কাফ সিরাপ।
শিশুদের জন্য তৈরি চারটি কাশির ওষুধকে ‘ক্ষতিকর’ বলে সতর্কবার্তা জারি করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চারটিই তৈরি করে ভারতের একটি সংস্থা, হরিয়ানার ‘মেডেন ফার্মাসিউটিক্যালস’। সেগুলি বিক্রি হয় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়াতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, অবৈধ বাজারের সুযোগ নিয়ে আরও অনেক দেশে পৌঁছে যেতে পারে ওষুধগুলো। প্রমেথাজ়িন ওরাল সলিউশন, কোফেক্সম্যালিন বেবি কাফ সিরাপ, ম্যাকফ বেবি কাফ সিরাপ এবং মাগ্রিপ এন কোল্ড সিরাপ— এই চারটি ওষুধ ছেষট্টি জন শিশুর কিডনির ক্ষতি করে তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে, অভিযোগ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থার দাবি, চারটি ওষুধেরই নমুনা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাতে দু’টি রাসায়নিক যৌগ (ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং ইথিলিন গ্লাইকল) এমন মাত্রায় উপস্থিত যা গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্য পেটে ব্যথা, বমি, ডায়েরিয়া, প্রস্রাবে সমস্যা, মাথাব্যথা, মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ও কিডনির তীব্র ক্ষতি ঘটতে পারে, যার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ৫ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি জারির সময় পর্যন্ত ওই উৎপাদক সংস্থা ওষুধগুলোর নিরাপত্তা এবং গুণমানের ব্যাপারে কোনও তথ্য দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে।
মনে রাখা দরকার, বেশির ভাগ তরল কাশির সিরাপে দ্রাবক হিসেবে গ্লিসারিন ব্যবহার করা হয়, যাতে কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু অসাধু ওষুধ-উৎপাদকেরা মুনাফা বেশি রাখার জন্য গ্লিসারিনের পরিবর্তে উপরোক্ত ক্ষতিকারক পদার্থগুলো ব্যবহার করে। শিশুর জীবনের ঝুঁকিও তাদের প্রতিহত করতে পারে না। সংবাদে প্রকাশ, গাম্বিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভারতে তৈরি সর্দি-কাশির ওই সিরাপগুলি ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, এই ভারতীয় সংস্থার ওষুধের গুণমান অনেক দিন ধরেই প্রশ্নের মুখে। ২০১১ সালে বিহার সরকার এই সংস্থাটিকে নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে। ভারত সরকারের ‘এক্সটেন্ডেড লাইসেন্সিং, ল্যাবরেটরি অ্যান্ড লিগ্যাল নোড’ (এক্সএলএন)-এর তথ্য অনুযায়ী কেরল ও গুজরাট সরকার একাধিক বার এর বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা জারি করেছে। কেরল সরকার ২০০৫ সালে এদের বিরুদ্ধে মামলাও করে।
প্রশ্ন উঠবে, ভারতে ওষুধের গুণমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা, ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’ (সিডিএসসিও) কী করছে? ভারতে যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কার্যকলাপের উপর রাষ্ট্রের সদাসতর্ক দৃষ্টি রয়েছে, সে দেশে এত দিনের এত অভিযোগ সত্ত্বেও কী করে একটি সংস্থা অবাধে ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি করে যাচ্ছে, রফতানিও করছে? সিডিএসসিও জানিয়েছে, শিশুমৃত্যুর জন্য এই ওষুধগুলোই দায়ী, তা যত ক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত না হবে, তত ক্ষণ অবধি ওই সংস্থার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা যাবে না। প্রমাণ করতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেই। অর্থাৎ ওষুধের গুণমানের প্রমাণের দায় উৎপাদকের নয়, অভিযোগকারীর। প্রশ্ন উঠবে, রাষ্ট্রের এমন প্রশ্রয় কি সব উৎপাদকই সমান ভাবে পায়? না কি সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের পরিচয়ই আইনের শাসন আলগা করে? ‘জেনেরিক’ ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ‘বিশ্বের ঔষধাগার’ বলে পরিচয় তৈরি হয়েছে ভারতের। আফ্রিকায় শিশুমৃত্যু সেই ধারণা কলঙ্কিত করল।
অর্থ আর ক্ষমতা যে হাত ধরাধরি করে চলে, সে কথা অবশ্য সর্বত্রই সত্য। ১৯৯১-এর ১২ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন, মতামত চান। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারিতে এক পত্রিকা নোটটি প্রকাশ করে দেয় ‘লেট দেম ইট পলিউশন’ শিরোনামে। তার মোদ্দা কথা ছিল, ধনী বিশ্বের দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা ও অন্যান্য কম উন্নত দেশগুলোয় পাচার করতে হবে। সামার্সের যুক্তি, আমেরিকার মতো দেশে এক লক্ষ জনে এক জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের জন্য প্রস্টেট ক্যানসার হয়, তা হলেও এর গুরুত্ব আফ্রিকার মতো দেশগুলোর চেয়ে বেশি বলে ধরতে হবে, কারণ আফ্রিকায় শিশু মৃত্যুহার এমনিতেই অনেক বেশি। প্রসঙ্গত, এই সামার্স দেশের ট্রেজারি সেক্রেটারি ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
গাম্বিয়ার মতো দরিদ্র দেশে ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করার ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নেই। সেখানে স্বাস্থ্যের উপরে এমন আঘাতকে আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসক পল ফার্মার ‘কাঠামোগত হিংসা’ বলছেন। ভারতের ওষুধের ক্ষতি করার ক্ষমতা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্মোচিত না হত তা হলে শিশুমৃত্যুর ঘটনা, এমন আরও অনেক ঘটনার মতো, আমাদের কাছে অদৃশ্য ও অশ্রুত রয়ে যেত। অমর্ত্য সেন পল ফার্মারের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্যাথলজিস অব পাওয়ার’-এর ভূমিকায় লিখেছেন, “প্রতিরোধযোগ্য রোগকে যথার্থই প্রতিরোধ করা যায়, নিরাময়যোগ্য রোগকে নিরাময় করা যায়, এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাধিগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্তনাদ করে। প্রকৃতির বিরূপতার জন্য আক্ষেপ করার পরিবর্তে আমাদের সামাজিক অবস্থার ভীতিপ্রদ দিকগুলো ভাল করে বোঝা দরকার।” ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়ের সন্ধানে আগ্রহ কতটুকু? আর নজরদারি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy