কিছু দিন ধরে মনটা বিচলিত হয়ে রয়েছে। আর জি কর কাণ্ডের ন্যায় বিচার তো নিশ্চয়ই চাই, চাই ডাক্তারদের নিরাপত্তা, জনমুখী ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মেয়েরা রাত-দিন রাস্তা ও কর্মক্ষেত্র ‘দখল’ করুক, অবশ্যই চাই। আর চাইতে গেলে যে রাস্তায় নামতে হয়, তা জানতাম। এ-ও জানতাম যে, দলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকলে এই চাওয়াগুলি বিশ্বাসযোগ্য হবে না। সমাজকর্মী হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বলার চেষ্টা করেছি যে, সমাজ, দেশ ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেই তৈরি হচ্ছে। দেশের অন্য অনেক প্রান্তে তা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে দলীয় রাজনীতিতে মজে থাকা ‘এলিট’ সমাজ তা দেখতে পায়নি। ‘বিচার চাই’ আন্দোলন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
তা হলে অস্বস্তি কেন? কারণ, ন্যায় বিচার চাওয়া আর তা ন্যায়ের পথে চাওয়া, একই বিষয় নয়। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে আন্দোলনের প্রথম ও সর্ববৃহৎ পর্যায়ে ন্যায়ের পথটি স্পষ্ট ছিল। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, অহিংস, শান্তিপূর্ণ। সমাজের বহু বর্গের মানুষের কণ্ঠস্বরে সত্যিই তা গণ-সত্যাগ্রহের চেহারা নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলের প্রতিপালিত লোকেরা ছাড়া শহরাঞ্চলে প্রায় সব বর্গের মানুষ শামিল হয়েছিলেন সেই আন্দোলনে।
তবু তখনও অস্বস্তি ছিল। কলকাতা এবং মফস্সল শহরগুলি বাদ দিলে গ্রামে এই আন্দোলনের বিশেষ প্রভাব ছিল না। সমাজের যে অংশটি প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরশীল, তাঁরা কেন এই আন্দোলনে ছিলেন না? তাঁরাই তো দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার সবচেয়ে বড় শিকার। বরং শহরে, মফস্সলে সমাজের যে অংশটা আন্দোলনে সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা নিল, তার একটা বড় অংশ সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরশীল নয়। আমরা জানি যে, কলকাতায় ঘটে-যাওয়া বিষয় নিয়ে গ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নজির সাধারণত দেখা যায় না। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন তৈরি হয় ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকে। গ্রামে সামুদায়িক প্রভাব বেশি, সমুদয় একটা সংগঠন হিসাবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, শহর যে-ভাবে নাগরিকতার ধারণা তৈরি করে, তার মূলে থাকে অজানা-অচেনা মানুষের জন্য গণতান্ত্রিক আবেগ। গ্রামে সামুদায়িক আবেগ সাধারণত সামুদায়িক অস্তিত্ব থেকে তৈরি হয়। তবু বিশ্বাস করেছিলাম যে গ্রামের মানুষরা এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও, মনেপ্রাণে সঙ্গেই আছেন।
কিন্তু আন্দোলনের একটা পর্যায়ে এসে অস্বস্তি বেড়ে গেল, যখন আন্দোলনটা ‘পুজো বনাম প্রতিবাদ’ হয়ে গেল। আন্দোলনকে পুজোর বিপরীতে উপস্থাপন করা হল। পুজোয় ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়, অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ মানুষ রোজগার করেন। পুজোর সঙ্গে কয়েক কোটি মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক আবেগও জড়িত। তাঁরা অনেকেই প্রতিবাদে শামিল কিন্তু পুজোর আনন্দ মাটি করতে চাননি। দ্রোহের আর ভাসানের কার্নিভাল দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, জনসমাজ কি পুজো আর প্রতিবাদের জাঁতাকলে পড়ে গিয়েছে? ভাসানের কার্নিভালের সঙ্গে আন্দোলনের কিসের প্রতিযোগিতা?
এর মধ্যে মেয়েদের চলাফেরায় ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নটা কোথায় গেল? আন্দোলনই তো চেয়েছিল সিবিআই তদন্ত হোক, এখন আন্দোলন হঠাৎ সিবিআই-বিরোধী হয়ে গেল কী করে? সিবিআই পছন্দের কথা বলছে না বলে? সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধানের উপর নজরদারির দায়িত্ব নেওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। এখন আন্দোলন সুপ্রিম কোর্টে সব ছেড়ে ছাত্র নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে কেন? ডাক্তারদের উকিল বললেন, দু’বছর ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি বলে আজ এই অবস্থা। আর এক উকিল বললেন, রাজ্য সরকার পরিকাঠামো সংস্কারের যে তথ্য দিচ্ছে তা সব মিথ্যা। দুটোর কোনওটাই গৃহীত হল না। হওয়ার কথাও নয়।
দ্রোহের কার্নিভালে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের গান শুনেও একটু অবাক হয়েছি। এটা ঠিক যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে কে কোন গান গাইছে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, করা উচিতও নয়। কিন্তু অস্বস্তিটা থেকেই যায়। তবে কি আন্দোলনের অন্তস্তলে কিছুটা হলেও দলীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে পড়েছে? দলের পতাকা নিয়ে এই আন্দোলনে ঢোকা যাবে না, দলীয় স্লোগানগুলিও দেওয়া যাবে না, তাই সুকৌশলে মমতা-তৃণমূল বনাম জনসমাজ— এই আন্দোলনে ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে?
অস্বস্তির শেষ কারণটি হল, মিডিয়া যতই হইচই করুক, আন্দোলনের বলয় ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। প্রথম পর্যায়ে যে ব্যাপক এবং বিবিধ সামাজিক বর্গ থেকে সাড়া এসেছিল, এখন তা সমাজের অভিজাত বর্গের— তাও কলকাতা ও অল্প কয়েকটি শহরতলি এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ এত বড় আন্দোলনকে একটা গণশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যেত, যদি সংগঠকরা আর একটু অদলীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ হতেন। ডাক্তারদের দশ দফা দাবি সরকারি ডাক্তারদের নিজস্ব, যদিও তাতে উপকৃত হবেন লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ। কিন্তু তা ব্যতীত, জনসমাজ থেকে সংশ্লিষ্ট দাবিগুলির একটাও দানা বাঁধল না।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, একটু থেমে, কিছুটা পর্যালোচনা ও আত্ম-বিশ্লেষণ করে আন্দোলনের পরের পর্যায়ে যাওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy