Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
তুরস্কের নির্বাচন ভারতে বিরোধী শিবিরের কাছে বড় শিক্ষা
Politics

জোট কোন পথে যাবে

নরেন্দ্র মোদী ও রিচেপ এর্ডোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাতেও ফারাক খুঁজে পাওয়া ভার। দু’জনকেই বিরোধীরা একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী বলে মনে করেন।

Recep Tayyip Erdoğan and Narendra Modi.

সাক্ষাৎ: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ এর্ডোয়ানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১ মে ২০১৭, নয়াদিল্লি। উইকিমিডিয়া কমনস।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৩ ০৫:৪৭
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদীই আবার ক্ষমতায় ফিরবেন তো?”— ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কলেজের বন্ধুর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠেছিলাম। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা বন্ধুটি তার আগে পর্যন্ত মোদী সরকার তথা বিজেপির নিন্দামন্দই করছিল। বরাবরই নিজেকে বামপন্থী, উদারবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা বন্ধুটির অভিযোগ ছিল, বিজেপি সারা ক্ষণ ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ করে দেশটার ‘বারোটা’ বাজিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করার সুবাদে বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় কাটিয়ে এসেছে। দেশে ফিরে এখন বেঙ্গালুরুতে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস, নরেন্দ্র মোদী অর্থনীতির পরিচালনাতেও চূড়ান্ত ব্যর্থ। তার ফলে মাইনেকড়িও তেমন বাড়ছে না, বাজারে নতুন চাকরিও নেই।

এত কিছুর পরেও মোদীকে ফের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাওয়ার আকুতি কেন? উত্তর এল, “আমেরিকায় যা রোজগার করে এনেছি, সব শেয়ার বাজারে ঢেলেছি। ওই যৌথ সরকার এলে শেয়ার বাজার পড়ে যাবে। ডুবে যাব। মোদী থাকলে অন্তত শেয়ার বাজারটা তো চাঙ্গা থাকবে!” তার উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে ২০১৯-এ নরেন্দ্র মোদীই প্রধানমন্ত্রীর গদিতে ফিরেছিলেন।

শুক্রবার পটনায় বিরোধী শিবিরের শীর্ষ নেতানেত্রীরা বৈঠকে বসছেন। এই ধরনের বৈঠক এই প্রথম। স্বাভাবিক ভাবেই গোটা দেশের নজর সে দিকে থাকবে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগেও দু’এক বার এ রকম বৈঠক হয়েছিল। তবে কোনও জোট দানা বাঁধেনি। বিরোধী ঐক্যের প্রধান লক্ষ্য অবশ্যই আগামী লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো। তার বদলে বিরোধীরা মিলে যে একটা স্থিতিশীল, স্থায়ী বিকল্প সরকার গঠন করতে পারবেন, সেই বার্তাও দেওয়া জরুরি। কেন্দ্রে অস্থিরতা তৈরি হলেই শেয়ার বাজার পড়বে। কাজেই বিরোধীরা মিলে যে নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে ভাল প্রশাসন চালাতে পারবেন, রুটিরুজির সমস্যার সমাধান করতে পারবেন, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে নতুন কর্মসংস্থান করতে পারবেন, সেটাও বোঝাতে হবে।

সেটাই কি একমাত্র মাপকাঠি? না কি, বিজেপি বনাম বিরোধীদের লড়াইটা আসলে অনেক গভীরে? অনেক বেশি মতাদর্শগত, যার সঙ্গে সাংবিধানিক মূল্যবোধ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত?স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরে এ দেশে মূলত দু’টি ভাবনার জন্ম হয়েছিল। একটি ভাবনা ছিল, যখন ধর্মের নামেই দেশের বিভাজন হয়েছে, ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে, তখন সীমান্তের উল্টো দিকে ভারত নামক একটি হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি হওয়া উচিত। এর বিপরীত ভাবনা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক ভারতের ভাবনা। যার পুরোধা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, বি আর আম্বেডকররা। স্বাধীনতার পরে এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবনা তাঁরা সংবিধানে গেঁথে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে পঁচাত্তর বছর কেটে গেলেও এই দুই মতাদর্শের সংঘাত এখনও শেষ হয়নি। মোদী জমানায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে সঙ্ঘ পরিবারের উত্তরপুরুষরা নতুন করে হিন্দুরাষ্ট্রের পথে হাঁটতে চাইছেন।

তার জন্য নেহরু-আম্বেডকরের ইতিহাস মুছে দেওয়া জরুরি। সে কারণেই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের পুরোধা বিনায়ক সাভারকরের জন্মদিনে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিন্দু আচার মেনে সংসদ ভবনের উদ্বোধনের পরে লোকসভায় সাধুসন্তদের হাতে রাজতন্ত্রের প্রতীক সেঙ্গোল রাজদণ্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচি ধাপে ধাপে বদলে ফেলা হচ্ছে। তিনমূর্তি ভবনের সংগ্রহশালা থেকে নেহরুর নাম মুছে দেওয়া বা হিন্দু ঐতিহ্যের ধারক-বাহক গীতা প্রেসকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার দেওয়া সেই হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোনোরই এক একটি মাইলফলক।

কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবিরকে ঠিক করতে হবে, তারা কি এই মতাদর্শগত লড়াইটা আদৌ লড়তে চায়? না কি, তা করতে গিয়ে বিজেপির মেরুকরণের ফাঁদে পা দেওয়ার বিপদ দেখে তারা আপাতত নির্বাচনী লড়াইটাকে শুধুমাত্র মানুষের রুজিরুটি, চাকরির অভাবের প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়? সে ক্ষেত্রে তাদের বিকল্প নীতি কী?

তুরস্কের সাম্প্রতিক নির্বাচন এ ক্ষেত্রে বিরোধী শিবিরের সামনে বড় শিক্ষা। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, তার পরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে গত বিশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরে তুরস্কের রিচেপ এর্ডোয়ান ফের পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় ফিরেছেন। ভোটে জিতেই। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এর্ডোয়ানের বিস্তর মিল। দু’জনেই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। দু’জনের প্রধান পুঁজি দল-সরকারের ঊর্ধ্বে নিজের ব্যক্তিগত ‘স্ট্রংম্যান’ ভাবমূর্তি। দুই নেতারই মূল ভোটব্যাঙ্ক রক্ষণশীল, কট্টর ধর্মবিশ্বাসী, উগ্র জাতীয়তাবাদী মানুষ, এবং তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে মুগ্ধ ভক্তকুল। প্রধান হাতিয়ার মেরুকরণ হলেও দুই নেতাই তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, গরিব মানুষের জন্য নানা সুরাহা ও আর্থিক উন্নয়নের প্রচারমন্ত্র মিশিয়ে থাকেন। দু’জনেরই দেশের শীর্ষপদে উত্থানের পিছনে প্রধান কারণ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া বামমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা। দু’জনেই জগৎসভায় দেশকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসানোর দাবি করেন।

এখানেই শেষ নয়। নরেন্দ্র মোদী ও রিচেপ এর্ডোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকাতেও ফারাক খুঁজে পাওয়া ভার। দু’জনকেই বিরোধীরা একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী বলে মনে করেন। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধেই কিছু শিল্পপতি-বন্ধুকে সব সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ। বিরোধীদের নালিশ, দু’জনেই ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করে, আদালত থেকে নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্থাকে হাতের পুতুল বানিয়ে, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করে, বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করে, সংবাদমাধ্যমকে মুঠোবন্দি করে শুধু নিজের প্রচার চালাচ্ছেন। এ সব সত্ত্বেও দু’জনেরই নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, জাতীয়তাবাদী ভোটব্যাঙ্কে কোনও ফাটল ধরেনি। মোদীর ক্ষেত্রে সেই ভোটব্যাঙ্কটা হিন্দুত্ববাদী। এর্ডোয়ানের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মুসলিম। ফারাক শুধু এইটুকুই।

তুরস্কেও বিরোধীরা একজোট হয়েছিলেন। এক মঞ্চে এসেছিলেন। এর্ডোয়ানকে সরিয়ে তাঁরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আশ্বাস ছিল, আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ফিরবে। এর্ডোয়ানের নিজের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিপরীতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হবে। বিরোধীদের ধারণা ছিল, উদারমনস্ক, গণতন্ত্রকামী স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী মানুষ এর্ডোয়ানের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। শেষ রক্ষা হয়নি। বিরোধীরা ৪৮ শতাংশ ভোট পেলেও এর্ডোয়ানই ক্ষমতায় ফিরেছেন।

পটনায় বিরোধী জোটের বৈঠকের আগে তুরস্কের ভোট তা হলে রাহুল গান্ধী, নীতীশ কুমার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ারদের জন্য কী শিক্ষা রেখে যায়?

হিতোপদেশের নীতিকথাটি হল, মোদী বা এর্ডোয়ানের মতো শাসককে সরাতে গড়পড়তা মানুষের রুজিরুটির প্রশ্নে বিকল্প নীতি তুলে ধরাটা জরুরি। গড়পড়তা মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার ঢেকুর তুলে সাংবিধানিক মূল্যবোধ নিয়ে মাথা ঘামায় না। মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, তরুণ প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় চাকরির সুযোগ তৈরি করতে না পারা। বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। এখন দশ বছরের সরকারের শেষ বেলায় প্রধানমন্ত্রী দেড় বছরে দশ লক্ষ সরকারি চাকরির কথা বলছেন। ঘটা করে সরকারি চাকরির চিঠি বিলি করছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই শূন্যপদ পূরণের জন্য যে সরকারি চাকরি হয়ে থাকে, তার জন্যও মোদীকে বড়াই করতে হচ্ছে। আর্থিক বৃদ্ধির হারে ভারত সকলের থেকে এগিয়ে বলে ঢাক পিটিয়েও চাকরির অভাব ধামাচাপা দেওয়া যাচ্ছে না।

পটনা ও তার পরবর্তী জোট বৈঠক থেকে বিরোধীদের বার্তা দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী যে-ই হোন না কেন, তাঁরা সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবেন। স্থায়ী ও স্থিতিশীল সরকার গড়তে পারবেন। যাতে শেয়ার বাজারে অস্থিরতা তৈরি না হয়। শুধু বিদেশ-ফেরত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের পেশাদাররা নন। শেয়ার বাজারের উপরে এখন সরকারি চাকুরের পেনশন থেকে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ও নির্ভর করছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Narendra Modi Turkey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE