ওই হল গ্রামের ঘরে কলের জল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আধ-গামলা জমা হয়েছে রীতা গিরির গামলায়, এমনই জোর সরকারি জলের। ‘জলস্বপ্ন’ প্রকল্পের বেশ ক’বছর আগে এ গ্রামে পাইপের জল এসেছিল, জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগেরই প্রকল্পে। হাঁটুর সমান উচ্চতায় একটা কল বসেছিল বাড়িতে। কিন্তু জলের যা প্রেশার তাতে ওইটুকুও ওঠে না, তাই মাটির নীচ দিয়ে পাইপ বসিয়েছেন রীতাই। সারা দিনে গামলা ভরে না। অগত্যা গেরস্তালির সব কাজের জন্য ভরসা ওই ঘোলাটে পুকুর। আরও গরম পড়লে, টিউবওয়েলে লাইন আরও লম্বা হলে, রান্নাও হবে পুকুরের জলে, বললেন মহেন্দ্রনগরের মেয়েরা।
পাথরপ্রতিমার বড়চড়া নদীর ধারে গোপালনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি মৌজা মহেন্দ্রনগর। টাউন থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে। যাত্রা এবড়ো-খেবড়ো ইটের রাস্তা, তার পর মাটির রাস্তায়। দু’দিকে পর পর পুকুর। সবুজ, থকথকে জলে মেয়েরা বাসন মাজছে। ওরা পুকুরকে ঘেন্না করে না। শুধু অনুযোগ, আমপান-ইয়াসে বাঁধ ভেঙে পুকুরে ঢুকেছে নদীর যে নোনা জল, তা এখনও যায়নি। ক’দিন আগে সাহস করে পুকুরে মাছ ছেড়েছিলেন রীতা, তালুর সমান হওয়ার পর সব মরে ভেসে উঠেছে। তবু পুকুরেই কাপড়-বাসন নিয়ে নামেন, উপায় কী? এই সাতচল্লিশ বছরে আর কত জল বইবেন?
অথচ, না বইলেও তো নয়। গ্রামের বেকার ছেলেরা বসে তাস পিটবে, তবু জল আনবে না। তাদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বোনেরা, হাজার-কাজে আঁধার-দেখা মায়েরা, দিনে ছ’সাত বার টিউবওয়েল টিপে জল আনবে। ওই বয়ে আনা জল নিয়ে কি কেউ বাথরুমে যায়? তাই পুকুরের নোংরা জল ব্যবহার করছে মেয়েরা, এগারো থেকে একাশি নানা রোগের যন্ত্রণা সইছে। আর শুনছে, তারা মূর্খ, হাইজিন বোঝে না।
যাঁরা স্বাস্থ্যরক্ষার ট্রেনিং পান, সেই আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা কী বলছেন? গোপালনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের এক আশাকর্মীর বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, তাঁর ইন্দিরা আবাসের ঘরে টিনের চালা, তক্তপোষের তলায় বিছানো আলু, ধানের বস্তা পাঁজা করে রাখা, কিন্তু চানের জন্য সেই ঘর-লাগোয়া পুকুর। “কী করব, গ্রামে কল আসেনি।” পাথরপ্রতিমা, কুলতলি, সন্দেশখালির বেশ কিছু আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, তাঁরা নিজেরাও পুকুরের জল ব্যবহার করতে বাধ্য হন। অনেকে ভুগছেন একই রোগলক্ষণে— অতিরিক্ত সাদা স্রাব, প্রস্রাবে জ্বালা, চুলকানি, তলপেটে ক্রমাগত ব্যথা, যৌনমিলনে যন্ত্রণা। বসিরহাটের এক বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বললেন, “যদি দশ জনকে দেখি, ছ’জনেরই ওই সব উপসর্গ।” স্বভাব-সঙ্কোচে এ সব যন্ত্রণার কথা মেয়েরা বলে না।
শতসহস্র মেয়েদের ব্যথাকাতরতা অবশেষে বুঝি রাজনীতির আসন টলিয়েছে— ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই বাংলার এক কোটি এগারো লক্ষ গ্রামীণ গৃহস্থালিতে কলের জল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য। বরাদ্দ ছাড়িয়েছে চোদ্দো হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্র-রাজ্য জলযুদ্ধও শুরু হয়ে গিয়েছে— কেন কেন্দ্রের ‘জলজীবন মিশন’ নাম বদলে রাজ্য ‘জলস্বপ্ন’ করেছে? কেন তিন বছরে মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে কল বসেছে? আঁচ মিলছে, জলের কল চিহ্নে ভোট হবে ২০২৪-এ।
ভোট তো আসবে, জল আসবে কি? মহেন্দ্রনগরের কল্যাণপাড়ায় রীতার বাড়ি জল পৌঁছয় না, কারণ গ্রামে ঢোকার মুখের কয়েকটা বাড়ি কল খুলে রাখে সারা দিন। মহেন্দ্রনগরের পঞ্চায়েত সদস্য রামেশ্বর পাল স্বীকার করলেন, অনেকে ওই পানীয় জল পাঠিয়ে দিচ্ছে ধানের খেতে। এ চিত্র সব জেলায়। পুরুলিয়ার জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের এক আধিকারিক জানালেন, এক-একটি পরিবারের দৈনিক আড়াইশো-তিনশো লিটার জল ব্যবহারের কথা। অনেক পরিবার পাঁচশো-ছ’শো লিটারও খরচ করছে।
“কেন জল নষ্ট হবে, গ্রাম কমিটি থাকলেই তো হল,” বললেন দিগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান রবীন্দ্রনাথ বেরা। পাথরপ্রতিমার ওই গ্রাম পঞ্চায়েত দু’লক্ষ লিটারের ওভারহেড ট্যাঙ্ক তৈরি করেছে, গ্রামবাসীদের চাঁদায় পাম্পের রক্ষণাবেক্ষণ চলছে পাঁচ-ছ’বছর। প্রতি গ্রামে এমন ‘ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন কমিটি’ থাকার কথা। দলীয় সংঘাত-দীর্ণ বাংলার ক’টা গ্রামে এমন নাগরিক কমিটি আছে?
‘কেমন জল মিলবে’ সে প্রশ্নটাও উঠছে। জনস্বাস্থ্য কারিগরি আধিকারিকরা জলে জীবাণু, আর্সেনিক-লোহা-ফ্লোরাইড পরীক্ষা করছেন, কিন্তু নুনের ভাগ পরীক্ষা হচ্ছে না। সুন্দরবনে কিন্তু নুন এক মস্ত প্রশ্ন। সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, নদীগুলোতে নোনা জলের ভাগও বাড়ছে, মাটির তিনশো-চারশো ফুট নীচের জল নোনা। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মেয়েদের উপর ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডন একটি সমীক্ষা করে দেখেছে, মেয়েদের প্রস্রাবে সোডিয়াম স্বাভাবিকের চাইতে সাতগুণ বেশি। যা গর্ভবতী মেয়েদের ঝুঁকি (প্রি-এক্লাপশিয়া) বাড়াচ্ছে। অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উপকূলবর্তী মেয়েদের মধ্যে গর্ভ নষ্টের হার পাহাড়ি অঞ্চলের চাইতে বেশি।
কী পরিস্থিতি এ পার বাংলায়? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুগত হাজরা সমীক্ষায় দেখেছেন, হাজার থেকে বারোশো ফুট গভীর না হলে টিউবওয়েলের জল লবণমুক্ত হবে না। “সুন্দরবনের সব বাসিন্দাকে লবণমুক্ত পানীয় জল দেওয়ার মতো যথেষ্ট জল ভূগর্ভের সুগভীর জলস্তর থেকে মিলতে পারে, কিন্তু সে জল অন্য কাজে নষ্ট হলে অকুলান হবে,” বলেন তিনি। “এর পর রয়েছে জয়নগর, ক্যানিং-এর মতো আধাশহরে অতিরিক্ত জল ব্যবহারের জন্য জলস্তর নেমে যাওয়ার সমস্যা।” নদীর জল লবণমুক্ত (ডিস্যালিনেট) করার সরকারি প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই তাঁর পরামর্শ, অগভীর স্তর থেকে তোলা জল লবণমুক্ত করে চাষের জন্য দিতে হবে। আর সুগভীর স্তরের জল রাখতে হবে কেবল পানের জন্য।
তা হলে, বাড়িতে কল এলেও সেই পানীয় জলে স্নান, শৌচ, বাসন মাজা, কাপড় কাচা উচিত হবে কি? স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা চাইলে কলের জলে কুলোবে না। পুকুরের জলের সংস্কারকেও সরকারি কার্যসূচিতে আনতে হবে। কারণ, সুন্দরবনের স্বাস্থ্যকর্মীরা মেয়েদের থেকে যে সব রোগলক্ষণের অভিযোগ বেশি পান, তার কয়েকটির (সাদা স্রাব, প্রস্রাবে জ্বালা) কারণ দূষিত জলের ব্যবহার। অন্য কয়েকটির (অতিরিক্ত, অনিয়মিত ঋতুস্রাব) ক্ষেত্রে লবণাক্ত, অপরিচ্ছন্ন জল অন্যতম কারণ হচ্ছে কি না, তা বুঝতে গবেষণা প্রয়োজন। আশা, অঙ্গনওয়াড়িদের সঙ্গে কথা বললে আশঙ্কা হয়, প্রজননস্বাস্থ্যের সঙ্কট সুন্দরবনে জনস্বাস্থ্য-সঙ্কটের রূপ নিয়েছে।
টলটলে পুকুর, কল খুললেই জল— গ্রামের মেয়েদের কাছে এ কেবল স্বপ্ন নয়, এ একটা বিপ্লব। জল তোলার বাঁদি হয়ে জীবন কাটানো মেয়েদের ভবিতব্য নয়, সে কথাটা এত দিনে মানছে দেশ। আজ যদি জল নির্বাচনী যুদ্ধের বিষয় হয়ে উঠে থাকে, তা বাংলার মেয়েদের ইচ্ছারই স্বাক্ষর, তাদের রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ। তবে ইঙ্গিত মিলছে, সরকার যেমন বিদ্যুৎকে মাপে খুঁটিতে, পুষ্টিকে রেশনকার্ডে, শিক্ষাকে ইস্কুলের সংখ্যায়, তেমনই জলকে মাপতে চাইবে কলের সংখ্যায়। যে সব গ্রামে পাইপ-কল বসেছে, তার অনেকগুলিই শুকনো ছিল গত গ্রীষ্মে। প্রকল্পের এলাকাতেও জলের ট্যাঙ্কার পাঠাতে হয়েছে, মানছেন আধিকারিকরা। অতএব নির্বাচনী বিতর্কে ‘কলশুমারি’ চলবে না। সরকারকে কাজের খতিয়ান দিতে হবে, গ্রামের গৃহিণী কত জল পেল, কেমন জল পেল, তার হিসাবে। এ বার খেলা জলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy