জনাবেগ: অযোধ্যা, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২
স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোন দিনটির, ভবিষ্যতে তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা হলে ৯ নভেম্বর তারিখটি কিন্তু সগৌরবে এবং মহা-আত্মপ্রত্যয়ে নামতে পারবে সেই দৌড়ে। একটা ‘নতুন’ ভারতের উপর সিলমোহর পড়ল গত কাল। তার দিক্নির্দেশ বা সূচনা অনেক দিন আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গতকাল যা ঘটল, তাকে একটা চূড়ান্ত স্বীকৃতির ব্যাপার হিসেবেই দেখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদ-সংক্রান্ত মামলার শেষ রায় দেখতে গিয়ে ভাবছিলাম, এর মধ্যে একটা চূড়ান্ততা আছে। আর কোনও তর্ক নয়, যে পথ বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেই পথ ধরে চলবে আমাদের দেশ। আর কোনও কিছুর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে। সর্বোচ্চ আদালত বিচার করে রায় দিয়েছেন, সেই রায় অবশ্যই শিরোধার্য। বিচারপতিদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও ধরনের উদ্দেশ্য আছে বলে সামান্যতম ইঙ্গিত করারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না, উঠতে পারে না। কিন্তু আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে কয়েকটি প্রশ্ন তোলা চলে, বলা চলে কিছু সংশয়ের কথা।
কাল সকালে এক বন্ধু বলছিলেন, তাঁর মনে পড়ছে সেই কবিতার লাইনটা: আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ। কিন্তু কাব্যিকতার দিন আর আছে কি? না কি, শেষ ঘণ্টা বেজে ‘পরীক্ষা’ হল বন্ধ হয়েছে? জাতি-র যে নতুন ব্যাখ্যা আমাদের ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ বার কি তাকেই একটা পাকা রকমের স্বীকৃতি দেওয়া হল? এত দিন আমাদের শেখানো হচ্ছিল, ভারত নামে বহু-বিচিত্র মানবসমাজে একটি খণ্ড ও সঙ্কীর্ণ অংশ এখন কেবল সমগ্রের জায়গায় বসবে না, বাকি অংশগুলোকে তার নিজের মর্জিমতো চালাবেও বটে। যদি কেউ সেই মর্জিতে আপত্তি করে, প্রতিবাদ তোলে, তা হলে ধরে নেওয়া হবে যে, সে এই জাতিগঠনে বাধা দিচ্ছে। পরোক্ষে একটা সিলমোহর পড়ল কি এই ভাবনায়?
অনুমান করা যায়, এই রায়কে শাসকরা ‘সমগ্র জাতির ইচ্ছা’র রূপায়ণ হিসেবেই দেখাতে চাইবেন। এটাই নতুন ভারতের মূর্ত চেহারা— রামমন্দিরের এক-একটি শিলা দিয়ে যার নির্মাণ হয়েছে। আর তাই, সর্বোচ্চ আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতি একমত হয়ে যে রায় দিয়েছেন— কেন্দ্রীয় শাসকরা বার বার তার মধ্যে জয়পরাজয় দেখতে বারণ করছেন। মামলায় জড়িত সেই সব পক্ষও দ্রুত জানিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা কোনও ভাবে এই রায়কে প্রশ্ন করবেন না। প্রধান বিরোধী দলের মুখপাত্রও বলে দিয়েছেন, কোনও ‘রাজনীতি’ নয় এই নিয়ে!
এই রায়ে অনেকটা জটিল চিন্তার ছাপ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটানোর পরিচয় মেলে। এর পরতে পরতে উঁকি দেয় জনতার ভাবাবেগকে বিচারপ্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার আগ্রহ। প্রথা, সংস্কার, ইতিহাস ভেঙে যে সর্বমান্য ‘রাজনীতি’কে জায়গা করে দিচ্ছে সেই জনাবেগ: তার দান পাল্টানো সহজ নয়, সম্ভবও নয়। এটাই হয়তো এই ঐতিহাসিক মামলার পরি-সমাপন, ‘ক্লোজ়ার’।
কেউ বলবেন, বাবরি মসজিদ যে রামের মন্দির ভেঙেই হয়েছিল, সেও তো ছিল এক রকমের রাজনীতি। কথাটা অত সরল নয়। এই ভূভারতে, অতীত থেকে বর্তমান কালে, রাজনীতি ব্যতীত একটা মুহূর্তও তো কাটেনি। কিন্তু সেই সব মুহূর্ত তো এখানে বিচারাধীন ছিল না। বিচারাধীন ছিল কেবল একটি বিশেষ ঘটনা, যেখানে ভাবাবেগ-জর্জরিত জনতার ঢল গিয়ে একটি পুরনো মসজিদকে ভেঙে দিয়েছিল, এবং তা নিয়ে একটা রাজনৈতিক প্লাবন তৈরি হয়েছিল। এমনই ছিল সেই প্লাবন যে, মসজিদটা ভাঙার সময়টুকুর মধ্যেই নেতানেত্রীদের স্লোগান ও দর্শন বেমালুম পাল্টে গিয়েছিল। অযোধ্যার মসজিদ অভিমুখে যখন যাত্রা আয়োজন করছিলেন নেতারা, তখনও কিন্তু তাঁরা মসজিদ ‘ভাঙা’র কথা বলেননি, অন্তত প্রকাশ্যে বলেননি। জনতার রাশভাঙা উন্মত্ততাই বদলে দিয়েছিল তাঁদের স্লোগান, অন্তত দৃশ্যত। ‘এক ধাক্কা অউর দো বাবরি মসজিদ তোড় দো’— জনাবেগের এক নতুন রাজনীতি তৈরি করেছিল। সেই রাজনীতি একটা সমে পৌঁছল এই ৯/১১’য়। প্রমাণপত্র, দলিল দস্তাবেজ, অধিকার অনধিকারের গল্প শুনতে শুনতে আমরা হয়তো ভুলে যেতে বসেছি যে, রামজন্মভূমির ‘রাম’ ও তাঁর ‘জন্মভূমি’ নিয়ে এত রকম পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও ব্যবহারিক অসঙ্গতি যে শেষ পর্যন্ত অযোধ্যার ওই বিবাদ আসলে দাঁড়িয়ে থাকে জমি-সংক্রান্ত কতগুলো রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার উপরই।
এই যেমন, এই মামলায় একটি যুক্তি সম্ভবত সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের বিপক্ষে গিয়েছে। তাঁরা এই জমির উপর ‘পজ়েসরি কনট্রোল’— বলতে পারি, ‘দখলের নিয়ন্ত্রণ’— দেখাতে পারেননি। অর্থাৎ জমিটি যে তাঁদেরই, ‘এক্সক্লুসিভ’ ভাবে, অর্থাৎ অন্য কোনও দাবিবিহীন ভাবে, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারেননি। বিচারের নীতি ও যুক্তি নিশ্চয়ই এখানে যথাযথ। কিন্তু তার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: ইতিহাস ও সেই ইতিহাসে নিহিত ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটি এখানে যথাযথ বিবেচনা পেল তো? কেন যে সুন্নি বোর্ড কখনও সার্বিক নিয়ন্ত্রণ জারির চেষ্টা করেননি, তার উত্তর তো এই জমির বিতর্কেই ধরা আছে। বরং পাঁচশো বছর ধরে যে একটা ধারাবাহিক সমন্বয়ের চেষ্টা চলেছে, তার নানা ভাঙাচোরা প্রমাণও নেই কি? তা হলে? তা হলে কি ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে, সার্বিক নিয়ন্ত্রণ জারি না করারই দাম আজ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দিতে হচ্ছে? হিন্দু-মুসলমান-শিখ-পারসিক যে পক্ষের কাছেই এই রায় পৌঁছক না কেন, তারা এর থেকে ধরে নেবে না তো যে— অতঃপর নতুন ভারতে দখল ও নিয়ন্ত্রণই হল জয়ের প্রকৃত চাবিকাঠি? সেই কাঠিটি থাকলেই সব দরজা একে একে বিকচকমলদলের মতো খুলে যাবে? অর্থাৎ, শেষ অবধি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পথে এগোনোর দাবি, এটাই হল ‘জয়’-এর পথ— বাকি সব মায়া-মরীচিকা?
শুনানির সময়ে বার বার উঠেছে একটি কথা: এই মসজিদে তো কত দিন ধরে নমাজ পড়াই হয়নি! তা হলে আবার এই মসজিদ ‘মসজিদ’ হয় কী করে? কিন্তু যে মসজিদকে আমরা নাম দিয়েই ফেলেছি ‘বিতর্কিত কাঠামো’, সেখানে একটা উল্টো কথাও নেই কি? কোনও হইচই ছাড়াই বিতর্কিত মসজিদে যে সুদীর্ঘ কাল নমাজ পড়া হয়নি, তার পিছনে হয়তো একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশা ছিল, হয়তো একটা আইন-মান্যতার বোধ ছিল? একটি প্রাচীন মসজিদে যে গায়ের জোর দেখিয়ে নমাজ পড়া হচ্ছে না, একটা ঐতিহাসিক সৌধ হয়েই একা একা দাঁড়িয়ে আছে— এমন তো আমরা হামেশাই দেখে থাকি ভারতবর্ষ পরিক্রমা করতে করতে। তা হলে কি এটা আর নতুন ভারতে সম্ভব/ঠিক নয়? মসজিদে নমাজ পড়া পক্ষ আজ ভাবতে বসবেন না তো যে, কৌশলের দিক দিয়ে বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে, জোর না দেখানোর ভুল? ‘জোরের রাজনীতি’কে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দখল নিতে দেওয়ার ভুল?
মুন্নু মিঞারা তো জানেন, ওখানে এক কালে নমাজ পড়া হত। আশিস নন্দীর বইতে (একজ়াইলড অ্যাট হোম, অক্সফোর্ড) মুন্নু মিঞার কথা পড়েছি আমরা। তাঁর জন্ম ১৯০৭-৮ সালে, তিনি অযোধ্যার ওই চত্বরের আজন্ম বাসিন্দা, রামের মন্দির বানিয়েছেন নিজে হাতে, সেই মন্দিরে ম্যানেজার হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। অধ্যাপক নন্দীর কাছে তাঁর স্মৃতিচারণ: বাবরি মসজিদ চত্বরে কখনও কোনও ঝামেলা হয়নি— ১৯৩৪ সালে ছাড়া, কিন্তু সে বারও বাইরের লোকরা এসেই ঝামেলা পাকিয়েছিল। তিনি মনে করতে পারেন, আগে যখন ওখানে নমাজ পড়া হত, জুতো খুলে নমাজিরা মসজিদে ঢুকলে মন্দিরের বৈরাগীরা সেই জুতো পাহারা দিতেন। নমাজ পড়া শেষ হয়ে গেলে জুতো পরার জন্য তাঁরা ফিরতেন যখন, তাঁদের হাতে তুলে দিতেন মন্দিরের প্রসাদ। মুন্নু মিঞারা কি আর আছেন এখন? না থাকাই স্বাভাবিক। না থাকাই ভাল। প্রথমে যে বন্ধুর কথা উল্লেখ করেছি, তিনি মুসলিম অধ্যাপক— তাঁরা এখনও আছেন, থাকবেন। এই নতুন ভারতের হালচাল দেখে তাঁদের মতো লোকদের গভীর আঘাত লাগছে, ভয় করছে আজকাল।
তবে তাঁদের আঘাত বা ভয়ের রকমটাই বলে দেয়— কাশ্মীর থেকে অযোধ্যা— বড় মাপের ‘অশান্তি’র সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। নতুন ভারত ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখানে যা যা ঘটবে, তার সঙ্গে চুপচাপ একমত হওয়া খুব জরুরি। আপত্তি? বিরোধিতা? পরাজয়? এ সব তো ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’দের পরিচিত ভাষা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy