কোটি কোটি টাকা বিদেশি সাহায্য পাওয়ার পরেও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধির কোনও কর্মসূচিতেই সাফল্য পায়নি।
অস্থিরতা আফগানিস্তানে নতুন নয়। আফগানিস্তান পরিচিত বুলেটের শব্দ, বারুদের গন্ধের সঙ্গে। ইতিহাস ফিরে পড়লে এমন অস্থিরতার অসংখ্য উদাহরণ মিলবে। কিন্তু কেন বারবার নানা পক্ষের লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে কোনওমতে বেঁচে থাকতে হয় আফগানবাসীকে। কেন কয়েকদিন পর পরই মৃতদেহ স্তূপাকার হয়? তালিবান ফের আফগানিস্তানের মসনদে বসার পর আবারও কি নতুন কোনও অস্থিরতার দিকে যাত্রা করবে আফগানরা? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটা কি আবার নয়ের দশকের মতো গৃহযুদ্ধের চোরা পথে তলিয়ে যাবে? নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়ত এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাস এক নির্মম পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে। আশঙ্কা তৈরি হয় গৃহযুদ্ধের।
গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে আজকের আফগানিস্তান ও আটের দশকের আফগানিস্তানের মধ্যে কিছু মিল চোখে পড়ে। সে বারের মতো এ বারেও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে বিদেশি শক্তি। তালিবান ও আমেরিকার মধ্যে এক আপাত-অলিখিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যা আগেও হয়েছিল। আফগানিস্তানকে এখনও বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। একটি জটিল প্রশাসনিক কাঠামো সে দেশকে পরিচালনা করে। তাই আশঙ্কা, সহজে শান্তি ফিরবে না আফগানিস্তানে। ওই আটের দশকের মতোই।
কোটি কোটি টাকা বিদেশি সাহায্য পাওয়ার পরেও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধির কোনও কর্মসূচিতেই সাফল্য পায়নি। বারবার একটি অদক্ষ সরকার তৈরি হয়েছে। যা আফগানিস্তানের মতো জাতিবৈচিত্র্যের দেশকে শত চেষ্টাতেও এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পারেনি। সেই কারণেই দেশজুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্র। কোথাও জাতিগত নেতা। কোথাও স্থানীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক নেতৃত্ব আবার কোথাও অন্য চরমপন্থী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী রাজনীতির মধ্যেই ২০১৪ সাল থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বিদেশি সাহায্যের ধারাবাহিক প্রবাহকে মারাত্মক ভাবে আঘাত করেছিল। সব মিলিয়ে, তালিবানের ক্ষমতা দখল ফের প্রমাণ করে যে, গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের নিজস্ব ক্ষমতা তৈরি হয়নি। প্রতিদিনই অন্য দেশের উপর আরও একটু নির্ভরশীল হয়েছে দেশ। তাই যে-ই সেনা সরেছে, টলে গিয়েছে প্রশাসন।
এই কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি ওয়াশিংটনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেছেন। আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী আফগান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সাহায্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা বজায় রাখারও প্রতিশ্রুতি দেন। তবে সেখানে সরাসরি সেনা পাঠানোর বিষয়ে সে বৈঠকে কিছু বলা হয়নি। এর আগে প্রায় দু’দশক ধরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সাহায্য পেয়েছে আফগানিস্তান। তাই হঠাৎ করে কোনও রকম বিদেশি সহায়তা ছাড়া আফগান সরকারের পক্ষে তালিবানদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করা সম্ভব হবে না— এ এক সহজ অঙ্ক। বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী উপস্থিত ছিল। তখনই সেই বাহিনীকে ঠিক করে ব্যবহার করতে পারেনি আফগান সরকার। সেই বাহিনী চলে গেলে একা হাতে পরিস্থিতি কী করে সামলাবে তারা? পাশাপাশি, বিদেশি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ আর্থিক সাহায্যের কথা বললেও তা পৌঁছয়নি আফগান সরকারের হাতে। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আবেদন করা অনুদানের ৪০ শতাংশেরও কম অর্থ পেয়েছিল আফগানিস্তান। সব মিলিয়ে আমেরিকা বা ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তই কার্যত তালিবানি অভুত্থ্যানের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।
আফগানিস্তানের শক্তি কাঠামো পশ্চিমের দেশগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। ২০০৩ সালে আফগান ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র তৃণমূল স্তরে পৌঁছতে পারেনি। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য বিদ্যমান, সেখানে গণতন্ত্রের বার্তা পৌঁছয়নি। বার্তা গ্রহণ করেননি তালিবান নেতারাও। কারণ, গণতন্ত্রের ধারণা আফগানদের কাছে একেবারে নতুন। শুরু থেকেই দেশটি বারবার বিকেন্দ্রীভূত হয়েছে। দেশে অনেক নৃ-গোষ্ঠী, প্রান্তিক শ্রেণি এবং অন্য স্থানীয় সম্প্রদায় রয়েছে। বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা শুরু থেকেই আফগানিস্তানের কেন্দ্রীভূত সরকারকে একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা ও অন্য সেবামূলক কাজকর্মের ক্ষেত্রেও আফগান মানুষরা ভিন্নজাতিগত গোষ্ঠী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের আনুগত্য দেখিয়ে এসেছেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রতিটি প্রদেশের ভূখণ্ডের মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর কারণ প্রধানত দু’টি। প্রথমত, কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি আঞ্চলিক শক্তির অনাস্থা এবং আফগানিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশে আঞ্চলিক নেতৃত্বের উত্থান। আবার কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি প্রাদেশিক জনগণের অনাস্থার প্রধান কারণ যোগাযোগের সমস্যা। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে দূরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়া এখনও সমস্যার। সেই কারণেই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলি দ্রুত বিচারব্যবস্থার বন্দোবস্ত করে থাকে। এটাই আদিম রীতি। তাই ছোট থেকে বড়, যে কোনও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হলে গ্রামের মানুষ আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলির কাছে বিচারের আবেদন জানান। এ ভাবেই গড়ে ওঠে সমান্তরাল শাসন। যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসনের দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, জাতির ভিত্তিতে আঞ্চলিক নেতৃত্বের উত্থান। যার প্রধান কারণ ধর্মীয় বিভেদ। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ জনগণই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তবু তাদের মধ্যে ভাগ রয়েছে। এর প্রধান দু’টি ভাগ হল শিয়া এবং সুন্নি। শিয়া মতে বিশ্বাসী প্রধান অংশগুলি হল হাজারা এবং তুর্কমেন জনগোষ্ঠী। অন্য দিকে, সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীগুলি হল পাস্তুন, তাজিক, বালোচ, উজবেক ইত্যাদি। যদিও শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের বিপক্ষে একাধিক সময়ে সক্ষম প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই জাতিগত ঐক্য (বা বিভেদ) কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে যে আনুগত্য প্রদর্শন করবে না, তা বলা বাহুল্য। নয়ের দশকের নাজিবুল্লাহ সরকারই হোক বা বর্তমান আফগান সরকার— উভয়েই কোনও প্রকার নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীকে কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে কোনওরকম রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা দেয়নি। সেই কারণে সুন্নি বা শিয়া গোষ্ঠীর লোকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার বদলে নিজ গোষ্ঠীর শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। তাতেই হয়েছে ঝামেলা।
কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে এই গোষ্ঠীগুলি নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে। কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে, কখনও সংঘর্ষ বেধেছে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গেও। কারণ, এক একটি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ এক একরকম। এই পৃথক পরিচয়ের খোঁজ ও কেন্দ্রীয় শাসনে ঐক্যের অভাবই বছরের পর বছর জন্ম দিয়েছে দ্বন্দ্বের, যা রূপ নিয়েছে গৃহযুদ্ধের। বর্তমান পরিস্থিতিতে তালিবান একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেও পঞ্জশেরের মতো বিভিন্ন প্রদেশে তালিবান বিরোধী গোষ্ঠীর উপস্থিতি যে গৃহযুদ্ধ ডেকে আনবে না তা, এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ তালিবানদের নিজেদের একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যেই একাধিক বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আপাত ভাবে তারা তালিবান বলে নিজেদের পরিচিত করলেও সময় যত গড়াবে, ততই এদের ভিতরকার দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকবে। ফলে, কেউ যদি ভাবেন তালিবান একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেই শান্তি ফিরবে আফগানিস্তানে, তা হয়ত হবে না। এখনও অনেক পথ চলা বাকি।
(লেখক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy