Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
UGC

এই শিক্ষা ভাবতে শেখায়

‘বিজ্ঞানসম্মত’ শব্দের সামাজিক প্রয়োগ নিয়ে ভাবলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমরা শুধু বিজ্ঞানের পরিসরে এই শব্দ ব্যবহার করি না।

অর্ক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:০৬
Share: Save:

২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ এক চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে জানিয়েছে যে, কোর্সের চাহিদা অনুযায়ী কোন বিভাগে ক’জন শিক্ষক ও ছাত্র, তার এক হিসাব পেশ করতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, চাহিদা-জোগানের সমীকরণে বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্ব মাপা হলে মানববিদ্যা বা সমাজবিদ্যা বিভাগগুলির তবে কী হবে? ভাষাশিক্ষার বিভাগের অস্থায়ী চাকরিগুলো চলে যাবে? নতুন চাকরি হবে না? অথচ, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি জুড়ে যে ভাষাশিক্ষার বন্দনা!

সে বন্দনা আপাত-প্রায়োগিকতার। ‘ইংরেজি’ ভারতে সাহিত্য নয়, সাহেবদের ভাষাশিক্ষার প্রায়োগিক মাহাত্ম্য। অধিকাংশ লোকই মনে করেন, মানববিদ্যার জ্ঞান ‘বিশেষ’ নয়, ‘সাধারণ’— কারণ তা ‘টেকনিক্যাল’ নয়। যে বিদ্যা ‘প্রয়োগ’ করা যায় না, যে বিষয়ের জ্ঞান বিজ্ঞানপথে বৈধতা পেয়ে আসে না, তার আবার তাৎপর্য কী?

‘বিজ্ঞানসম্মত’ শব্দের সামাজিক প্রয়োগ নিয়ে ভাবলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমরা শুধু বিজ্ঞানের পরিসরে এই শব্দ ব্যবহার করি না। যে কোনও জানাকেই বৈধতা পেতে গেলে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ হয়ে উঠতে হয়। ডক্টরাল প্রোগ্রামে সারা পৃথিবী জুড়ে নানা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ‘সায়েন্টিফিক রাইটিং’-এর কোর্স করতে হয়। সেই কোর্স মানববিদ্যার গবেষকরাও করেন। প্রশ্ন হল ‘অ্যাকাডেমিক রাইটিং’ মাত্রেই কি ‘সায়েন্টিফিক রাইটিং’? লক্ষণীয়, ‘বিজ্ঞান’ শব্দটিকে এখানে ‘যুক্তিসঙ্গত’ অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতে গেলে যেন যে কোনও প্রতর্ককে বিজ্ঞানের পথেই যেতে হবে।

সমস্যা এখানেই যে, বিজ্ঞান অনেকগুলি সত্যবয়ানের একটি না হয়ে সামাজিক ভাবে স্বীকৃত সত্যবয়ানের একমাত্র পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে। এবং, মানববিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানের উৎকর্ষের মাপকাঠিও সেই পরিধি থেকে আসছে। তাই বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিবিদ্যার মতো এই চর্চাকেও ফান্ড-নির্ভর করে তোলা হচ্ছে। ইংরেজি ভাষার বিদ্যায়তনিক জার্নালে লেখা না ছাপালে তাই পড়াশোনার মূল্য নেই! এখান থেকেই হিউম্যানিটিজ়ের জ্ঞানের ‘প্রয়োগ’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার সূত্রেই প্রশ্ন উঠে যায়, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের নানা শাখা নিয়েও। ফিজ়িক্সের প্রয়োগ না থাকলে সে গবেষণার কী দরকার? অঙ্কেই বা কেন খুঁজব নতুনতর সমাধান? যত সমাজমননের চালিকাশক্তি হয়েছে প্রায়োগিকতা, ততই বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে না পৌঁছনোর সেতু না হয়ে নিজেই প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে।

আজকের দুনিয়ায় শিক্ষকরা ‘পণ্য জোগানদাতা’, ছাত্রছাত্রীরা ‘উপভোক্তা’। চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেমের লেখাপড়া অথবা কোনও কোর্সে ছাত্র কম হলে তা বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা তা-ই ইঙ্গিত করে। এখানে বাজারে কম গ্রহণযোগ্য কোর্সের দাম নেই। এই মডেলে পড়ুয়াদের স্বাধীনতা দেওয়ার একটা কৌশল দেখা যায়, যদিও তা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকেই সর্বতো ভাবে ক্ষমতাশালী করে তোলে। শিক্ষক অবসরের বয়সও বেড়ে যাচ্ছে— এ তাঁর মঙ্গলকামনা নয়, নতুন চাকরি না দেওয়ার চক্রান্ত। শিক্ষক বা ছাত্র— কারও মতই শেষাবধি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে না। বরং, সকলকেই ছিবড়ে করে ব্যবহার করে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক-ছাত্র দু’জনেই এক যন্ত্রের অসহায় কলকব্জা। এ যন্ত্র তাঁদের ছাড়া অচল, অথচ তাঁদের কথাও শোনে না। প্রতিবাদের পরিসরও কমে আসছে।

সুতরাং, জ্ঞানের প্রায়োগিকতাই যে তার গুরুত্বের একমাত্র মানদণ্ড নয়, সেটা সামাজিক ভাবে বুঝতে হবে। ‘প্রায়োগিক’ কথাটা নিয়েও ভাবা দরকার। মানববিদ্যা পড়ে আমরা সমাজ-দেশ-রাষ্ট্রনীতি শেখার চেষ্টা করব, বুঝতে চাইব লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদ— ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। জানব, বিদ্বেষ কী ভাবে চারিয়ে দেওয়া হয় সমাজে, সেই বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ার অভিসন্ধি বুঝতে গেলে সমাজযাপনের পাশাপাশি অধ্যয়নেরও প্রয়োজন আছে। এগুলো ‘প্রায়োগিক’ নয়, কিন্তু এতেই উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে জরুরি কথাটি শিখতে পারবেন পড়ুয়ারা: প্রশ্ন করার অধিকার। কখনও মনে হয়, তা চাপা দিতেই হয়তো ‘প্রয়োগ’ কথাটা এতখানি জরুরি করে তোলা হচ্ছে।

মানববিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞানের সঙ্কট তার দ্বন্দ্বমূলক প্র্যাকটিস চালিয়ে যাওয়ার জন্যেও জরুরি। সঙ্কট না থাকলে এ-ও যদি ক্ষমতার বশংবদ হয়ে ওঠে! চাদ ওয়েলমন এবং পল রেটর তাঁদের সাম্প্রতিক গ্রন্থে যাকে ‘পার্মানেন্ট ক্রাইসিস’ বলেছেন, তাকে জিইয়ে রাখাই এই বিদ্যাচর্চার কর্তব্য। এই সঙ্কট যদি স্থায়ী হয়, তবে চিন্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে সঙ্কট থেকে সাময়িক ভাবে বেরিয়ে আসার পথও দেখাবে এই বিদ্যাচর্চাই। তত্ত্ব ও প্রয়োগের ভ্রান্ত বিভেদ ভুলে অধ্যয়নই যথাযথ প্রয়োগ হয়ে উঠতে পারে তখন। জ্ঞান-প্রয়োগের এই দৃষ্টিভঙ্গি যে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানকেও সাহায্য করবে না, কে বলতে পারে?

মানববিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
আইআইটি গান্ধীনগর

অন্য বিষয়গুলি:

UGC Anthropology Education system
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE