গত কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিক রকমের তেজি থাকার পর আদানির শেয়ারের দাম কয়েক মাস ধরেই নিম্নগামী হয়ে রয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গৌতম আদানি বেশ মুশকিলেই পড়েছেন বলা যায়। তাঁর সংস্থাগুলির বিষয়ে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে উল্লেখ হওয়া বিষয়গুলি খণ্ডন করতে তিনি যে ব্যর্থ হয়েছেন, সে কথা এখন অনেকেই বিশ্বাস করছেন (রিপোর্টে কয়েকটি মাত্র বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে)। এর প্রভাবে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম লক্ষণীয় ভাবে পড়ে যেতে থাকে। গত শুক্রবার তা প্রায় বিপর্যয়ের কাছাকাছি চলে যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গোষ্ঠীর ফ্ল্যাগশিপ ‘আদানি এন্টারপ্রাইজেস’-এর শেয়ারের দাম তার বাজারে ছাড়ার সময়কার ন্যূনতম মূল্যেরও নীচে চলে গিয়েছে, যা গত মঙ্গলবার পর্যন্ত খোলা বাজারে ওই দামেই বিক্রি হয়েছে। পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে আদানিরা শেয়ারের ‘আস্কিং প্রাইস’, অর্থাৎ যে সর্বনিম্ন দামে তা বিক্রি করা যায় (২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া সম্ভব এমন ক্ষেত্রে), কমিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাতেও পরের সপ্তাহে শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া আটকানো যেত না। সমস্যা কোনও না কোনও ভাবে তৈরি হতই। এতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম আদানির বিড়ম্বনা যেমন প্রকট হয়ে উঠল, তেমনই এর পরোক্ষ প্রভাব পরবর্তী কালে তাঁর সংস্থা ছাড়াও পড়তে পারে বৃহত্তর শেয়ার বাজারেও।
৮০-র দশকের গোড়ায় শেষ বারের মতো শেয়ার বাজারের একদল ব্রোকার চড়া দামে রিলায়েন্সের শেয়ার বিক্রি হচ্ছে ভেবে এক বিতর্কিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ‘বিয়ার অ্যাটাক’ (সাধারণত শেয়ারের দামে ২০ শতাংশ পতন) সংগঠিত করেন। সেই সংস্থার কর্ণধার কোনও সাধারণ শেয়ার ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি স্বয়ং ধীরুভাই অম্বানী। তিনি দ্রুত ‘ফ্রেন্ডস অফ রিলায়েন্স’ নামে এক ব্রোকার সংগঠন তৈরি করেন। সেই সংগঠনের সদস্যেরা ছিলেন মূলত বিদেশি। এবং সেই সংগঠন দিয়ে তিনি এক পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে বিয়ার-সংগঠকদের ছত্রভঙ্গ করতে সমর্থ হন। এখন রিলায়েন্সের শেয়ারের দাম বাড়লে সেই সব ব্রোকার মুখ লুকোন। অম্বানীর উপরে আর কোনও শেয়ার বাজারের খেলোয়াড় নজর দিতে চাননি।
অম্বানীর সে দিনের অবস্থার সঙ্গে আদানির আজকের অবস্থানের ফারাক রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিক রকমের তেজি থাকার পর আদানির শেয়ারের দাম কয়েক মাস ধরেই নিম্নগামী হয়ে রয়েছে। ২০২২ সালে গ্রুপ কোম্পানির শেয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলে। তার পর থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ পতন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, কখনও তা ৪৫ শতাংশেও পৌঁছায়। শুক্রবারের ক্ষতির পরিমাণ সব থেকে বেশি। সীমাবদ্ধ পাবলিক হোল্ডিং সম্পন্ন সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে খুব কম মূল্যের ব্যবসার কালেও শেয়ারের দামে বড় রকমের ওঠানামা ঘটতে পারে। সেখানেই ঝুঁকির বিষয়টি নিহিত। কিন্তু এখান থেকেই আদানিদের উদ্ধারের যাত্রা শুরু হতে পারত। অন্তত ধীরুভাইয়ের উদাহরণ তো সেই রকমই ইঙ্গিত দেয়।
এ ক্ষেত্রে সমস্যা একটাই যে, এই বণিক গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গলা ফাটিয়ে বলার মতো কিছু নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পর পর ৩ বছর তুলনামূলক ভাবে ঢিলেঢালা অবস্থা পার করে ‘আদানি এন্টারপ্রাইজেস’ ২০২১-২২ সালে ৭৫ শতাংশ রাজস্বের মুখ দেখেছিল। কিন্তু তার মোট লাভের পরিমাণ সেই বছরেই কমে আসে, মোট বিক্রির ১.৫ শতাংশ হয়ে দাঁড়ায়। গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত ৭টি সংস্থার ৬টিরই ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত কর প্রদানের আগের লভ্যাংশে সামান্য খামতি দেখা গিয়েছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ‘আদানি পাওয়ার’, যা রাজস্বের ক্ষেত্রে সামান্য বৃদ্ধি-সহ ১৮৭ শতাংশের বেশি লাভ ঘরে তুলতে সমর্থ হয়েছিল।
যে সব সংস্থা ৩০০ থেকে ৬০০ গুণ আয় করতে সমর্থ, তাদের শেয়ার নিয়ে এমন কিছু ঘটবে, তা আশা করা যায় না। ব্যতিক্রমী বৃদ্ধির সম্ভাবনা যুক্ত ছোট স্টার্ট-আপ সংস্থার ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া লাভের বিষয়টি বোঝা যায়। কিন্তু পুঁজি-নিবিড় পরিকাঠামো যুক্ত সংস্থার ক্ষেত্রে তা বোঝা যায় না। রিয়্যাল-ওয়ার্ল্ড ভ্যালুয়েশন শুধুমাত্র দেখা গিয়েছে ‘আদানি পাওয়ার’ (প্রাইস টু আর্নিং রেশিয়ো বা সংস্থার শেয়ারের দাম ও সেই শেয়ার অনুযায়ী তার আয়ের অনুপাত ১২) এবং ‘আদানি পোর্টস’ (প্রাইস টু আর্নিং রেশিয়ো ২৭)-এর ক্ষেত্রে। ২০০৮-এ যখন অনিল অম্বানীর রিলায়েন্স পাওয়ার নিয়ে চড়া দামে শেয়ার ছাড়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিল, সেই শেষ বারই এ ধরনের মূল্যায়ন দেখা গিয়েছিল। এর ফল কী দাঁড়িয়েছিল, তা সকলেই জানেন।
প্রকাশিত খবর থেকে যা জানা যায় তা হল, আদানি গোষ্ঠীর মাঝারি মানের ব্যবসা এবং তার এক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে করা মূল্যায়নের পিছনে মূল কারণ ছিল অধিকাংশ ব্রোকিং সংস্থার তরফে আদানিদের শেয়ারের বিষয়ে যথাযথ তথ্যানুসন্ধান না করা। যদিও এ ধরনের কিছু গ্রুপ কোম্পানিই শেয়ার বাজারের সূচক হিসেবে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। সম্ভবত পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী বা সেমি কন্ডাক্টর উৎপাদন— এক বিস্তারিত বাণিজ্য বিস্তারের উপর্যুপরি ঘোষণা এবং বন্দর, বিমানবন্দর, একটি সিমেন্ট কারখানা এবং সম্প্রতি একটি ক্রিকেট ফ্র্যাঞ্চাইজি অধিগ্রহণের মতো উন্মত্ত কার্যকলাপে অনেকেই বিভ্রান্ত বোধ করতে শুরু করেন। অথবা ইকুইটি সংক্রান্ত চর্চাকারীরা আদানিদের মতো রাজনৈতিক সংযোগসম্পন্ন গোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে চাননি, এমনও হতে পারে।
যে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক, সেটি এই— শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা এই পরিস্থিতিতে কী করছিল? গত বছর দুয়েক ধরে সময় বিশেষে এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ্যে এসেছে। তার বেশ কিছু হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে উল্লিখিত। বিক্ষিপ্ত কিছু অনুসন্ধান তথা তদন্ত শুরু হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে সবই ধামাচাপা পড়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy