাতি ফুলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি না হলেও, গর্বও হচ্ছে বেশ।
কিন্তু তাতে কী হবে?
প্রশ্নটা শুনে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মন্ত্রী সান্ত্রিরা জবাব দিচ্ছেন, কী হবে বলে দিতে হয়? দেশের জিডিপি যদি ৫ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যায়, তা হলে দেশের মানুষের হাতে অনেক বেশি টাকা থাকবে। সবাই সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে।
হাতে টাকা থাকলে স্বাচ্ছন্দ্য আসতে পারে। কিন্তু তাতে মনে সুখ আসে, এমন গ্যারান্টি কেউ দেবেন না। আর দেশের জিডিপি তুঙ্গে উঠলে যদি সুখ বাড়ত, তা হলে হলফ করে বলা যায়, ভারতবাসীর মনে সুখ এখনই ধরছে না। কারণ দেশের জিডিপি এখনই আড়াই লক্ষ কোটি ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে। যা আগে কখনও হয়নি। সেই হিসেবে দেশের মানুষও এত সুখী আগে কখনও হয়নি। কিন্তু ২০১৮-র ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ বলছে, গোটা বিশ্বে সুখের মাপকাঠিতে এ দেশের স্থান ১৪০ নম্বরে।
তারও আগে রয়েছে আসল প্রশ্ন। তা হল, দেশের জিডিপি বাড়লে কি আমজনতার হাতে বেশি টাকা আসবে? জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বাড়বে?
মজার কথা হল, এই জিডিপি নামক খটোমটো ব্যাপারটার অন্যতম অাদি তাত্ত্বিক সাইমন কুজ়নেটস নিজেই পইপই করে একটা কথা বলে গিয়েছিলেন। তা হল, জিডিপি দিয়ে দেশের মধ্যে কলকারখানায়, চাষের জমিতে, ব্যবসায় মোট কতখানি উৎপাদন হচ্ছে, তা আঁচ করা যেতে পারে বটে। কিন্তু মানুষের জীবনে কী উন্নতি হল, তার জীবনযাত্রায় কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য এল, সে তার ছেলেমেয়েকে ভাল স্কুলে পাঠাতে পারল কি না বা অসুখ-বিসুখে ভাল ডাক্তার পেল কি না, তা এ দিয়ে ভুলেও মাপতে যেয়ো না। অর্থাৎ, জিডিপি-র সঙ্গে মানুষের জীবনে উন্নয়নের সম্পর্ক নেই। কারণ স্পষ্ট। জিডিপি বাড়লে মাথাপিছু জিডিপি বাড়ে না। মাথাপিছু আয়ও বাড়ে না।
জিডিপি-র আয়তন ধরলে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি। তার মানে কি এই যে ভারতীয়রা বিশ্বে ধনীদের তালিকায় সাত নম্বরে? বলা বাহুল্য, তা নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের হিসেবে, এ দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় মাসে মাত্র ১০,৫৩৪ টাকা। ইন্দোনেশিয়ার জিডিপি ভারতের তিন ভাগের এক ভাগ হলেও, সেখানকার মাথাপিছু আয় ভারতের দ্বিগুণ। ব্রিটিশদের আয় এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের ২১ গুণ বেশি। অথচ ভারত ও ব্রিটেনের জিডিপি প্রায় সমান সমান। মনে রাখা দরকার, ২০২৪ সালে দেশের জিডিপি যখন ৫ লক্ষ কোটি ডলার ছোঁবে, তখন দেশের জনসংখ্যাও প্রায় ১৪৩ কোটিতে পৌঁছবে বলে অনুমান। ফলে ভাগাভাগি করে মাথাপিছু আয় খুব বেশি বাড়বে না।
২০০৮-এ বিশ্ব জুড়ে মন্দার পরে দুই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ— অমর্ত্য সেন ও জোসেফ স্টিগলিৎজ় বলেছিলেন, শুধু জিডিপি ও তার বৃদ্ধি মাপলে চলবে না। মানুষের উপকার কতখানি হচ্ছে, তা মাপার জন্য নতুন মাপকাঠি দরকার। সঠিক মাপকাঠি না থাকলে, সঠিক নীতিও তৈরি হবে না। নীতিনির্ধারকরা শুধু জিডিপি-জিডিপি করে মাথার চুল ছিঁড়বেন।
আর সব ভুলে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা হলে বিপদও রয়েছে। কারখানা করতে গিয়ে উর্বর জমি দখল হতে পারে। খনিজ এলাকা থেকে জনজাতীয়দের উৎখাত করা হতে পারে। বুলেট ট্রেন ছোটাতে গিয়ে পরিবেশের চিন্তাভাবনা শিকেয় উঠতে পারে। দেশে এই সব রোগের লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। কখন প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে, সেই ভয়ে মোদী সরকার কড়া আইন করে শিল্পমহলকে মুনাফার একটা অংশ সমাজের উন্নয়নে খরচ করাতে চাইছে। গোটা বিশ্বেই একই ভয়। আমেরিকার অ্যাপল, অ্যামাজ়ন, জেনারেল মোটর্স, ওয়ালমার্টের মতো শ’দুয়েক সংস্থার সিইও গোলটেবিল বৈঠক করে স্থির করেছেন, এ বার থেকে তাঁরা বেশি করে সমাজের খেয়াল রাখবেন। শুধুই মুনাফার কথা ভাববেন না। না হলে মন্দার কোপ পড়লে মানুষ খেপে উঠতে পারে।
খেপে ওঠার কারণ যে কিছু কম রয়েছে, তা নয়। জিডিপি বাড়লে সকলের রোজগার বাড়বে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। এমনটা হতেই পারে, কেবল গুটিকতক মানুষের আয় বাড়ল। বস্তুত তা-ই হয়েছে। ২০১৯-এর অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, এ দেশের সবচেয়ে বড়লোক ১ শতাংশ মানুষের সিন্দুকে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। এক বছর আগেও ওই ১ শতাংশ মানুষের হাতে ৫৮ শতাংশ সম্পদ ছিল। বড়লোকদের ধনসম্পদ বেড়েছে। কিন্তু নিচুতলার গরিব ৫০ শতাংশ মানুষের রোজগার এক বছরে বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ।
মোদীর অমাত্যরা বলছেন, দেশের জিডিপি বাড়ার অর্থ, দেশের সমৃদ্ধি। কারখানার মালিকেরও লাভ, শ্রমিকেরও লাভ। কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা হলে গরিবেরও আয় বাড়বে। সরকার আরও বেশি করে গরিবের উপকার করতে পারবে। দেশের জিডিপি গত পাঁচ-দশ বছরেও বেড়েছে। অথচ, ২০১৮-র মানব উন্নয়ন সূচক বলছে, বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান প্রায় শেষে, ১৩০তম স্থানে। এ থেকেই স্পষ্ট, গরিব বাড়ির অনেক সন্তান জন্মের পর অপুষ্টিতে ভুগছে। ছোট মেয়েটি কয়েক বছর স্কুলে গিয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। পড়াশোনা শিখলেও সে চাকরি পাচ্ছে না। মুশকিল হল, এর উপরে যদি অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়ে, মন্দা দেখা দেয়, তবে বড়লোকদের গায়ে তেমন আঁচড় লাগে না। মারা পড়ে নিচুতলার গরিব মানুষগুলিই।
এ সব নিয়ে অবশ্য তেমন তর্কবিতর্ক নেই। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দু’সপ্তাহ পর নরেন্দ্র মোদী তাঁর ঝোলা থেকে ৫ লক্ষ ডলারের অর্থনীতি নামক সুখস্বপ্নটি বার করেছিলেন। তার পরে বিতর্ক একটাই— এটা কি আদৌ সম্ভব না নেহাত ছেলেভুলানো কথা?
কেউ বলছেন, ও তো এমনিতেই হবে। এখনই জিডিপি ২.৭ লক্ষ কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলেছে। আর্থিক বৃদ্ধি যদি ৮ শতাংশ হয় আর মূল্যবৃদ্ধির হার যদি ৪ শতাংশও হয়, তা হলেই ২০২৪-এ জিডিপি ৫.৩৩ লক্ষ কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলবে। এতে আর কেরামতি কিসের? আর এক দল বলছেন, অর্থনীতি তো ঝিমিয়ে পড়েছে। মানুষের চাকরি যাচ্ছে। চাষিরা আত্মহত্যা করছেন। বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের গণ্ডিই টপকাতে পারছে না। কী ভাবে লক্ষ্য পূরণ হবে?
ও-দিকে ভক্তকুল বলছে, ওঁর নাম নরেন্দ্র মোদী। মোদীজি যখন বলেছেন, ঠিক করেই দেখাবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যুক্তি দিয়েছেন, দেশে সম্পদ তৈরি করেন শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। তাই দেশের জিডিপি নিশ্চিত ভাবেই ২০২৪-এ ৫ লক্ষ কোটি ডলারের জাদুসংখ্যা ছুঁয়ে ফেলবে।
২০২৪ সালটা গুরুত্বপূর্ণ। ফের লোকসভা ভোট। নরেন্দ্র মোদীর সামনে প্রধানমন্ত্রীর গদি দখলের হ্যাটট্রিক করার হাতছানি। শুধু লোকসভা ভোট নয়। ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর মন্ত্রে হয়তো লোকসভার সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা ভোট করে ফেলারও একটা চেষ্টা করতে পারেন মোদী। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে যদি ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্নপূরণ করে ফেলা যায়, তা হলে স্বর্গ থেকে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি না করলেও, ভোটাররা যে ভোট-বৃষ্টি করবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy