বিজেপির মন্ত্রী (বর্তমানে প্রাক্তন) মন্তব্য করেন, ডারউইনের তত্ত্ব ভুল, কারণ বাঁদরকে মানুষে পরিণত হতে কেউ কোনও কালে দেখেনি। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মৃত্যুদণ্ড জারি হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। তখন আমরা (তৎকালীন) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপালকে বলতে শুনেছিলাম যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ভুল। এ তত্ত্ব স্কুলে পড়ানো উচিত নয়। এখন মনে হচ্ছে জল্লাদ পাওয়া গিয়েছে। ফাঁসির তোড়জোড় চলছে। শীঘ্রই সিলেবাস থেকে বাদ পড়বে ডারউইনের তত্ত্ব। সপ্তসিন্ধু উপত্যকায় শান্তি আসবে ফিরে। কিন্তু মন্ত্রী একটা কাঁচা কাজ করেছিলেন। নেহাত দেশে পড়াশোনা একটু কম। না-হলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যেতেন। তাঁর মতে ডারউইনের তত্ত্ব ভুল, কারণ বাঁদরকে মানুষে পরিণত হতে কোনও কালে কেউ দেখেনি। মানুষ চিরকাল মানুষ হয়েই দেখা দিয়েছে। কেউ যে দেখেনি তা ঠিক। কিন্তু কোনও তত্ত্ব ঠিক না ভুল তা কি নিজের চোখে দেখে ঠিক করতে হবে? নিজের কানে শুনে ঠিক করতে হবে?
এ তো গ্যালিলি ও নিউটনদের কথা। তাই তো পশ্চিমের দেশে এক্সপেরিমেন্টের এত চল। আমাদের বিজ্ঞান সে কথা বলে না। আমরা জানি কোনও কথা বেদে থাকলে ঠিক। না থাকলে ভুল। প্রাচীন ভারতে সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে ধ্যানমগ্ন ঋষিদের কাছে— অরণ্যে তপোবনে গিরিচূড়ায়। তার জন্য ল্যাবরেটরির দরকার হয়নি। তবে রীতিমতো তপস্যা করতে হয়েছে। উর্বশী-মেনকাদের উপদ্রব সহ্য করতে হয়েছে। পাশ্চাত্যের গুণীজন তা পারেনি। তাই ওদের শ্রুতি। আমাদের স্মৃতি। এই সত্যে স্থির থাকতে না-পারলে ডারউইনকে বাদ দিলেও কোনও লাভ হবে না।
নিষ্প্রাণ বস্তুজগতে যেমন, জীবজগতেও আমরা দেখি অসীম বৈচিত্র। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে এই বৈচিত্রের কারণ কী? কী এর তাৎপর্য? মানুষ যতই বৈচিত্রের কারণ খুঁজেছে, ততই ধরা পড়েছে অন্তর্নিহিত ঐক্য। আপাতদৃষ্টিতে দুই বস্তু ভিন্ন হলেও খুঁটিয়ে দেখা গিয়েছে তারা সম্পূর্ণ পৃথক নয়। এই সূত্র ধরেই আমরা জেনেছি অ্যাটম ইলেকট্রন প্রোটনের কথা। গ্রিকরা মনে করতেন সব বস্তুই চার উপাদান দিয়ে তৈরি— জল মাটি অগ্নি আর বায়ু। এই ধারণা বদলে এসেছে মেন্ডেলেভের পিরিয়ডিক টেবিল। সেই টেবিলে স্থান পেয়েছে শ’খানেক মৌল। তার পর এসেছে কণা-পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল— কোয়ার্ক লেপটন হিগস বোসনের দলবল নিয়ে। মেন্ডেলেভের পিরিয়ডিক টেবিলও হিন্দুত্ববাদী রোষে পড়েছে। সে-ও গেল বলে। হিগস বোসনকে কিছু বললে কিন্তু বাঙ্গালি ছেড়ে দেবে না।
প্রাণী-জগতে বৈশিষ্ট্যের ধারক-বাহক হল প্রজাতি। আমরা এক বিশিষ্ট প্রজাতির সদস্য যার লাতিন নাম হোমো-সেপিয়েন্স-সেপিয়েন্স। আমাদের গুণের শেষ নেই। বুদ্ধিমান শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রাণ পরিবেশ-সচেতন জীব হিসেবে আমাদের বিশ্বজোড়া নাম। যে কোনও দুই প্রজাতির মধ্যে তফাত স্পষ্ট। হাঁসের বাচ্চা হাঁসই হবে, সজারু হবে না। সে কথা আমরা চোখ বুজে বলে দিতে পারি। কিন্তু এত প্রজাতি এল কোথা থেকে? সৃষ্টির প্রথম লগ্নে কি আমরা সবাই একই প্রজাতির সদস্য ছিলাম? এই প্রশ্নে আকৃষ্ট হলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। বিলেতে শিল্প-বিপ্লব তত দিনে অনস্বীকার্য সত্য। কিন্তু খ্রিস্টান চার্চ তখনও সর্ব-কর্ম-চিন্তা-আনন্দের নেতা।
চার্চের সুচিন্তিত মত এই যে, সৃষ্টিকর্তা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন। এত কম সময়ে রেডিমেড প্রজাতি ছাড়া উপায় ছিল না। কাজেই এখন যে প্রজাতি আমরা দেখি গোড়াতেও তারাই ছিল। ডারউইন একদিন দেখলেন এইচএমএস বিগল নামে এক জাহাজ যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে। বড়লোকের ছেলে। চাকরিবাকরির দায় ছিল না। চেপে বসলেন জাহাজে। ফিরলেন পাঁচ বছর পরে। সঙ্গে তখন স্বচক্ষে দেখা দক্ষিণ আমেরিকার জীব-বৈচিত্রের বিবরণ। ফিঞ্চ নামক এক পাখির গঠনবৈশিষ্ট্য বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। দেখলেন ফিঞ্চের অজস্র প্রজাতি। প্রজাতিদের মধ্যে তফাত খুবই কম। শুধু তাই নয়, এক এক দ্বীপে এক এক প্রজাতি। তাদের বৈশিষ্ট্যে পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট।
ডারউইন বুঝলেন হিসেব মিলছে না। সৃষ্টিকর্তা এত অজস্র প্রজাতির সৃষ্টি করবেন কেন? কোনও প্রজাতি যদি দেবতারই সৃষ্টি হবে তা হলে পরিবেশের প্রভাব থাকবে কেন? সৃষ্টিকর্তা কি নিজেই চার্চের তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করতে উদ্যোগী হয়েছেন? ক্রমে তিনি বুঝলেন, একই প্রজাতির ফিঞ্চ বিভিন্ন দ্বীপের ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেকে একটু একটু করে বদলে ফেলেছে। বিলেতে যারা পোষ্য কুকুরের ব্যবসা করে, তাদের ডারউইন দেখেছেন ভিন্ন জাতের রক্ত মিশিয়ে খদ্দেরের পছন্দমত হয় শিকারি গ্রেহাউন্ড, না-হয় ভোডাফোনের পাগ, না-হয় গোল্ডেন রিট্রিভারের জন্ম দিতে। এখানে প্রকৃতি নিজেই সে কাজ হাতে নিয়েছে। খদ্দেরের ইচ্ছার পরিবর্তে এর চালিকাশক্তি হয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদ। ডারউইন এই প্রক্রিয়ার নাম দিলেন ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্বাচন। এর ফল হল ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’। যোগ্যতমের উদ্বর্তন।
পরিবেশ বদলালে তোমাকেও বদলাতে হবে। পারলে বংশবৃদ্ধি। না পারলে ঘ্যাচাং। ডারউইন অবশ্য জানতেন না, ন্যাচারাল সিলেকশন কী ভাবে কাজ করে। জেনেটিক্স বা জিনতত্ত্ব এসেছে তাঁর লেখা ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’-এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে। এখন আমরা জানি, পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে পরিবর্তন হয় জিনে। জিনের দ্বারাই পরিবর্তন প্রবাহিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। বেশ কয়েক প্রজন্মের পরে দেখা যায় প্রজাতির বৈশিষ্ট্যে স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে। কোনও প্রজাতিকে আমরা এখন যে রূপে দেখছি সেই রূপ পেতে হয়তো তার লেগেছে একশ কোটি বছর। ব্যাপারটা ছয়-সাত দিনের নয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না খ্রিস্টান জগতে ডারউইন কেন ব্রাত্য হয়েছেন। ইসলাম ধর্মীয় দেশেও তিনি নিষিদ্ধ। বলাই যায়, তাঁকে বহিষ্কার করে হিন্দুত্ববাদীরা জাতে উঠল।
রবীন্দ্রনাথ নেহরুর প্রভাবে আমরা দেশের দ্বার অবারিত রেখেছি বহু দিন। বিদেশি বিজ্ঞান দর্শন রাজনীতি— সবেরই ছিল মুক্ত প্রবেশাধিকার। ডারউইন তাঁর ‘ভুল’ তত্ত্ব চালাতে পেরেছেন। অনেকে হিন্দুদেরই বৌদ্ধিক সম্পদ চুরি করে নিজের নামে চালিয়েছেন। আমরা বাধা দিইনি। পিথাগোরাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের গণিতজ্ঞ বিজ্ঞানী। তাঁর সমকোণী ত্রিভুজ তত্ত্ব আমাদের ইস্কুলে পড়তে হয়। এই তত্ত্ব কি হিন্দুদের নয়? কত উদাহরণ দেব? হিন্দুদের নাম রয়ে গিয়েছে এক শূন্যের আবিষ্কারক হিসেবে। যে জিনিস নেই তা চুরি করবে কে?
নিউটনের নামেও কানাঘুষো হচ্ছে। তাঁর সূত্র নাকি তাঁর নিজের নয়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যদি ডারউইন নিউটন না-পড়তে পারে, তা হলে দেশের ভবিষ্যৎ? আপাতত আমাদের কর্তব্য দেশের অতীতকে উদ্ধার করা। সে কাজ সম্পূর্ণ না করে ভবিষ্যতের কথা ভাবা ফলপ্রসূ হবে না। আগের কাজ আগে তো তুমি সারো! পরের কথা ভাবিও পরে আরও।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত ব্যক্তিগত।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy