শুধু নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের যন্ত্রণা।
অটোর সামনের সিটে বসা মাঝবয়সী মহিলা আঙুল তুলে পিছনের আসনে বসা কিশোরী মেয়েকে বললেন—‘‘ওই যে দেখছো...এটাই সেই স্কুল!’’
মেয়েটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু এর আগে কোনও দিন আলাদা করে কলকাতার এই স্কুলটাকে দেখিনি। সে দিন দেখলাম। আর পাঁচটা দিনের মতোই স্কুল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় শান্ত মুখে হেঁটে যাচ্ছে ছাত্রীরা।
দশম শ্রেণির ছাত্রীর চলে যাওয়ার ঘটনা জানতে পারার রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। বাড়িতে থাকা দশ বছরের মেয়ের কথা মনে করে অসহায় বোধ করেছি। কলকাতার এই স্কুলের মেয়ের অকালে ঝরে যাওয়ায় ভেতরে ভেতরে নড়ে গিয়েছি কোথাও।
—অঙ্কের উত্তরপত্র দেওয়ার কথা ছিল। দিয়েছে?
—না দেয়নি।
—কবে দেবে?
—জানি না।
তার কিছুক্ষণ পরে মা মেয়ের সহপাঠীর এক জনকে ফোন করে জানতে পারেন দু’দিন আগেই অঙ্কের উত্তরপত্র স্কুল থেকে দিয়েছে। ‘‘খাতা তো দিয়েছে বাড়িতে দেখানোর জন্য। তুমি দাওনি কেন?’’—মায়ের প্রশ্ন। এর পরে মেয়ে কান্না ভেজা গলায় যা জানায়, তার সারমর্ম হল—অঙ্কে ভাল নম্বর পায়নি সে। বকাবকি করবে বলে সে অঙ্কের খাতা স্কুল থেকে এনে আলমারির মধ্যে রেখে দিয়েছিল। ভয়ে দেখাতে পারেনি।
এখন এই মেয়েকে কি কলকাতার ওই স্কুলে পড়া মেয়ের নামে ডাকা যেতে পারে! জানি না। যেমন জানি না স্কুলের অর্ধ-বার্ষিক বা বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ‘রিপোর্ট-কার্ড’ হাতে নিয়ে স্কুল চত্বরের মধ্যে প্রকাশ্যে অন্য সহপাঠীদের সামনেই চলে বাবা-মায়েদের বকাবকি। এমনকি চড়-থাপ্পড়ও বাদ যায় না। অথবা ‘তোর কিস্যু হবে না! এত টাকা খরচ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর চেয়ে পাড়ার বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার’ হুমকি শুনতে শুনতে স্কুল থেকে বাড়ির আসার পথটুকু তখন দীর্ঘ লাগে একরত্তি ছেলেমেয়ের। কুঁকড়ে যায় নিজের খোলসে। তখন কি কোথাও অভিমানের জমাট মেঘ জমা হয় বুকের ভেতর! খোঁজ নিই না আমরা, বাবা-মায়েরা।
নিজের মতো করে ভাল থাকা, নিজের মনের মতো করে মানুষ করার জন্য স্বেচ্ছায় ফ্ল্যাট-যাপন বেছে নেওয়া। সেখানে দাদু-ঠাকুমা-জেঠু-জেঠিমা-কাকু-কাকিমা-পিসি-দাদা-বোনের স্নেহ-ভালবাসা নেই। আছে শুধু নিঃসঙ্গতা। একাকিত্বের যন্ত্রণা। ওরা বাঁচুক, হেসে খেলে বেড়াক, মনের আনন্দে বড় হোক—এই ভাবনা আমাদের বড়দের মধ্যে কাজ করে না। ওদের থাকাটাই যে আমার-আপনার অহঙ্কার, এটা যেন বুঝেও বুঝি না। ওদের রেজাল্ট, ওদের গোল্ড-মেডেল, ওদের ফার্স্ট হওয়া অহঙ্কার নয়—আমরা আর কবে বুঝব। ওরা আমার-আপনার তুরুপের তাস নয়। ট্রাম্প কার্ড নয়, যে ‘শো’ করে ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি হাসব। করুক ফেল, না হোক ফার্স্ট, না জিতুক মেডেল, সাঁতার-টেবিল-টেনিস-ক্যারাটে না পারুক, গলায় সুর না থাক, নাচের মুদ্রা না আসুক, কিছু না পারুক, কিন্তু ওরা থাক। বেঁচে থাক। ভাল থাক। চোখের সামনে হেসে খেলে বেড়াক।
প্রজাপতির মতো।
কিন্তু এ ভাবে তো পারি না ভাবতে। কারণ, আলমারির মধ্যে ফাইলবন্দি নিজের নাচ, গান, সাঁতার, স্কুলের রিপোর্ট-কার্ডগুলো রয়েছে। খুলে দেখুন। তার পরে আয়নার সামনে দাঁড়ান। দেখুন তো লজ্জা পান কি না! তা হলে কেন এত আশা পুষছেন মনের মধ্যে ওই ছোট প্রাণগুলোর কাছে! ওদের থাকাটাই যে আপনার-আমার অস্তিত্বের, অহঙ্কারের, আনন্দের। এর বেশি আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। ওই নম্বর, মেডেল, রেজাল্ট ছেলেমেয়ের আগে কোনও দিন ছিল না, হবেও না— বোঝার সময় এসেছে এ বার আমাদের বাবা-মায়েদের।
কলকাতার মেয়েটা দেখিয়ে দিয়ে গেল আজকের মা-বাবাদের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে তাদের মানসিক দূরত্ব কতটা! কতটা অনতিক্রম্য! বড় মুখ করে সন্তানের সাফল্য বলে বেড়াতে যতটা আনন্দ পান, ততটাই বাড়িতে বিষণ্ণ পরিবেশ, অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন সন্তানের সাফল্যে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলে। আমরা বা আমাদের প্রজন্ম, তার আগের আগের কোনও প্রজন্মের মধ্যে এই মানসিক চাপ বা উদ্বেগ ছিল না। অনেক কিছু না পাওয়ার মধ্যে দিয়েই তো আমরা বড় হয়েছি অথচ তেমন অভিমান তো হয়নি কখনও! পড়াশোনা ভাল করে করতে হবে। বড় হতে হবে— এইটুকুই শুধু গল্পে-গল্পে রক্তে জারিত করতেন বাবা-মা।
স্কুলে কোনও দিন ফার্স্ট হইনি। কারণ অঙ্ক। অঙ্ক ভীতি থেকে অঙ্ক না করার ইচ্ছে আর তার ফলে প্রথম সারির দৌড়ে পিছিয়েছি। থার্ড, ফোর্থ এমনকি এইটথও হয়েছি। মনখারাপ হত। কিন্তু পিঠে হাত রাখার জন্য হাতও পেয়েছিলাম। সেই হাত মাথায় পিঠে হাত রেখে বলত—‘চল খেয়ে নিবি।’ আজ বোধহয় বাবা-মায়েরা সে রকম আর বলেন না। প্রেস্টিজ ইস্যু।
সারাদিন ঘাড় গুঁজে পড়ছে সন্তান। দৌড়চ্ছে এক কোচিং থেকে আরেক কোচিং। রাস্তাতেই রোল খেয়ে নেওয়া! কচি মুখগুলোয় হাসির মধ্যেও জড়িয়ে থাকে ক্লান্তি। এই ক্লান্তিটুকু আমরা দেখেও দেখি না। আমরা গল্প করি বাচ্চাদের সঙ্গে। কিন্তু সে তো লেখাপড়া সংক্রান্ত। সেখানে মেঘ দেখা নেই! বৃষ্টিতে ভেজা নেই! পাখি দেখা নেই! আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হারিয়ে যাওয়া নেই! তা হলে মন? মনের খাদ্য? শুশ্রূষা? নেই। রোবটের জীবন। বড্ড যান্ত্রিক। বড্ড যন্ত্রণার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy