ওয়েল ডান মোদীজি’! গত সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কংগ্রেসের এমন বাহবা এই প্রথম। কী কারণ? প্রধানমন্ত্রী সিবিএসই-র দশম শ্রেণির পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সেটা ছিল এপ্রিলের ঘটনা। এ বার জুন মাস পড়তেই প্রধানমন্ত্রী সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেন। বাতিল হল আইএসসি-র পরীক্ষাও। কংগ্রেস কী বলল? বলল, আমরা খুশি যে মোদী সরকার অবশেষে দেশের মানুষ, তার সঙ্গে রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর দাবি মেনে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর পরেই একে একে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁদেরও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষা বাতিলের কথা ঘোষণা করতে শুরু করলেন। বিজেপি, কংগ্রেস, অ-কংগ্রেস, কেউ বাদ গেলেন না। এমনিতে রোজ সকাল হলেই রাহুল গাঁধী টুইট করে নরেন্দ্র মোদীকে কোনও না কোনও বিষয়ে খোঁচা দেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে তো মোদী সরকারের খটাখটি লেগেই রয়েছে। আজ ইয়াস, কাল মুখ্যসচিব, পরশু রাজ্যপাল, তরশু সিবিআই-ইডি। কিন্তু পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে দেখা গেল, সব নেতানেত্রীই এক মত। সকলেই পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়ার সহজ পন্থা নিয়ে বাহবা কুড়োতে ব্যস্ত। মোদীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস কৃতিত্ব নিল, রাহুলই তো এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মোদী-শিবিরও কম যায় না। নেট-দুনিয়ায় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা ‘ধন্যবাদ মোদী স্যর’ জানালেন। পরীক্ষা বাতিলের জন্য সকলে কৃতজ্ঞ। তার পরে জানা গেল, পড়ুয়াদের দিয়ে ধন্যবাদ দেওয়াতে হবে বলে ‘কেন্দ্রীয় সরকারি’ নির্দেশ গিয়েছিল।
রাজনীতির বাজারে এক-এক সময় এক-এক রকম জনমোহিনী রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে। কখনও রঙিন টিভি বিলি, তো কখনও সাইকেল বিলি। কখনও সস্তায় চাল-গমের আশ্বাস, কখনও চাষিদের ঋণ মকুব। কোভিড-জমানায় এত দিন ছিল বিধানসভা ভোটে জিতলে বিনামূল্যে টিকার আশ্বাস। কোনও রাজনৈতিক দলই এর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। এ বার পড়ুয়াদের জন্য উদ্বেগ দেখিয়ে পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়ার দাবি তোলা বা পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়াটাও নতুন ‘জনমোহিনী রাজনীতি’ হয়ে উঠল। কেউই এই জনগণের মন জয়ের সহজ সুযোগ ছাড়তে নারাজ। কেরলের বাম সরকার কোভিডের ধাক্কা সত্ত্বেও এপ্রিল-মে মাসে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আয়োজন করেছে। কোভিডের সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি পালন করে। কিন্তু কেরলের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই, নিয়ম নয়। বাকি প্রায় সকলেই পরীক্ষা বাতিলের দলে।
কোভিডের আশঙ্কা উপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়া উচিত ছিল কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা প্রায় এক সুরেই বলেছেন, পরীক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকেই তাঁরা সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে বাতিল করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে কি দেশের রাজনৈতিক নেতা আগেভাগে চিন্তাভাবনা করতে পারতেন না?
নরেন্দ্র মোদীর দিকে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বিরোধীদের নালিশ, করোনাভাইরাস ফের ধাক্কা দেবে জেনেও প্রধানমন্ত্রী আগে থেকে প্রস্তুতি নেননি। একই যুক্তিতে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে, সে কথাও আগেভাগে ভাবার কথা, তা হয়নি কেন? কেন বিরোধীরা এ প্রশ্ন তুলছেন না? কারণ, তুলতে গেলে বিরোধী শাসিত রাজ্যের দিকেও দায় চলে আসবে।
সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়। নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র কেন্দ্রের অধীন সিবিএসই-র পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যের বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা নিয়েছেন। কেন্দ্র-রাজ্য, দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, পড়ুয়াদের মূল্যায়ন কী ভাবে হবে, দশম, একাদশ, প্রি-বোর্ডের পরীক্ষার নম্বরকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা পরীক্ষা বাতিলের পরে আলোচনা হচ্ছে। অর্থাৎ, কোভিডের জেরে পরীক্ষা বাতিল করতে হলে বিকল্প কী হবে, সেটাও কেউ আগেভাগে ভেবে রাখেননি, পরীক্ষা নেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনাচিন্তা তো দূরের কথা।
রাজনেতারা একটা বিষয় ভাবছেন না, বা ভাবলেও বলছেন না। তা হল, এই পড়ুয়ারা পরীক্ষা না দিয়েই স্কুলের গণ্ডি উতরে গিয়েছেন— ভবিষ্যতে এ ভাবেই সরলীকরণ করা হবে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোক বা চাকরি, সর্বত্র যাচাই হয়। সেই পরীক্ষা না দিয়েই পাশ করে গেলে সারা জীবনে কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তা আর কেউ না জানুক, এই রাজ্যে যাঁরা সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন, তাঁরা জানেন। পরবর্তী জীবনে চাকরি খুঁজতে গেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেটে নকশাল আন্দোলনের বছর দেখে তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে কোভিডের বছরে উচ্চ মাধ্যমিক, সিবিএসই, আইএসসি পাশ করা ছেলেমেয়েদেরও একই বৈষম্যের মুখে পড়তে হবে না তো!
গোটা দেশে বছরে কত জন দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেন? বছর তিনেক আগের অনুমান অনুযায়ী, প্রায় দেড় কোটি। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ কোটি। কোভিডের মধ্যেও ১৮ কোটি ভোটারের জন্য ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা গেলে, দেড় কোটি পড়ুয়ার জন্য পরীক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কি ভাবা যেত না? না কি এই পড়ুয়াদেরও আসলে ভবিষ্যতের ভোটার ভেবে রাজনেতারা তাদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন?
২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল তরুণ প্রজন্মের ভোট। ২০১৯-এ লোকসভা ভোটের সময় ১৩ কোটি নতুন ভোটার ছিলেন। ২০২৪-এও এই নতুন ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক শক্তি। অর্থনীতির করুণ অবস্থা, বেকারত্ব, কাজের সুযোগ কমতে থাকা নিয়ে যে এই প্রজন্মেরই দুশ্চিন্তা সবথেকে বেশি। সবই নেহরুর দোষ বা বাম জমানার ভুল বলে এই প্রজন্মকে বোঝানো কঠিন। তাই পরীক্ষা বাতিল করে কি সব দলই নতুন ভোটারদের ‘ফিল গুড’ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করল?
গত এপ্রিলে কোভিডের প্রথম ধাক্কার পরেই ইউনেস্কো ৮৪টি দেশে সমীক্ষা করে জানিয়েছিল, ৫৮টি দেশ স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরীক্ষা স্থগিত রেখেছে বা সূচি বদলেছে। ২৩টি দেশ পরীক্ষা নেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা করেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরীক্ষার গুরুত্ব বুঝে ২২টি দেশ পরীক্ষা নিয়েছে। মাত্র ১১টি দেশ পুরোপুরি পরীক্ষা বাতিল করেছে। জার্মানিতে যেমন কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে, পরীক্ষার্থীদের দূরে দূরে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এ বছরও এক-এক দেশ এক-এক রকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ দেশেও কেরলে এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব, স্যানিটাইজ়ার, স্কুলে ঢোকার আগে তাপমাত্রা মাপা হয়েছে। কারও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হলে আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের সামনে যে বিকল্প প্রস্তাব ছিল না, তা নয়। সিবিএসই-রই প্রস্তাব ছিল, ২০টি প্রধান বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হোক। পড়ুয়াদের নিজের স্কুলেই পরীক্ষা হোক। তিন ঘণ্টার বদলে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা, ‘মাল্টিপল চয়েস’ প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রস্তাবও ছিল। জুলাই-অগস্টে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ স্তিমিত হয়ে এলে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাবও ছিল। এগুলি সঠিক বিকল্প কি না, তাতে ঝুঁকি ছিল কি না, তা অন্য প্রশ্ন। রাজনীতির বিচার্য হল, এতে সহজে হাততালি কুড়োনো যেত না।
জনমোহিনী রাজনীতির নিয়মই হল, মানুষকে তলিয়ে ভাবতে না দিয়ে সামনে ‘খুড়োর কল’ ঝুলিয়ে দেওয়া। মানুষ ভাবতে শুরু করেন, এটাই মোক্ষ। মোহ কেটে গেলে বোঝা যায়, আসলে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। যে নতুন ভোটারদের হাততালি কুড়োতে আজ রাজনীতিকরা চোখ বুজে পরীক্ষা বাতিল করছেন, যাঁরা আজ ‘ধন্যবাদ মোদী স্যর’ বলছেন, কাল তাঁরাই রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে হোঁচট খেলে কাকে দোষ দেবেন? রাজনীতিকরা কি তখন কাঠগড়ায় উঠবেন?
সে গুড়ে বালি! তখন রাজনীতির কারবারিরা ঝোলা থেকে নতুন জনমোহিনী রাজনীতি বার করে আনবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy