Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
marriage

‘বি এ পাশ, গৃহকর্মে নিপুণা’

ভারতে মেয়েদের শ্রমের বাজারে যোগদানের হার বাড়ছে না, বরং কমছে। কেন এমন হচ্ছে?

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২২ ০৫:০৭
Share: Save:

ভয়ে থাকেন এক অধ্যাপক, প্রতি অঘ্রান-ফাল্গুনে। তিনি রিসার্চ গাইড, বিজ্ঞানে গবেষণারত পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁর কাজ। ছাত্রীরা এই দু’মাস ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলেও ভয়ে ভয়ে দিন গোনেন— ফিরবে তো তারা! গ্রান্ট পাওয়া পেপারগুলোর কী হবে? ছাঁদনাতলাতেই কি তা হলে বিজ্ঞানসাধনার যাত্রা শেষ হবে?

স্বল্পশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের মাঝপথে পড়া বন্ধ করে বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে, সে খবর কতই বেরোয়। কিন্তু যে মেয়েরা এমফিল, এমবিএ, এমবিবিএস-এর মতো দীর্ঘ পাঠ্যক্রমের পড়া শুরু করেও শেষ করে না, কিংবা ডিগ্রি পেয়েও পেশায় প্রবেশ করে না, শুরু করেও ছেড়ে দেয়, তাদের নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা নেই। কেন এই উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা কর্মবিমুখ, সে অনুসন্ধান হয় না।

হাই স্কুলে পড়ান, এমন কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা বোধ হয় নেই যিনি সম্ভাবনার অকালমৃত্যু প্রত্যক্ষ না করেছেন। তাঁদের কোনও ছাত্রী স্কুলশিক্ষিকার পাকা চাকরি ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। কেউ হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হওয়ার কৃতিত্বের পরেও কাজ ছেড়ে সংসার-সন্তান পালন করছেন। একের পর এক মেধাবী মেয়ের পেশার ঘরে লেখা হচ্ছে, ‘হাউসওয়াইফ’। সে মেয়ের তো কলেজে পড়ানোর কথা ছিল। হাসপাতালে রোগী দেখার কথা ছিল। সে সব প্রতিশ্রুতি স্রেফ কথার কথা হয়ে রয়ে যায়।

হতে পারে, এখনও অনেক অভিভাবক মেয়ের একটা ‘ভাল বিয়ে’ দিতেই তাকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলেন। খরচ করেন, যাতে পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট তার বিয়ের যোগ্যতা প্রমাণ করে। কাজের বাজার সেখানে তাঁর লক্ষ্য নয়, তাঁর কাছে প্রাধান্য পায় বিয়ের বাজার। কিন্তু মেয়েটি? তার কি স্বাধীন সত্তা নেই, নেই নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জেদ, লড়াই করে জিতে নেওয়ার মানসিকতা?

অনেক মেয়ের মধ্যে তা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার বাড়লেও কাজের বাজারে তাদের উপস্থিতি বাড়ছে না। অসরকারি সংস্থা ‘সিএমআইই’-র বিশ্লেষণ, ২০১৮-১৯ সালে ভারতে সদ্য-গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ শতাংশ) ছিল মেয়ে। কিন্তু শহরবাসী পুরুষদের সত্তর শতাংশেরও বেশি যেখানে কাজের বাজারে অংশগ্রহণ করেছিল, সেখানে শহরবাসী মেয়েদের মাত্র কুড়ি শতাংশ যুক্ত ছিল কোনও না কোনও কাজে।

ভারতে মেয়েদের শ্রমের বাজারে যোগদানের হার বাড়ছে না, বরং কমছে। কেন এমন হচ্ছে? ওই সংস্থার মতে, তার সম্ভাব্য কারণ তিনটে। এক, মেয়েরা কাজ করতে আগ্রহী নয়। দুই, মেয়েরা চাইলেও পরিবার তাদের কাজে যোগ দিতে দিচ্ছে না। আর তিন, মেয়েদের নিয়োগ করতে চায় না কর্মক্ষেত্রের কর্তারা। অভিজ্ঞতা বলে, এই তিনটে সম্ভাবনার প্রতিটিই বাস্তব। বহু কাজকে ‘মেয়েদের উপযুক্ত কাজ’ বলে মনে করা হয় না, মেয়েদের নিয়োগই হয় না। আবার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, অথবা সেখানে যাওয়া-আসার পরিবেশ এতই প্রতিকূল যে, নেহাত বাধ্য না হলে বহু মেয়ে তা সহ্য করতে চায় না।

পরিবারও মেয়েদের কাজের অন্তরায়— বিয়ের পর এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যে, মেয়েটি পড়াশোনা বা কাজে ইতি টেনে দিতে বাধ্য হয়। তারই সহপাঠী, বন্ধুরা এগিয়ে যায় কাজে, কেরিয়ারে, গৃহবধূ মেয়েটি নিজেকে বলে, “কিন্তু আমি ঘরে না থাকলে কেমো-চলা শাশুড়িকে খাওয়াত কে, কে স্বামী-ছেলের টিফিন গুছিয়ে দিত?” গৃহস্থালির কাজের গুরুত্ব কিছু কম নয়, প্রতিটি মানুষেরই জীবনের কেন্দ্রে তার ঘর-পরিবার। সেখানে লালন-পালন, যত্ন-পরিচর্যার প্রয়োজন আছে অবশ্যই। কিন্তু সেটাকে ‘নারীধর্ম’ বলে নির্দিষ্ট করার মধ্যে যে ভুলটা আছে, বহু মেয়ে তা নিজের কাছেও স্বীকার করে না। বরং এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনাকেই তারা আঁকড়ে ধরে। স্বামী-পুত্রের সম্মানের প্রতিফলনে আত্মগৌরব খোঁজে। “বর নীল বাতি লাগানো গাড়ি থেকে নামবে, এই ডিগনিটির জন্য সব ছেড়ে এসেছি জানেন?” ভূগোলের প্রাক্তন মহিলা গেস্ট লেকচারার বললেন। সামান্য টিপের পাতা, সেফটিপিন কেনার জন্য বরের কাছে হাত পাততে তাঁর লজ্জা নেই, কারণ তাঁরই তো স্বামী।

যে কোনও দাম্পত্যে একের রোজগারে অন্যের ভাগ আছে, কিন্তু সব স্বামী কি তা স্বীকার করেন? যখন করেন না, দুর্ব্যবহার করেন, তখনও মেয়েটির উপায় থাকে না। সে যে স্বামী-নির্ভরতার মধ্যে সম্মান খুঁজেছে, আত্মনির্ভরতা তার কাছে পরাজয় মনে হতে থাকে। তাই মেয়েদের কাজ খোঁজায়
এত অনিচ্ছা। আর ইচ্ছা থাকলেও বড় বাধা— গৃহকর্মের বোঝা। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবার গজিয়ে ওঠার ফলে ঘরের কাজের দায়ভার পুরোটাই কাঁধে এসে পড়ছে মেয়েদের। টাকা দেব, বাকিটা বুঝে নাও— অধিকাংশ পরিবারে এই হল পুরুষের ভাষণ।

অন্য দিকে, মেয়েদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য যা কিছু উপযুক্ত ব্যবস্থা— হস্টেল বা আবাসন, শিশুদের দিবাযত্নের কেন্দ্র, পর্যাপ্ত ও নিরাপদ যানবাহন, কিছুই জোগাতে নারাজ বাজার কিংবা রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বলে, আইন তো করেছি, আবার কী করব? নিয়োগকর্তা বলেন, আইন থাকলেই করতে হবে? এই ব্যবস্থায় পারলে কাজ করো, নইলে কোরো না।

এ ভাবেই নষ্ট হয় দেশের মেধাসম্পদ। শিক্ষিত মেয়ের বিদ্যা, দক্ষতা, শ্রম বয়ে যায় রান্নাঘরের
নালি দিয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy