Advertisement
০৯ জানুয়ারি ২০২৫
Protest Against Rape

কাকে বিশ্বাস করব তবে

ডমিনিক পেলিকোর নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গি বোঝায়, ধর্ষণই মূলধারা। ডমিনিক বলেছে, ‘আমরা জন্মবিকৃত নই, বিকৃত হয়ে উঠেছি।’ তার শান্ত বাচনভঙ্গি ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

শতাব্দী দাশ
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৮
Share: Save:

আমি ধর্ষক, উপস্থিত অন্যদের মতো।’ আলগোছে বসা, ভদ্রবেশী সত্তরোর্ধ্ব বক্তার মুখেচোখে সঙ্কটের বদলে উদাসীনতা। আপাতভাবে সে এ কথা বলছে, কারণ কক্ষে উপস্থিত আরও অন্তত পঞ্চাশ জন ধর্ষক। কিন্তু ডমিনিক পেলিকোর নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গি বোঝায়, ধর্ষণই মূলধারা। ডমিনিক বলেছে, ‘আমরা জন্মবিকৃত নই, বিকৃত হয়ে উঠেছি।’ তার শান্ত বাচনভঙ্গি ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

ডমিনিক পেলিকো গোটা দুনিয়া তোলপাড় করে দেওয়া উত্তাল দক্ষিণ ফ্রান্সের এক ধর্ষণের মামলার প্রধান অপরাধী। চূড়ান্ত রায় বেরোল গত ১৯ ডিসেম্বর। বিরানব্বইটি ধর্ষণের শিকার ডমিনিকের প্রাক্তন স্ত্রী, একাত্তর বছরের জিসেল পেলিকো। পঞ্চাশ বছরের স্ত্রী, তিন সন্তানের মা জিসেল পেলিকো-কে ধর্ষণ করছে ডমিনিক ও নানা পুরুষ। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বার বার। ওষুধ গুঁড়ো করে, রাতের খাবারে মিশিয়ে, তাঁকে অচেতন করা হত। ধর্ষকদের ডমিনিক পেত এক ওয়েবসাইট থেকে, সেখানে উদ্ভট যৌন ফ্যান্টাসি আলোচনা, ‘ডেট-রেপ ড্রাগ’ কেনাবেচা হত।

ওষুধের প্রকোপে বিস্মৃতি, ওজনহ্রাস আর কেশহ্রাস হচ্ছিল। ছেলে-মেয়ে মাকে ফোন করলে বাবাকে পেত। তারা সন্দেহ করছিল, মায়ের অ্যালঝাইমার’স হয়েছে। ডমিনিক ‘ক্লান্তি’ বলে উড়িয়ে দিয়ে, ডাক্তার দেখানো আটকাচ্ছিল। আঠারো বছর বয়স থেকে জীবনসঙ্গী ছিল যে, সেই বর-কেই বিশ্বাস করেছিলেন জিসেল। ডমিনিকের ল্যাপটপে মেয়ে ক্যারোলিনেরও দু’টি ছবি ছিল— অন্তর্বাস পরিহিত, ঘুমন্ত। মেয়েকে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি, ডমিনিক স্বীকারও করেনি।

ডমিনিক-সহ অনেকের সে দেশের সর্বোচ্চ সাজা, কুড়ি বছর জেল, হয়েছে। জিসেল ডমিনিককে ডিভোর্সও দিয়েছেন। এক জন সহদোষীর স্ত্রীকেও ডমিনিক ধর্ষণ করেছে। ১৯৯৯ সালে এক এস্টেট এজেন্টকে ধর্ষণের প্রচেষ্টাও সে করেছিল। এক যৌনবিকৃত পুরুষের বিকার? কিন্তু ডমিনিক ছাড়া আরও অন্তত বাহাত্তর জন ধর্ষক যে এই মামলায়!

যে পঞ্চাশ জন শনাক্ত হয়েছে, তারা ২৬ থেকে ৭৪ বছর বয়সি ড্রাইভার, মিস্ত্রি, কারারক্ষী, সাংবাদিক, হাসপাতাল সেবক, প্রযুক্তিকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মী, সৈন্য— অনেকেই বিবাহিত, কারও প্রেমিকা আছে; অনেকেই পিতা, কেউ দাদু-ঠাকুরদাও। সকলের বাস পেলিকোদের বাড়ির ত্রিশ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে। আপাত-ভদ্র লোকালয়ে এত ধর্ষক! তাই শুধু যুদ্ধ বা দেশভাগের সময়ে নয়, নিস্পন্দ সমাজজীবনেও ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক।

ধর্ষকদের অনেকের মতে, স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতে স্বামীর সম্মতিই যথেষ্ট। বয়স্ক ঘুমন্ত নারীকে যৌনপুতুলের মতো ব্যবহার করতে কারও বাধেনি। ‘আমার মক্কেল একে দম্পতির যৌন শখ ভেবেছিল,’ বলেছেন কারও কারও উকিল। কেউ এক বার এসেছিল, কেউ ছ’বার ফিরে এসেছে। কেউ নিজের সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীকে ফেলে ‘যৌনখেলা’-টি খেলেছিল। অনেকে আদালতে বৌ-মা-বোন-প্রেমিকাকে নিয়ে এসেছিল ভালমানুষির সাক্ষ্য দিতে। উল্লেখ্য, অপরাধীরাও অনেকে বাল্যকালে যৌন নির্যাতনের শিকার।

জিসেল অতিমানবী নন। ক্যারোলিন নিজের বইতে বলেন, “মা এখনও এটা ভাবার চেষ্টা করছেন যে, লোকটা চিরকাল এ রকম ছিল না,” কিংবা “মা ততটাও আমার পাশে দাঁড়ায়নি, যতটা মেয়ের নগ্ন ছবি দেখার পর দাঁড়ানো উচিত।” কিন্তু সে ছিল ২০২২ সাল। ২০২৪ সালে জিসেল উচ্চশির কোর্টে। চেয়েছেন, শুনানি গোপন কক্ষে নয়, সর্বসমক্ষে হোক— যাতে অন্য ধর্ষিতারা ভাবেন, ‘মাদাম পেলিকো পারলে আমরাও পারব’। উকিল ‘যৌন দৃশ্য’ বললে শুধরে বলেছেন ‘ধর্ষণ দৃশ্য’। অপরাধীদের মা-বৌদের বলেছেন, “আমিও বিশ্বাস করিনি আমার বর ধর্ষক। কিন্তু ধর্ষক শুধু অন্ধগলিতে না, পরিবারেও থাকে।” ছবি-ভিডিয়ো থাকা সত্ত্বেও, প্রথামাফিক ধর্ষিতাকে দোষারোপ করা হয়েছে। কখনও বলা হয়েছে তিনি ‘মদ্যপ’, কখনও ‘বরের অপরাধসঙ্গী’। কিংবা ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ’, বা ‘প্রচারকামী’, বা ‘যথেষ্ট দুঃখী নন’। কিন্তু নৈতিক সিদ্ধান্ত হিসাবে দৃঢ় ভাবে ‘লজ্জা’-কে প্রত্যাখ্যান করেছেন জিসেল। বলেছেন ‘ওরা লজ্জা পাক’। চেয়েছেন লজ্জার পক্ষবদল। ধর্ষণের আখ্যানের রাশ এ ভাবেই ধর্ষিতার হাতে আসতে পারে।

অচেতন করা, গণভোগ, আন্তর্জাল, ভিডিয়োগ্রাফি— নির্যাতনের নিকৃষ্টতম বৈশিষ্ট্যগুলি মিশেছে ঘটনাটিতে। কিন্তু এটিই কি একমাত্র? টেলিগ্রাম, ইন্টারনেট, ওয়টস্যাপ, ফেসবুক জুড়ে এ রকম লক্ষ লক্ষ গ্রুপ ‘বাক্‌স্বাধীনতা'-র নামে রমরমিয়ে চলছে। নারীর যৌনায়ন, ধর্ষণ নিয়ে রঙ্গতামাশা সেখানে জলভাত। সাউথ দিল্লির স্কুলছাত্রদের ইনস্টাগ্রাম গ্রুপ ‘বয়েস লকার রুম’ যেমন ছিল। অথচ ধর্ষণ ঘটার আগে পর্যন্ত ভাবা হয়, এ সব ‘পুরুষ হয়ে ওঠা’-র স্বাভাবিক পাঠক্রম!

কেউ বলছেন, ব্যুভোরের দেশের প্রগতিশীলতার গালে থাপ্পড় জিসেলের ঘটনাটি। কিন্তু, এই কি প্রথম? অচেতন নাবালিকাকে ধর্ষণ করে আমেরিকা থেকে পলাতক রোমান পোলানস্কি ফ্রান্সে আশ্রয় পাননি কি? ধর্ষণ-সংস্কৃতি তা হলে শুধু ‘ঐতিহ্য’ নয়, তা ‘প্রগতিশীলতা’-ও! ফ্রান্সে মুক্ত যৌনতায় বিশ্বাসী মানুষকে ‘লিবার্তাইন’ বলে। দোষীরাও নিজেদের ‘লিবার্তাইন’ ভাবে! যৌন অপরাধকে কি অনেক সময় যৌনস্বাধীনতার মোড়কে পেশ করা হয়?

ব্রিটিশ জুরি ম্যাথু হেলের ১৭৩৬ সালের নীতি ছিল: “স্ত্রী পতিকে সর্বস্ব আজীবনের জন্য দান করতে চুক্তিবদ্ধ, তাই বৈবাহিক ধর্ষণ হয় না।” ১৯৯২ সালে ব্রিটেন ভুল শুধরেছিল। ভারত কিন্তু ২০১৩ সালেও বর্মা কমিশনের সুপারিশ মেনে বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘অপরাধ’ চিহ্নিত করেনি। এ দিকে, এ দেশে নথিভুক্ত ধর্ষণেই শাস্তির হার এনসিআরবি অনুসারে মাত্র ২৭-২৮% (২০১৮-২০২২)। অতএব, গত নভেম্বরেও আগরায় স্ত্রীকে ধর্ষণের ভিডিয়ো দেখিয়ে তাকেই ব্ল্যাকমেল করছে ‘স্বামী।’ সেপ্টেম্বরে উজ্জয়িনীর প্রকাশ্য রাস্তায় ধর্ষণকালে, পথচারীরা বাধা দেওয়ার বদলে, ভিডিয়ো তুলছিল। ফ্রান্সে অপরাধীরা অন্তত সাজা পেল। ধর্ষকের ফাঁসি নয়, ভারতে নারীসুরক্ষার জন্য দরকার শাস্তির নিশ্চয়তা।

তারও পরে বাকি থাকে চেতনার বদল। সে কাজ, দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্সেও বাকি পড়ে আছে। আমাদের দেশে? যাঁরা অভয়ার ধর্ষণের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা ধর্ষণ সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করছেন তো?

অন্য বিষয়গুলি:

Rape case Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy