ভারতবর্ষ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা হল এই দেশের আত্মা। এমনকি ১৯৪৭ সালের দেশ-ভাগও এই দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে সক্ষম হয়নি।
তার উপরে সারা দেশের সম্প্রীতির ঐতিহ্যমণ্ডিত মানচিত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদ জেলা। হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায় সৌভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের পরিবেশে সুদীর্ঘকাল ধরে এক সঙ্গে বাস করছে এই জেলায়। কিন্তু সেই সম্প্রীতিকে কেন প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে? জেলাবাসী হিসাবে আমরা গভীর ভাবে মর্মাহত এই সামাজিক অবক্ষয় দেখে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক মানুষ পরিবার, সমাজ ও দেশের শত্রু। হিংসা কেবল ধংস করে, জীবনকে ভুল পথে চালিত করে। সম্প্রতি দিল্লিতে পাশ হওয়া সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিঃসন্দেহে মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলা দরকার সুশীল সমাজের। সংসদে দীর্ঘ বিতর্কের মধ্যে দিয়ে এই বিল পাশ হয়েছে। অনুরূপ ভাবে সমাজে ও এর ভাল-মন্দ দিক নিয়ে চলুক আলোচনা। প্রতিবাদ করা, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীল হয়ে সেই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে যাতে সরকারকে আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করতে নেমে আমরা যেন আমাদের প্রতিবেশী ভাই-বোনদের সঙ্গে গোলমালে না জড়িয়ে পড়ি। সরকারি অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে।
ভারত এখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে মেরুকরণের রাজনীতির ফলস্বরূপ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবার উপর নাগরিক সত্য, তার উপর কেউ নাই। তার ধর্ম বা জাত বা ভাষা নয়। বর্তমান ভারতবর্ষের অধিকাংশ দল দর্শন দুর্ভিক্ষের শিকার। দেশকে নতুন দিশা দেখাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অপরদিকে তাঁদের বৃহৎ অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। দেশে যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, ওই সকল নেতৃবর্গ তাঁদের এই পাপ ঢাকতে মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন।এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একশ্রেণির মুনাফালোভীর চক্রান্ত। তারা দিনরাত মানুষকে সাম্প্রদায়িক ফাঁদে ফেলতে চাইছে।
মিডিয়াকে বা গুজবে কান না দিয়ে বিবেককে প্রশ্ন করবেন। দেখবেন প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের স্বার্থ এক, লক্ষ্য এক। আর তা হল তার পরিবারের মঙ্গল। আমরা হিন্দু বা মুসলিম ধর্মে যাই হই না কেন, আমরা এক সমাজের মানুষ, পরস্পর পরস্পরের আয়না। আল্লারাখা আর রাখোহারি ভাই-ভাই।
আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই সকল সূত্রকে বয়কট করতে হবে, যারা আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাই।
পাহেলগমে জঙ্গি হামলা নৃশংস ঘটনা এবং এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া দরকার। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ভয়াবহ ব্যর্থতা যার ফলে ঝরে গেলো ছাব্বিশটা নিরীহ ভারতীয় প্রাণ। কিন্তু এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অস্ত্র বানানো জঘন্য অপরাধ। হামলাকারীর ধর্ম বা জাতি যাই হোক না কেন, তারা ভারতের শত্রু। তাদের যে করেই হোক শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। ওই হামলাকারীর ধর্মের সঙ্গে কোনও ভারতীয় ধর্মগোষ্ঠীর ধর্মের মিল থাকলে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার ভাবনার মধ্যে গুরুতর অপরাধ লুকিয়ে আছে। এগুলো সুবিবেচক নাগরিক হিসাবে প্রথমে বোঝা দরকার।
লেখক: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, আমতলা জেআর মহাবিদ্যালয়
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)