বিপাকে আদানি গোষ্ঠী, ভারতে লগ্নির ভবিষ্যৎ কেমন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গত কয়েক দিনের মধ্যে দু’টি ঘোষণা অনেকেরই নজর কেড়েছে। এদের একটি হল, টাটার মালিকানাধীন এয়ার ইন্ডিয়ার তরফে ৪৭০টি যাত্রিবাহী বিমানের বরাত দেওয়ার ঘটনা। এর পর আরও ৩৭০টি বিমান কেনার কথাও রয়েছে। এই দুই অঙ্ক যোগ করলে দাঁড়ায় ৮৪০। বর্তমানে এই সংস্থার বিমান সংখ্যার (৭০০টি) চাইতে অনেকখানি বেশি। আর দ্বিতীয়টি হল, মুকেশ অম্বানী, কুমার মঙ্গলম বিড়লা এবং টাটার মতো উদ্যোগপতিদের নেতৃত্বাধীন বণিক সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে শুধু মাত্র একটি রাজ্যে (উত্তরপ্রদেশ) প্রায় ৩.৫ ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি প্রদান।
এ ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রাথমিক ভাবে একটি প্রশ্ন তুলে ধরে। সেটি এই— ভারতের বৃহত্তম বণিক গোষ্ঠীগুলি ঠিক কী ধরনের প্রাধান্য (যদি আদৌ কিছু থেকে থাকে) ভোগ করে? অন্য ভাবে বললে, এই সব গোষ্ঠীর সাফল্যে কী ভাবে দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হয়? একটি হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, গৌতম আদানির সংস্থাগুলি “ভারতের বৃহত্তম বন্দরগুলির বেশ কিছুকে পরিচালনা করে…, দেশের ৩০ শতাংশ শস্য রাখার গুদাম তাদের পরিচালনাধীন, তারাই দেশের শক্তি সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, দেশের বাণিজ্যিক বিমান পরিষেবার এক চতুর্থাংশ এদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সেই সঙ্গে দেশের মোট সিমেন্ট উৎপাদনের এক পঞ্চমাংশও তারাই করে থাকে। সিঙ্গাপুরের এক সংস্থার সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগকে ভারতের বৃহত্তম খাদ্য উৎপাদক সংস্থা বলে মনে করা হয়…।”
উপরের এই তালিকায় কিন্তু সৌরশক্তি উৎপাদনের প্যানেল তৈরি, শক্তি উৎপাদন, গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন, সড়কপথ নির্মাণ, তামা বা কয়লার খনি, পেট্রোরসায়ন, একটি ডেটা সেন্টার এবং ক্লাউড সেন্টারের উল্লেখ নেই। এ সব কিছুই গোষ্ঠীর চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) কয়েক মাস আগে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর দেওয়া তালিকা থেকে যে সব প্রকল্পের হিসাব পাওয়া যায়, তার মোট মূল্য ১২,০০০-১৪,০০০ কোটি আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৯.৬-১১.২ লক্ষ কোটি টাকা)। সিএফও দেখান যে, এই গোষ্ঠী ১ লক্ষ কোটি ডলার মূল্যমানের সীমারেখাকে স্পর্শ করতে চাইছে, যা অ্যাপল এবং সৌদি অ্যারামকো-র মতো হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থাই করে দেখাতে পেরেছে। এ সবই অবশ্য প্রাক্-হিন্ডেনবার্গ পর্বের কথা, যা চমকপ্রদ ভাবে এই তথ্য জানায় যে, ২০২২ সালে আদানি গোষ্ঠীর মোট লাভের পরিমাণ ছিল ২৯০ কোটি আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা)।
আরও বেশি পরিমাণে লাভজনক প্রতিষ্ঠান টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান, এন চন্দ্রশেখরন সম্প্রতি তাঁর বিনিয়োগ পরিকল্পনা জানিয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরের জন্য টাটারা ৯০০০ কোটি আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৭.২ লক্ষ কোটি টাকা) বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। আদানিদের সঙ্গে তুলনা করলে এই বিনিয়োগ তাদের কাছাকাছিরই। পাশাপাশি, মুকেশ অম্বানীও বিভিন্ন খাতে ১০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলেছেন। অম্বানীর ইচ্ছে দেশের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির এক পঞ্চমাংশ উৎপাদন করা। যে কারণে রিলায়েন্স গোষ্ঠী গুজরাতে ৪,৫০,০০০ একর জমি চেয়ে বসেছে। জমির আয়তনটি কার্যত দিল্লি রাজ্যের চাইতেও বেশি।
এই ত্রিশক্তির মতো না হলেও, অনিল আগরওয়ালের বেদান্ত গোষ্ঠী রয়েছে। এদের আগ্রহের মূল জায়গা বিভিন্ন ধাতু, অপটিক্যাল ফাইবার এবং শক্তি। জানা যায়, এই গোষ্ঠীর লাভের পরিমাণ আদানিদের চাইতেও বেশি এবং তার পরেও ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ৩০০০ কোটি আমেরিকান ডলার থেকে ব্যবসাকে ৭৫০০ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এই গোষ্ঠীর বিনিয়োগের পরিকল্পনা ২০০০ কোটি আমেরিকান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা)। খনিজ তেল ও গ্যাস উৎপাদনে বেদান্ত গোষ্ঠী রাষ্ট্রায়ত্ত ওএনজিসি-র সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আশা রাখে এবং ফক্সকনের সঙ্গে যৌথ ভাবে ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লে ইউনিট এবং সেমি-কন্ডাক্টর কারখানা গড়ার পরিকল্পনা তাদের মাথায় রয়েছে।
এরা ছাড়াও রয়েছে আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী। সিমেন্ট, ধাতু, বস্ত্রবয়ন, সার, টায়ার ইত্যাদি শিল্পে এই গোষ্ঠী অগ্রণী। লাভের দিক থেকেও এরা আদানিদের কাছাকাছি, কিন্তু বড় ধরনের ঘোষণার ব্যাপারে এরা বেশ সাবধানি। সজ্জন জিন্দলের জেওএসডব্লিউ ২২০০ কোটি আমেরিকান ডলার অর্থমূল্যের সংস্থা। এদের আগ্রহের জায়গা ইস্পাত, শক্তি, সিমেন্ট, পরিকাঠামো, রং ইত্যাদি ক্ষেত্র। সে দিক থেকে দেখলে এরাও বিনিয়োগে আগ্রহী। এই গোষ্ঠী তাদের সিমেন্ট উৎপাদনকে তিন গুণ বাড়িয়েছে, এবং বন্দর ও বিমানবন্দরের ব্যবসাকে ছ’গুণ বাড়াতে সমর্থ হয়েছে।
দেশের প্রধান তিন বিনিয়োগকারী যে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলেছে, তা ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) এক দশমাংশের সমান এবং তা যে কোনও ভাবে ৪ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সম্ভব হবে বলেই তারা আশা রাখে। ভারতের নথিভুক্ত নন-ফিন্যান্সিয়াল সংস্থাগুলির মধ্যে ৩,২৫০টির লাভের ২০ শতাংশ তারা আয় করবে বলে দাবি করে। দ্বিতীয় স্তরে থাকা বিনিয়োগকারীরা প্রায় ১০ শতাংশের দাবিদার। এই ৬টি গোষ্ঠীকে একত্র করলে, তারা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কর্পোরেট ক্ষেত্রের এক তৃতীয়াংশ বা তার চাইতেও বেশি নতুন বিনিয়োগের পিছনে রয়েছে, বলাই যায়।
পরিকল্পিত বিনিয়োগের সব ক’টিই কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না। অনিল অম্বানী, রুইয়া ব্রাদার্স (এসার-এর মালিক), অন্ধ্রপ্রদেশের একদা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী জিএমআর, জিভিকে এবং ল্যানকো-র মতো সুবিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা-যুক্ত বণিক গোষ্ঠী অন্যান্যদের সঙ্গে মিশে মনমোহন সিংহ জমানার ঋণ-পরিচালিত বিনিয়োগের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল। সেই জমানা অবশ্য বেশ খারাপ ভাবেই শেষ হয়। আজকের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আদানিরা অতি মাত্রায় উচ্চাশা পোষণকারী এক উদাহরণ। বাকি ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়ন’রা অনেক বেশি পোক্ত জমির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বলেই মনে হয়।
এই বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ বাড়তে থাকার পিছনে সম্ভবত কাজ করেছে তাদের পুঁজিনিবিড় প্রকৃতি ও দেশের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তা সত্ত্বেও বহুমুখী বাণিজ্যগোষ্ঠীর উত্থান কিন্তু আগেকার একমুখিন বাণিজ্য উদ্যোগগুলির থেকে একেবারেই আলাদা চরিত্রের। এরা নজর রাখত টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ ও মোটরগাড়ি সংক্রান্ত ব্যবসায়। আজকের গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিকেশ করতে বা তাদের কিনে ফেলতে উৎসাহিত করে। এই দুই কাজেরই উদাহরণ বিরল নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মডেল মূলত উঠে আসে রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে। কিন্তু এ দেশের ক্ষেত্রে তেমন তুলনা টানা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ৬টি বৃহৎ গোষ্ঠী ভারতের জিডিপি-র ১১ শতাংশের সমপরিমাণ লাভ করে থাকে। একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাংই এর থেকে বেশি আয় করে বলে জানা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy