Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
time

ঘড়ির সুসময় কি চলেই গেল

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প বাসা-য় রেলশহরে গিয়েছেন লেখক। গাঁয়ের জেলেবৌয়ের ছেলে কানাই সেখানে চাকরি করে।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২২ ০৪:৫৪
Share: Save:

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প বাসা-য় রেলশহরে গিয়েছেন লেখক। গাঁয়ের জেলেবৌয়ের ছেলে কানাই সেখানে চাকরি করে। তাদের হাওয়া-বাতাস না ঢোকা বাসা, ছোট টেবিলে সস্তা টাইমপিস। কানাইয়ের মা আহ্লাদের সুরে বলল, “কানাই একটা ঘড়ি কিনেছে দেখেছ দাদাঠাকুর।” পরে ডিনার পার্টিতে সুখাদ্য খেতে খেতে লেখকের কত বার মনে হল “কানাইয়ের মার বাসায় সেই সস্তা টাইমপিস ঘড়িটাতে কটা বাজল দেখে আসি।”

ঘড়ি শুধু সময় দেখায় না। তাতে লেখা কত ঘাম, অশ্রুর ইতিহাস। আনন্দেরও। অমিতা পট্টনায়কের আত্মকথা নোনা জমিন-এ তারই চিহ্ন। দক্ষিণবঙ্গের গ্রামের মেয়ে, বংশে প্রথম হায়ার সেকেন্ডারি পাশ। গর্বিত বাবা কিনে দিলেন ব্র্যান্ডেড ঘড়ি। সে যেন মেয়েদের স্বপ্নের সিঁড়ি। লম্বা খাপের ভিতর লাল ভেলভেট কাপড়ের উপর ঘড়িটা শুয়ে আছে। সোনালি রং সোনার মতো ঝিকমিক করছে। মেরুন চামড়ার বেল্ট। খুব লোভ হচ্ছে এক বার হাতে পরতে। ভয় হয়। যদি হাত থেকে পড়ে যায়।

ঘড়ি পরার জন্য নির্দিষ্ট বয়স, পড়াশোনার যোগ্যতা থাকা চাই। উঁচু ক্লাসের ভাল ছেলেরা পরীক্ষার সময় দু’-এক জন তাদের বাবাদের ঘড়ি পরে। পকেটে লুকিয়ে রাখে সময়ে পরীক্ষা শেষ করার জন্য। স্যরেদের চোখে পড়লে বলেন— ঘড়ি পরা হয়েছে! দেখব রেজ়াল্ট কী হয়।

লেখিকা জানাচ্ছেন, টেনের প্রি-টেস্ট পরীক্ষার সময় দু’-এক বার বাবার ঘড়ি পরেছি। পাড়ার লোকেরা হাতে ঘড়ি দেখলেই সময় জানতে চায়। ঘড়ি দেখতে জানি কি না পরখ করে। কেউ বলে, “মাইঝি ঘড়ি পরি ইস্কুলে ডাঁট দেখাতে যায়টে।”

অনেকেই চাকরিতে প্রথম মাইনে পেয়ে ঘড়ি কিনতেন। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অফিস বেরোবার সময় মা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রথম মাইনে পাবি। এক টাকার জিলিপি কিনে এনে তোর বাবাকে প্রণাম করিস। মানুষটা খুশি হবে। আর শোন, কিস্তিতে ঘড়ি কিনতে পাওয়া যায় শুনেছি।

ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী হলেও অনেক মেয়েই শখকে গলা টিপে মারে স্বামী, পরিবারের মুখ চেয়ে। মায়ানন্দ মিশ্রের মৈথিলী গল্পের গৌরী সেন-কৃত অনুবাদ ভগ্নপ্রায় খিলের জাঁতা-য় আছে সে কাহিনি। মিসেস খন্না বলে উঠছেন, “আমার হাতে কি ঘড়ি নেই?” রাগিণী মিসেস খন্নার বিদ্রুপটা বুঝল না, তা নয়। অন্য সময় হলে তার আঘাত লাগত না, রাগও হত না। খাতা দেখে পাওয়া টাকা দিয়ে ঘড়ি কিনবে ভেবেছিল, সেই সময় ওর স্বামী এসে পৌঁছলেন। স্বামীর হাত খালি দেখে নিজের জন্য ঘড়ি কেনার প্রয়োজন বোধ করল না। মনে তৃপ্তিও হল।

রাগিণী রেগে বললে, ঘড়ি বাঁধতেই জানেন, দেখতে জানেন না।

ঘড়ি ব্যবহার এবং ঘড়ি শিল্প— দুটোই পুরুষপ্রধান হলেও প্রথম রিস্ট ওয়াচ বা হাতঘড়ি বানানো হয়েছিল মেয়েদের জন্যই। ছেলেদের ছিল পকেটঘড়ি। তার নমুনা বাংলা সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে।

“গলা হইতে লম্বিত মোটা সোনার চেনে আবদ্ধ ঘড়ি বুকের পকেটে নিবিষ্ট।” (মাস্টারমশায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

“...অপূর্ব তাহার কোটের পকেট হইতে সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া দেখাইল।” (পথের দাবী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

ঘড়ির বায়না ছেলেরাও করত। “সতীশ ঘড়ি ঘড়ি করে কয়দিন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। দিদি তাকে একটা রুপোর ঘড়ি দিয়েছেন।” (কর্মফল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মেয়েদের পকেটহীন (এবং উপার্জনহীন) জীবনে ঘড়ি এল মণিবন্ধে। খানিকটা সময় দেখা, বাকিটা ব্রেসলেট ধরনের ফ্যাশন অ্যাকসেসরি হিসেবে। ছেলেদের গ্রাম্ভারি পকেটওয়াচ বা বাড়ির কেজো টাইমপিসের তুলনায় সে নেহাতই শখের গয়না। আব্রাহাম লুইস ব্র্যাগে ১৮১০-এ প্রথম হাতঘড়ি তৈরি করলেন নেপলসের রানির জন্যে। অনেক বছর পর্যন্ত হাতঘড়িকে একান্ত মেয়েদেরই জিনিস ভাবা হত। দক্ষিণ আফ্রিকায় এক যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) থেকে সৈনিকেরাও ছোট্ট পকেটঘড়ি হাতে পরতে শুরু করলেন। কারণ গরমে জ্যাকেট পরে, পকেটে ঘড়ি রাখা মুশকিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরাও হাতে ঘড়ি পরতেন। মেয়েরা ছাড়া হাতঘড়ি কেবল সৈনিকরা পরবেন— এমনই ধারণা ছিল। এক জজসাহেব উকিলের হাতে ঘড়ি দেখে শুধোন, যুদ্ধে গিয়েছিলেন কি না! যাননি শুনে, নিদান দেন ঘড়ি খুলে ফেলতে!

প্রথম ছেলেদের হাতঘড়ি বানালেন লুই কার্তিয়ের (১৮৭৫-১৯৪২), বন্ধু স্যান্টোসের জন্যে। উড়ানের সময় লাগত তাঁর। ছেলেদের এই হাতঘড়িকে বলা হত স্ট্র্যাপ ওয়াচ। ত্রিশের দশকের পর স্ট্র্যাপ ওয়াচ শব্দটা খসে পড়ল, ছেলেদের ঘড়িও হল রিস্ট ওয়াচ। প্রযুক্তির দুনিয়ায় ইউনিসেক্সের ঢেউ উঠল। হাতঘড়িকে আর মেয়েলি ভাবল না কেউ।

আর এখন ঘড়ি পরাই উঠে যেতে বসেছে মোবাইল এসে, যেমন দরকার ফুরিয়েছিল সাহেব বিবি গোলাম-এর ঘড়িবাবুর। তবুও ঘড়ি কেনা হয়। সে সবই ফ্যাশন অ্যাকসেসরি— ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে। মেয়েরা গয়নার মতো ঘড়ি পরে, সেই অপবাদও ঘুচল বুঝি।

অন্য বিষয়গুলি:

time watch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE