প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফর যে যথেষ্ট আড়ম্বরপূর্ণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অবসরে প্রশ্ন উঠতেই পারে, গত কয়েক দিনের ঘটনাবলির মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রপুঞ্জে মোদীর যোগব্যায়াম প্রদর্শন? নাকি যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন বানানোর জন্য জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে হিন্দুস্তান এরোনটিকসের অংশীদারিত্বের বিষয়? পশ্চিমের কিছু অগ্রগণ্য প্রকাশনার সহযোগিতায় ভারতের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন? নাকি সামরিক ড্রোন আর বাণিজ্যিক বিমানের বরাত?
একটু বড় করে ভাবলে এ সমস্ত কিছুই ক্ষমতার কোমল ও কঠিন— দু’দিককেই তুলে ধরে। ‘কোমল’ দিকটির উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রভাবশালী ‘ইকনমিস্ট’ পত্রিকা গত সপ্তাহের সংখ্যায় ভারত নিয়ে প্রায় আধ ডজন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রায় এক ‘ইন্ডিয়া প্যাকেজ’। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘অপরিহার্য’ ভারতকে আমেরিকার ‘প্রিয় নতুন বন্ধু’ হিসাবে বর্ণনা করে প্রচ্ছদকাহিনি। সেখানে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় নেতা, অনাবাসী ভারতীয় সম্প্রদায় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এবং প্রভাবশালী সম্প্রদায় এবং দুই দেশের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মৈত্রী ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময়ে আমেরিকান সেক্রেটারি অফ স্টেটস হেনরি কিসিংগারের সামনে যে সব পরিসর উন্মুক্ত ছিল, এই সব আলোচনা মনে করাতে পারে, সেগুলি এ বার ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সামনেও খোলা রইল। এক সময়ে যেখানে আমেরিকার তরফে ভারতকে উৎসাহ দেওয়া নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল, সেখানে এ ধরনের আলোচনা পাশার দান বদলে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন, অনাবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের রমরমাকে কি আদৌ ভারত অথবা আমেরিকার ক্ষমতায়নের কোনও কোমল দিকের ইঙ্গিত বলে মনে হয়? আমেরিকায় বাসরত ভারতীয়রা ১৫ বছর আগে বড়জোর পরমাণু চুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা চালিয়েছিলেন। এখন তাঁরা সংখ্যায় বেড়েছেন। ধনী হয়েছেন। আমেরিকার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ সব সত্ত্বেও কেউ বলতেই পারেন, আমেরিকাবাসী ভারতীয়রা তখনই এক গুরুত্বপুর্ণ ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে গণ্য হবেন, যখন আমেরিকার উজ্জ্বলতম শিক্ষার্থীরা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবেন এবং ভারতীয় পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হবেন।
অন্য দিক থেকে দেখলে, সব থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত ভারতীয়রা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অগ্রগণ্য শিক্ষক হয়ে রয়েছেন। সে দেশের প্রযুক্তিগত সংস্থাগুলিতে প্রচুর সুযোগ পাচ্ছেন। অর্থব্যবস্থার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আমেরিকান সমাজের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় ভারতীয়রা উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমেরিকান জীবনধারা এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও ভারতীয়ত্বের উপস্থিতি নজর এড়াচ্ছে না। এ সমস্ত কিছুই ‘সফ্ট পাওয়ার’ বা ক্ষমতার ‘কোমল’ দিকের উদাহরণ। পরোক্ষ ভাবে কিন্তু এই সব কিছু ভারতের খামতিকেই ইঙ্গিত করে। যে কারণে বহু ভারতীয় ধনকুবের দেশ ছেড়ে দুবাইয়ের মতো মরুশহরকে বসবাসের জন্য বেছে নিচ্ছেন।
কোমল ও কঠিনের প্রসঙ্গে একটু নজর করলে বোঝা যায়, দু’দেশের সম্পর্ক বন্ধনের ক্ষেত্রে যা প্রকৃতই কাজ করছে, তা হল ‘হার্ড পাওয়ার’। ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বৃহৎ বাজার হিসেবে তার সম্ভাবনার মতো বিষয়ই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিন্যাস বদলে দিয়েছে। ইন্ডিগো এবং এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের চোখধাঁধানো বরাত তার অন্যতম উদাহরণ। এ কথা সকলেরই জানা যে, ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং অচিরেই তা তৃতীয় স্থানে উঠে আসতে চলেছে। আমেরিকার অর্থনীতির মাত্র ১৫ শতাংশ ভারতীয় অর্থনীতি। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে তার অবদান এই মুহূর্তে আমেরিকান অর্থনীতির ৬০ শতাংশ। কারণ, এই বছরেই ভারতীয় অর্থনীতির চতুর্গুণ বৃদ্ধি ঘটেছে।
ভারতের সামরিক শক্তিও বিবেচনা করা দরকার। বিশেষত, ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌসেনা যদি নজরদারি ও আক্রমণের ব্যাপারে বরাতমাফিক এক ডজন আমেরিকান ‘পসেইডন’ যুদ্ধবিমান এবং ৩১টি ‘সিগার্ডিয়ান’ ড্রোন পায়, তা হলে তারা চিনের নৌশক্তির উত্থানের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ভারতের সামরিক বাজেট বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক সরঞ্জামের আমদানিকারক দেশ। জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো অনেক সংস্থাই এ দেশে তাদের ব্যবসার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। জেনারেল ইলেকট্রিকের সহযোগিতায় হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড (হ্যাল) তেজস, মার্ক ২-এর ইঞ্জিন বানাতে সমর্থ। ফরাসি সংস্থা ‘দাসো’ আশা করছে যে ভারত থেকে ৫০টিরও বেশি রাফাল যুদ্ধবিমানের অতিরিক্ত বরাত পাওয়া যাবে। যার অর্ধেক থাকবে যুদ্ধবিমানবাহী নতুন রণতরী ‘বিক্রান্ত’-এর উপর।
এই সব দিক বিচার করলে বলা যায়, ভারত তার বিদেশনীতি নির্ধারণের ব্যাপারে অনেক বেশি আশাবাদী হতে পারে। সেখান থেকে দেখলে, সে আজ বেপরোয়া ভাবে পশ্চিমী বিশ্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনতে পারে। পশ্চিমের কর্তৃত্ববাদী, সংখ্যালঘু বিরোধী মনোভাবকে উপেক্ষা করতে পারে। এবং ধাপে ধাপে ভারত সেই সব আন্তর্জাতিক পরিসরে পা রাখতে পারে, যেখানে এত দিন তার প্রবেশ এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল।
সমীকরণের উল্টো দিকে গত এক দশকে আমেরিকার অর্থনীতি অবলীলায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (এমনকি ব্রিটেনকেও) অতিক্রম করে গিয়েছে। এখন তা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাইতে ২৫ শতাংশ বৃহৎ। আমেরিকা এখন বিশ্বের প্রধানতম প্রযুক্তিগত সংস্থাগুলির আবাসস্থল, পুঁজি এবং প্রযুক্তির উৎস। বিশ্ববাণিজ্য অথবা জলবায়ুর অভিমুখ পরিবর্তনের মতো বহুমুখী বিষয়ের সমস্যা সমাধানে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সুতরাং যখন যোগব্যায়াম, অনাবাসিত্ব বা অন্যান্য ‘সফ্ট পাওয়ার’-এর ব্যাপারে কথা ওঠে, তখন তা শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, দু’দেশের সম্পর্কসূত্র আসলে সামরিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ের মতো ক্ষমতার শক্তপোক্ত দিকগুলি। ‘কোমল’ আবরণ বড়জোর সেই ‘কাঠিন্য’-এর উপর একটা সুদৃশ্য আচ্ছাদন তৈরি করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy