পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের পায়ের নীচে জমি নাই। যে জমি বেসরকারি উদ্যোগপতির শিল্পের জন্য মিলে না, সরকারি রেল প্রকল্পের জন্যও তাহা অমিল। বিমানবন্দর হইতে বারাসত অবধি মেট্রো সম্প্রসারণ প্রকল্প আটকাইয়া আছে, কারণ তাহার জন্য এক লপ্তে দুই হাজার পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করিতে হইবে। সেই কাজে সরকারের আগ্রহ নাই। রেল মন্ত্রকও সরাসরি জমি অধিগ্রহণ করিতে নামিবে না। ফলে, প্রকল্প ঘোষিত হওয়ার পর সাত বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, কাজ আগায় নাই। গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকারের নিকট রাজনীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গণদেবতা যাহাতে চটেন, নেতারা ভুলিয়াও সেই কাজ করিবেন না। অতএব, ২০০০ পরিবারকে স্থানান্তরিত করিবার কাজটিকে রাজ্য সরকার বিষবৎ এড়াইতেছে। এ ক্ষণে প্রশ্ন, তাহা হইলে কি স্থিতাবস্থাই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ হইবে? রাজনীতির পায়ে ভবিষ্যৎকে উৎসর্গ করিয়াই রাজ্যের দিন কাটিবে? কেহ বলিতেই পারেন, জনমত মানিয়া চলা যেমন রাজনীতির ধর্ম, তেমনই জনমত নির্মাণও তাহার দায়িত্ব। বৃহত্তর স্বার্থে কিছু মানুষকে যে ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়, এই কথাটি বুঝাইয়া বলা সরকারেরই কাজ। তাহার জন্য জুলুমের প্রয়োজন নাই, রাতবিরেতে পুলিশ নামাইয়া উচ্ছেদের প্রয়োজন নাই। কিন্তু, আলোচনা প্রয়োজন। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক এবং চরিত্র কী হইবে, আলোচনার মাধ্যমে তাহা স্থির করিতে হইবে। কিন্তু, রাজ্যের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে যে অধিগ্রহণ বিধেয়, তাহা হইতে পিছাইয়া আসা চলিবে না।
পশ্চিমবঙ্গের সরকার এই মত মানিবে কি না, তাহা সরকারের বিবেচ্য। রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অপেক্ষা ভোটের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ তাহাদের নিকট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হইতেই পারে। সরকার বলিতেই পারে, মানুষ স্বেচ্ছায় সম্মত না হইলে কোনও ভাবেই জমি অধিগ্রহণ করা হইবে না, এমনকি মানুষকে বুঝাইয়া রাজি করাইয়াও নহে। বস্তুত, অধিগ্রহণের প্রশ্নে ইহাই রাজ্য সরকারের শেষ ঘোষিত অবস্থান। সরকার এখনও সেই অবস্থানেই অনড় কি না, মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়া দিলে অন্তত একটি সুবিধা হয়। এখনও যাঁহারা দুর্মর অাশাবাদী, এখনও যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ লইয়া স্বপ্ন দেখেন, তাঁহারা নিরস্ত হইবেন। বুঝিয়া লইবেন, এই রাজ্য যেমন ছিল, তেমনই থাকিবে। বস্তি সরাইয়া মেট্রো রেলের পথ তৈরি হইবে না। তাহাতে রাজ্যের কী লাভ, মানুষ বুঝিয়া লইবেন। কিন্তু, প্রকল্প ঘোষণা এবং জমির অভাবে তাহা অনন্তকাল বন্ধ থাকার পরিচিত কুনাট্য হইতে মুক্তি মিলিবে।
কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীও কার্যত একই কথা বলিয়াছেন। তাঁহার সিদ্ধান্ত, অতঃপর রেলের হাতে জমি থাকিলে তবেই নূতন প্রকল্পের অনুমোদন মিলিবে। কলিকাতা মেট্রোর সম্প্রসারণের যে কোনও অধ্যায়ের দিকে তাকাইলেই এই সিদ্ধান্তটির অনিবার্যতার কথা বোঝা সম্ভব, কিন্তু তাহা রাজ্যের পক্ষে মারাত্মক। রেলের হাতে জমি থাকিলে তবেই প্রকল্পের অনুমোদন মিলিবে— এমন হইলে ক্ষতি পশ্চিমবঙ্গেরই। কিন্তু অর্থনীতিতে বিশ্বাসের অভাব ঘটিলে ইহাই স্বাভাবিক পরিণতি। রাজ্যের স্বার্থে, প্রকল্পের স্বার্থে রাজ্য সরকার জমি জোগাড় করিয়া দিবে, অন্তত সেই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করিবে, এই বিশ্বাসের ভরসা থাকিলে নূতন প্রকল্প তৈরি হইত। বাস্তব সেই বিশ্বাসের কণ্ঠ রোধ করিয়াছে। রাজ্যের উন্নয়নে সরকার যে ‘স্বাভাবিক শরিক’, এই কথাটি ফের প্রতিষ্ঠা করিবার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁহাকে বুঝিতে হইবে, রাজ্যের ভবিষ্যতের অধিক আর কিছুই তাঁহার নিকট গুরুত্বপূর্ণ নহে। রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেও কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ মূল্যবান। রাজ্যের অর্থনীতি না বাঁচিলে জনপ্রিয়তাও এক সময় মরিবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সত্যের মূল্য চুকাইয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়া শিখিবেন কি না, তিনিই স্থির করিবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy