প্রতীকী চিত্র।
অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপালের কথাটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। তিনি শীর্ষ আদালতে আশঙ্কা জানাইয়াছেন, যে দল হারিবে, তাহার অনুদানকারীরা পরবর্তী কালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হইতে পারেন। দুর্জনে বলিবে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের সিংহভাগ কেন বিজেপির অভিমুখে ধাবিত হইয়াছে, সেই কারণ সন্ধানে আর অন্য কোনও দিকে তাকাইবার প্রয়োজন নাই। অ্যাটর্নি জেনারেলই বলিয়া দিয়াছেন। কিন্তু, তাহা তুলনায় গৌণ প্রশ্ন। প্রতিহিংসা স্বয়ংসিদ্ধ নহে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকিলে এই ভীতিটিকে সমূল উচ্ছেদ করা সম্ভব। বন্ড সংক্রান্ত অন্তত তিনটি গভীরতর প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্নটি স্বচ্ছতা বিষয়ক। যে শাসকরা কালো টাকার মূলোচ্ছেদ করিবার অভিপ্রায়ে গোটা দেশের উপর নোট বাতিল আছড়াইয়া ফেলিতে পারেন, স্বচ্ছতাকে তাঁহাদের এত ভয় কিসের? সম্প্রতি অন্তত দুইটি প্রশ্নে শীর্ষ আদালতের পরিসরে এই ভয়টি প্রকট হইল। দ্বিতীয়টি নির্বাচনী বন্ড, আর প্রথমটি রাফাল চুক্তি। গোপন করিবার এমন উদগ্র তাড়নাতেই সন্দেহ হয়, সরকার বা শাসক দলের হাতে বুঝি দাগ লাগিয়া আছে। সেই সন্দেহ দূর করিবার সুযোগগুলি নরেন্দ্র মোদীরা পর পর হারাইতেছেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দ্বিতীয় প্রশ্ন পদ্ধতিগত। ২০১৭ সালে যখন এই নির্বাচনী বন্ডের কথা ঘোষিত হয়, তখনই আপত্তি উঠিয়াছিল। এক দিকে রাজনৈতিক আপত্তি, অন্য দিকে প্রশাসনিক আপত্তি। নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রককে চিঠি লিখিয়া জানায়, বন্ড চালু করিতে যে ভঙ্গিতে আইন সংশোধন করা হইতেছে, তাহাতে রাজনৈতিক দলগুলির অর্থের জোগানে স্বচ্ছতার বিপুল ঘাটতি হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও আপত্তিতেই কর্ণপাত করে নাই। নির্বাচন কমিশনের আপত্তিকে গ্রাহ্য না করিয়াই অর্থমন্ত্রক প্রকল্পটি ঘোষণা করে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, ইহাই নরেন্দ্র মোদীর জমানার অভিজ্ঞান। অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে শাসন চালাইবার মতোই, নেহাত সংখ্যার জোরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আপত্তিকে উপেক্ষা করা। এবং, আরও এক বার সরকার সুপ্রিম কোর্টের দোরগোড়ায় ঠেকিয়া গিয়াছে। বন্ধ খামে হইলেও নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অনুদানের দাতাদের নাম প্রকাশ করিবার আদেশটি ফের জানাইয়া দিল, আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগ নহে, ভরসা শেষ অবধি বিচারবিভাগই। শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হইলেই একমাত্র গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষা হইতে পারে। কিন্তু, একটিমাত্র স্তম্ভের উপর দাঁড়াইতে বাধ্য হইলে গণতন্ত্রের ভারসাম্য লইয়া প্রশ্ন উঠিবেই।
দাতার নাম প্রকাশ না হইলে যে অস্বচ্ছতা, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নিকট তাহার তাৎপর্য যতখানি, নাগরিকের নিকট তাহার তুলনায় ঢের বেশি। যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি কোনও একটি রাজনৈতিক দলকে আর্থিক সাহায্য করিতেছে, দলটি ক্ষমতায় আসিলে— অনুমান করা চলে— প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের পাওনা বুঝিয়া লইবে। কোনও দলই যে কথাটি প্রকাশ্যে স্বীকার করিবে না, কিন্তু দেশবাসী যে কথা অভিজ্ঞতায় জানেন এবং যাহার সত্যতা লইয়া তাঁহাদের বিন্দুমাত্র সংশয় নাই— নির্বাচিত সরকার কোনও একটি বিশেষ বাণিজ্যিক সংস্থার স্বার্থের কথা খানিক বেশি ভাবিবে। দুর্জনে বলিবে, খানিক বেশি নহে, শুধু তাহাদের স্বার্থের কথাই ভাবিবে। অর্থাৎ, নির্বাচনে ভোটাররা শুধু কোনও একটি দলকে বাছিতেছেন না, সঙ্গে কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা ও তাহাদের ব্যবসায়িক স্বার্থও বাছিতেছেন। এবং, বিপজ্জনক কথা হইল, সেই সংস্থাগুলি কী, তাহাদের স্বার্থই বা কী, না জানিয়াই বাছিতেছেন। মারাত্মক চয়নের অধিকার! নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচনী বন্ড থাকিলে এই বিপদটিও অনিবার্য। খামের মুখ খুলিয়া অনুদাতা সংস্থাগুলির নাম জানিবার অধিকার কি ভারতের ভোটার দাবি করিতে পারেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy