বাঙালি ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় দেশ ঢুঁড়ে ফেলেছিলেন বিশ্বকর্মাদের খোঁজে। বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাটের নীচের চায়ের দোকানে এ যুগের বিশ্বকর্মাদের খোঁজ মেলে— সুরেলা টানের কথা শুনে ধরে ফেলা যায় এঁরা মালদহ, মুর্শিদাবাদের মানুষ। সুরম্য অট্টালিকা, স্কাইওয়াক, ভাসমান সুইমিং পুল তৈরির কাজ করতে এসেছেন শহরে। রমজানের মাস চলছে, এই বিশ্বকর্মারা কেউ রোজা রাখতে পারছেন না। বারো ঘণ্টার ডিউটিতে শরীর সায় দেয় না উপবাসে। ইদের আগে সবাই বাড়ি চলে যাবেন, বাড়ির শিশুদের, বুড়োবুড়িদের জন্য নিয়ে যাবেন খুশির উপহার। পরমাত্মা নিশ্চয়ই ধর্মপালন না করার গুনা মাপ করবেন। “বারো ঘণ্টার হাড়ভাঙা ডিউটি তো কম ধর্মরক্ষা নয়,” বললেন ওঁদের এক জন, হাসিবুর।
বারো ঘণ্টা ডিউটি কেন? উপায় কী, ঠিকাদার যেমন বলে, যতটা বলে, ততটাই কাজ করতে হয়। তার কাছে সকলেরই ‘দাদন’ নেওয়া আছে। কাজে যাবার আগেই শ্রমিকের পরিবারের হাতে থোক টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই অগ্রিম পাঁচ-দশ হাজার টাকা, কখনও তারও বেশি। বিশ্বকর্মারা তার পর ঠিকাদারের ব্যবস্থাপনায় নির্মাণের কোনও না কোনও প্রজেক্টের কাজে চলে আসেন কলকাতা, কখনও যান মুম্বই, হিল্লিদিল্লি। সেখানে তাঁদের কাজের তদারকি করা, হিসাবপত্র রাখা, মজুরি দেওয়ার কাজ করেন মুনশি। ‘মুনশি’ শব্দটা সেই ব্রিটিশ আমলের মনে হয় বটে, কিন্তু গ্রাম-মফস্সলের ঠিকাদার তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হাসিবুর বোঝান, ঠিকাদারের সুপারভাইজ়ার হল মুনশি। তাঁরা শ্রমিকের ডিউটি, ওভারটাইমের হিসাব লেখেন, তিনবেলা রান্নার বাজার করেন। হাসিবুর, সামসেরদের তিনবেলা ভাতের জন্য দৈনিক ষাট টাকা দিতে হয়।
মজুরদের মজুরিও মেটান মুনশি। কত? মুনশি জানালেন, মাসে বারো হাজার টাকা দেওয়া হয়। সে কথার ঘোরতর বিরোধিতা করলেন বিশ্বকর্মারা, অবশ্য মুনশির অনুপস্থিতিতে। মাসিক পেমেন্ট এঁরা হাতে পান না, চলে যায় বাড়ির অ্যাকাউন্টে। বিশ্বকর্মারা পান সাপ্তাহিক জলপানির হাতখরচ তিনশো টাকা— ওঁদের ভাষায় ‘লেনি’। বিড়ি, খৈনি, চা, টিফিন, গুটখা, লটারি কাটার খরচ। কনস্ট্রাকশন সাইটের আশেপাশের মহল্লায় লটারির খুব রমরমা।
এই মজুরদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এঁরা বস্তুত জানেন না এঁদের দৈনিক মজুরি কত। খাবারের কেটে-নেওয়া টাকা, সাপ্তাহিক হাতখরচের হিসাব, অ্যাকাউন্টে পাঠানো মাসিক মজুরি, অগ্রিম দাদন চোকানো— সব কিছুর ঘোঁট পাকিয়ে প্রকৃত মজুরি কত, তার থই খুঁজে পান না হাসিবুর, সামসেররা। ঠিকাদার সরকারি লভ্যাংশ ছাড়াও বিশ্বকর্মাদের মজুরি খুবলে নিচ্ছে সেটা সকলেই বোঝেন। কিন্তু মজুরি নিয়ে আওয়াজ ওঠাবে কে? ঠিকাদাররের সঙ্গে গ্রাম তথা পারিবারিক সম্পর্ক, দাদন প্রথার উপর নির্ভরতা, কাজ পাওয়ার আশা, কোথাও বিরোধের সামান্য সম্ভাবনাতেই কাজ হারানোর আতঙ্ক, এ সবই মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। ঠিকাদারের সদিচ্ছার উপরে মজুরি কমবেশি নির্ভর করবে, এটা ওঁরা মেনেই নিয়েছেন।
বিশ্বকর্মাদের ডিউটি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। থাকেন তাঁরা ঠিকাদারদের ভাড়া-করা ফ্ল্যাটে। ভোরে উঠতে হয়, বাথরুমের সামনে লাইন দিতে সময় যায় অনেকটা। একটা ফ্ল্যাটে জনা পনেরো লোক, বাথরুম একটা। হাসিবুর বললেন তাঁদের নীচের ফ্ল্যাটে থাকেন অন্য ঠিকাদারের শ্রমিক, তার নীচে পাচকরা, রান্নার বন্দোবস্ত সেখানে। তিনবেলা ভাত-ডাল-সবজি, শনি-রবি মাছ-মাংস দেওয়া হয় এক টুকরো করে। আলমগির হাসান এক বার জেল খেটেছেন বহু বছর আগে জমির ভাগাভাগির লড়াইয়ে, বললেন, জেলের লপসির স্বাদ, থাকা-শোয়ার ব্যবস্থা অনেকটা জেলের মতোই। থাকার জন্য টাকা দিতে হয় না। ট্রাক্টর, ম্যাটাডোরে দল বেঁধে যাত্রা করেন এঁরা, প্রজেক্ট সাইট অবধি। ওই সময়েই বিশ্বকর্মারা দৃশ্যমান হন শহরে, মাথায় সেফটি হেলমেট, গায়ে জ্যালজ্যালে রিফ্লেক্টিং ভেস্ট, একটু ঝুঁকে-পড়া বিষণ্ণ ভঙ্গিতে চায়ের দোকানে ছোট বিরতি, তার পর ঢুকে যাওয়া বিল্ডিং-এ গেটের মধ্যে।
ঠিকাদারের লোক গ্রামে গ্রামে বিশ্বকর্মাদের হাঁড়ির খবর রাখে। সংসারে টানাটানি, অসুখ, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহে টাকার প্রয়োজন পড়লেই ঠিকাদার হাজির হয় টাকার গোছ নিয়ে, পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, যা লাগে সে দিতে তৈরি। টাকা শোধ হবে দূর দেশে গতর খেটে, সুদ-সহ। ‘বন্ডেড লেবার’ শব্দটা চেপে যাওয়াই ভাল।
এক দল বিশ্বকর্মা রাস্তায় পাইপলাইন বসানোর কাজ করছিলেন। দলটি ছোট, পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার আশেপাশে থাকার দরুন অতিরিক্ত সাবধানি। চায়ের দোকানে দু’জনকে ধরা গেল, সামসেরের বয়স এখনও কুড়ি পেরোয়নি, ঠিকাদার দূরসম্পর্কের জামাইবাবু। থাকে প্লাস্টিকের ছাউনির তলায়, দাঁড়ানো ফ্যান ঘড়ঘড় করে ঘোরে, চৈত্রের রাতেও শরীর ভেপে যায়। সামসেরের বন্ধু আলি স্থানীয় পুকুরে গোসল করেছিল। সেই থেকে শরীর চুলকোচ্ছে। কলকাতায় ডাক্তার-ওষুধ মিলে পাঁচশো টাকার ধাক্কা, ইদে গ্রামে ফিরেই দেখাবে বরং, গ্রামের ডাক্তারের ষাট টাকার ‘ম্যাজিক ওষুধ’ ভাল।
সামাজিক সুরক্ষা যোজনা, ই-শ্রমের খোঁজ এই মজুরেরা রাখেন না, পরোয়াও করেন না। ও সবের মধ্যে ঢুকলে জীবনের জট আরও বাড়বে, খেটে খাওয়ার প্রবাহে বাধা আসবে। “কুড়ি বছর এই সব প্রকল্প ছাড়াই কাটিয়েছি, আমাদের ও সবের দরকার নাই,” বললেন হাসিবুর। কলকাতার বিশ্বকর্মাদের এখন চিন্তা, ইদের ছুটিতে কবে ফিরবেন ঘরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy