Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
সুযোগের সাম্য, সবার জন্য
jawaharlal nehru

দেশের উন্নতিতে সমান অধিকার, এই নীতিতে ছিল বিশ্বাস

ভারতীয় অর্থব্যবস্থার স্থবিরতার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, দেশ আটকে আছে তার জাতিব্যবস্থাজনিত চলমানতার অভাবে।

ভারতবর্ষ: নয়া দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭।

ভারতবর্ষ: নয়া দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২১ ০৪:৪০
Share: Save:

ভবিষ্যতের ভারতকে কেমন দেখতে চান, ১৯৫৩ সালে এই প্রশ্নের উত্তরে আগরার এক জনসভায় দাঁড়িয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, আমি চাই, ভারতের সব শিশু যেন জীবনে সফল হওয়ার সমান সুযোগ পায়। তার পর মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সমান সুযোগ পেলেই যে সবাই সমান সফল হবে, তা নয়— কিন্তু, রাষ্ট্রের তরফে যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়, কমপক্ষে সেটুকু নিশ্চিত করতে হবে।

সবার জন্য সুযোগের সাম্য তৈরি করা, নেহরুর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে এই কথাটা ছিল অনেক দিন ধরেই। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর পৌরোহিত্যে তৈরি হয়েছিল ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি— তার শীর্ষে জওহরলাল। দেশ স্বাধীন হলে অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হবে কোন অভিমুখে, তা স্থির করাই ছিল কমিটির মূল লক্ষ্য। কমিটির সদস্যদের এক চিঠিতে নেহরু জানিয়েছিলেন, লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে কোনও মানুষকে তার জীবনধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির সংস্থান করার জন্য ভাবতে না হয়। সেই দায়িত্ব নেবে স্বাধীন রাষ্ট্র। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের চিন্তামুক্ত মানুষ সুযোগ পাবে নিজের সাধ্যমতো উন্নতি করার।

স্বাধীনতার দিন যত এগিয়ে আসতে আরম্ভ করল, ততই স্পষ্ট হল একটা কথা— বহুধাবিভক্ত এই দেশটাকে, অথবা দেশ নামে যে ভৌগোলিক পরিধি তৈরি হচ্ছে, তার পরিসরে থাকা বহুবিধ জাতিকে— যদি এক সূত্রে বাঁধতে হয়, তবে নির্ভর করতে হবে এমন কোনও পরিচিতির উপর, যেটা এই বহুবিধ জাতিকে কোনও বিরোধের দ্বন্দ্ব-সম্পর্কের সামনে দাঁড় করাবে না। সেই পরিচিতি কী হতে পারত, তা নিয়ে মতদ্বৈধ থাকতে পারে— কিন্তু, নেহরু বেছেছিলেন উন্নয়নের পরিচিতিকে। এক অর্থে, জাতীয়তাবাদের এক কৃত্রিম সংজ্ঞা। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কোনও পরিচিতি নয়, তাঁর জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল একটিমাত্র জমির উপর— দেশের মানুষ যদি সত্যিই এই উন্নয়নের পরিচিতিতে, এবং সেই পরিচিতির একতায় বিশ্বাস করে, তবেই। ছত্রিশ কোটি মানুষের দেশ, যার একটা বড় অংশের অক্ষরজ্ঞান অবধি নেই— সেই দেশে কোনও আদিম পরিচিতির উপর ভিত্তি করে জাতীয়তার কথা বলা যতখানি সহজ, এমন একটা ‘কৃত্রিম’ ধারণাকে মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা ততখানি নয়। পাথর
ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তোলার সেই চেষ্টা করলেন নেহরু। কার্যত প্রতিটি জনসভায়, প্রতিটি ভাষণে।

সেই জাতীয়তার সূত্র ছিল ন্যায্যতা। দেশ যা উৎপাদন করবে, তা ন্যায্য ভাবে ভাগ করে নেওয়া। আর, সেই ন্যায্যতার সূত্র ছিল, সুযোগের সাম্য। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট মধ্যরাতের ভাষণে এসেছিল এই সাম্যের কথা— “ভারতের কাজ করা মানে সেই কোটি কোটি মানুষের কাজ করা, যাঁরা বহু শতাব্দী ধরে যন্ত্রণা সহ্য করে চলেছেন। ভারতের কাজ করা মানে দারিদ্র শেষ করা, অজ্ঞানতা মোচন, রোগব্যাধি দূর করা, এবং সুযোগের অসাম্য কমানো।” প্রায় এক দশক আগে, ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির সহকর্মীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে যে কথা বলেছিলেন জওহরলাল, স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে দেশের মানুষকেও জানালেন সে কথা।

‘সুযোগের সাম্য’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, নেহরু কী বোঝাতেন? ১৯৫৫ সালে এক আমেরিকান টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেহরু বলেছিলেন, “আমি মনে করি, সুযোগের অসাম্যের চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। ভারতে যে কোটি কোটি ছেলেমেয়ে, সুযোগ পেলে তাদের মধ্যে কত জন জিনিয়াস প্রমাণিত হবে, কত জন বিজ্ঞানী হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, বা অন্য কোনও দিকে সফল হবে, আমি জানি না। কিন্তু, এখন ওদের এই সুযোগটুকুই নেই।” যে কোটি কোটি সুযোগবঞ্চিত ছেলেমেয়ের কথা বলছেন নেহরু, তাদের সুযোগ না পাওয়ার অনেক রকম কারণ ছিল। কারও অর্থাভাব, কারও লিঙ্গ-পরিচিতি; কেউ বা তথাকথিত নিম্নবর্ণের পরিবারে জন্মানোর কারণে সুযোগবঞ্চিত। সেই বঞ্চনা তো শুধু অর্থবণ্টনে মিটবার নয়। অর্থাৎ, যার যতটুকু প্রয়োজন, ততখানি অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না— সামাজিক বাধাগুলোকে টপকানোর জন্য যাকে যতখানি এগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, রাষ্ট্রকে করতে হবে সেটাও।

১৯৫৪ সালে, গুজরাতের ভাবনগরের এক জনসভায় এই কথাটা তুলেছিলেন নেহরু। তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি হিন্দু সমাজ যে অন্যায় করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে। বলেছিলেন, যে স্বাধীনতা সবার কাছে পৌঁছয় না, সেই স্বাধীনতা অর্থহীন। “সমাজে যদি সবার সমান অধিকার না থাকে, তা হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসতে পারে না... আবারও আমি একই কথা বলছি, বিশেষত নিম্নবর্ণের মানুষ ও সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য দিতেই হবে।” জনতার দরবারে বারে বারেই অধিকার আর সাম্যের হাত-ধরাধরি করে চলার কথা বলেছেন নেহরু। কখনও বলেছেন, আবার কখনও বলেননি যে, অধিকার আর সুযোগের সাম্য আসলে সম্পূরক। একটা না থাকলে অন্যটাও থাকে না। নেহরু বিশ্বাস করতেন, ভারতের সামাজিক সমস্যাগুলো মূলত অর্থনৈতিক স্থবিরতার ফলে তৈরি হয়েছে— অর্থব্যবস্থা গতিশীল হলে, সেই উন্নতির ফল ন্যায্য ভাবে বণ্টিত হলে সামাজিক সমস্যাও বহুলাংশে দূর হবে। আবার, উন্নতির ফলের ন্যায্য বণ্টনের জন্য অধিকারের সাম্য চাই।

নেহরু যে ন্যায্যতার কথা বলছিলেন, তার পিছনে রয়েছে সামাজিক চলমানতার ধারণা। অর্থাৎ, জন্মগত অবস্থানে আটকে থাকা নয়, বরং নিজের ‘যোগ্যতা’র জোরে পৌঁছে যাওয়া উচ্চতর কোনও স্তরে। এই গতিশীলতার প্রশ্নটিকেই আম্বেডকর দেখেছিলেন ঠিক উল্টো দিক থেকে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার স্থবিরতার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, দেশ আটকে আছে তার জাতিব্যবস্থাজনিত চলমানতার অভাবে। যে লোক যে কাজের যোগ্য, জাতিব্যবস্থা যদি তাকে সেই কাজ করতে না দেয়, তা হলে অর্থব্যবস্থা উৎপাদনশীল হতে পারে না। তাঁদের সেই দর্শন দেশের গতিপথ নির্ধারণের উপর শেষ পর্যন্ত কী প্রভাব ফেলল, তা অন্য আলোচনা— কিন্তু, দেশকে এক সূত্রে বাঁধার জন্য নতুন যে জাতীয়তাবাদ নির্মিত হল, তার মূলে যে সামাজিক চলমানতার ধারণাটি থাকল, সে কথা অনস্বীকার্য।

এবং, এই ন্যায্যতার ধারণাটিই স্বাধীন ভারতের আদিপর্বকে আলাদা করে দেয় পরবর্তী যুগ থেকে, সমসময়ের অন্যান্য দেশ থেকেও। অর্থনৈতিক উৎপাদন বাড়ানোর দিকে, দ্রুততর আর্থিক বৃদ্ধির দিকে ঠিক ততটাই জোর দিয়েছিলেন নেহরু, তাঁর বহু পরের রাষ্ট্রনায়করা যতখানি জোর দেবেন। কিন্তু, সেই বৃদ্ধির তাৎপর্য তিনি বাঁধলেন বণ্টনের ন্যায্যতার তারেই। বললেন, উৎপাদন যদি না বাড়ে, তা হলে বণ্টনের জন্য পড়ে থাকে শুধুই দারিদ্র। সেই দারিদ্র বণ্টনে তাঁর আগ্রহ নেই। ১৯৩৯ সালে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে নেহরু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, উৎপাদন বৃদ্ধিকে কোনও মতেই বণ্টনের সাম্য থেকে বিযুক্ত করা যায় না। ১৯৪৮ সালে দেশের সংবিধানসভায় দাঁড়িয়েও বললেন একই কথা; ১৯৫৫ সালে অবাদী কংগ্রেসের সভাতেও। সাধারণ মানুষ কখনও দেশের উন্নতির থেকে বিচ্যুত হবেন না, এই বিশ্বাসটুকুর উপরই কি দাঁড়িয়ে ছিল না নতুন জাতীয়তাবাদের ধারণা?

দেশের উন্নতি ঘটলেই নিজেদের উন্নতি হবে, এই কথাটায় মানুষ ততখানি বিশ্বাস করেছিলেন কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু, নেহরুর বিশ্বাস ছিল যে, মানুষকে যদি মন থেকে জুড়ে নেওয়া যায়, তাঁরা একাত্ম হবেন এই উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে। স্যর চিন্তারাম দ্বারকানাথ দেশমুখ তখন দেশের অর্থমন্ত্রী— পঞ্চবার্ষিকী যোজনার জন্য ঋণপত্র মারফত সাধারণ মানুষের থেকে টাকা তোলার চিন্তা করছেন। নেহরু তাঁকে লিখেছিলেন, “নেহাত সুদের আকর্ষণে মানুষ টাকা দেবে না। বরং, যে ঋণপত্র বিলি করা হবে, তাতে যোজনার মাধ্যমে তৈরি হতে চলা প্রকল্পগুলোর ছবি দিন। অথবা, মানুষকে বলুন, তারা যে প্রকল্পটি চায়, তার জন্যই টাকা দিতে। মানুষ যদি জানে যে, তার টাকায় দেশ এগোচ্ছে, টাকা দিতে কেউ আপত্তি করবে না।”

অলীক বিশ্বাস? হয়তো। সবাই মিলে এক সঙ্গে এগোনোর মাধ্যমেই তৈরি হবে মানুষের আত্মপরিচয়, স্বাধীন ভারতের সাড়ে সাত দশক যেমন এই বিশ্বাসটাকেও ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে। কিন্তু তার পরও, সত্যিই যে কেউ এই বিশ্বাসটার উপর দাঁড়িয়েই দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, ভাবলে আশ্বস্ত লাগতে পারে। মনে হতে পারে, যুদ্ধের দামামা ছাড়াও দেশকে এক সূত্রে গাঁথার পথ আছে।

অন্য বিষয়গুলি:

jawaharlal nehru Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy