Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
কী দিচ্ছি শিশুর মুখে
Eggs

খাদ্য নিরাপত্তা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে চাল-আলু বিতরণ

মিড-ডে মিল বা অঙ্গনওয়াড়িতে পরিবেশিত খাবারে শর্করা-প্রোটিন-ফ্যাট কোনটা কত পরিমাণে থাকবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:১৮
Share: Save:

নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা। গায়ের রং সাদা, চেহারা গোল, ওজন পঞ্চাশ গ্রাম, নাম ‘ডিম’। সতেরো মাস স্কুল আর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ। বাজারে ডিম রয়েছে, রাজকোষে ডিম কেনার টাকাও রয়েছে, তবু ডিম নেই দরিদ্র শিশুর পাতে। যা তাদের প্রোটিনের প্রধান উৎস। কোভিড অতিমারিতে স্কুল-অঙ্গনওয়াড়িতে রান্না-করা খাবার বন্ধ হয়েছে। ইস্কুল থেকে সপ্তাহে এক দিন, আর অঙ্গনওয়াড়ি থেকে মাসে এক দিন ‘রেশন’ দেওয়া হচ্ছে, যার প্রধান উপাদান চাল-আলু। ক্বচিৎ দেখা মিলছে সয়াবিন, ছোলার। কিন্তু ডিম নেই। চাল-আলু বিলি করলে ডিম দিতে সমস্যা কী ছিল? আর যদি না-ই দেওয়া যায়, তা হলে ডিমের বরাদ্দ টাকা কেন দেওয়া হবে না শিশুদের পরিবারকে? বিধানসভায় এ প্রশ্ন ওঠেনি, ওঠেনি নির্বাচনী প্রচারে, টিভি চ্যানেলের অন্তহীন তরজায়। যেন কারও মনে এক বার খটকা লাগেনি, এতগুলো শিশু, এতগুলি গর্ভবতী মহিলা, এই রোজগারহীন সময়ে, অগ্নিমূল্য বাজারে প্রোটিন পাচ্ছে কোথা থেকে?

খাদ্যের অধিকার মানে সুষম খাদ্যের অধিকার। মিড-ডে মিল বা অঙ্গনওয়াড়িতে পরিবেশিত খাবারে শর্করা-প্রোটিন-ফ্যাট কোনটা কত পরিমাণে থাকবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতেই। কোভিড অতিমারি তা জোগানোর দায় থেকে সরকারকে অব্যাহতি দিয়েছে না কি? সুইমিং পুল, সিনেমা হল বন্ধ করতে পারে সরকার, প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার জোগান বন্ধ করতে পারে না। সে অধিকার তার নেই। অথচ, গত বছর ১৭ মার্চ একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বাতিল হয়ে গেল ডিমের বরাদ্দ। কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতর কিন্তু লকডাউনের শুরুতে (২০ মার্চ, ২০২০) নির্দেশ পাঠিয়েছিল, স্কুল বন্ধ থাকলেও হয় রান্না-করা খাবার দিতে হবে, নইলে সমস্ত উপকরণ এবং রন্ধনকর্মীর খরচ ‘খাদ্য নিরাপত্তা ভাতা’ হিসাবে দিতে হবে শিশুদের। কিন্তু রাজ্য সরকার কী করল?

যদি ধরা যায়, মিড-ডে মিলে সপ্তাহে একটা ডিম দেওয়া হয়, যার প্রতিটার মূল্য ছ’টাকা, তা হলে গত ১৭ মাসে রাজ্য সরকার ৬-১৪ বছরের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের (মোট সংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি) যত ডিম থেকে বঞ্চিত করেছে, তার অর্থমূল্য অন্তত ৩২৮ কোটি টাকা। আর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গর্ভবতী মা আর শিশুদের পাওনা ডিমের হিসাব অন্তত ৭৭৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অন্তত ১১০০ কোটি টাকা নিঃশব্দে সরে গিয়েছে রাজ্যের মা-শিশুর বরাদ্দ থেকে, যা সারদা কেলেঙ্কারির কাছাকাছি (সরকারি হিসাব ছিল ১২০০ কোটি টাকা)। এই টাকার হিসাবে ধরা পড়ে না বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের পুষ্টিবঞ্চনা, মেধাশক্তি নষ্টের হিসাব।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের দিদিমণি, কিংবা ইস্কুলের স্যর-দিদিমণিদের কি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁরা ডিম বিতরণ সম্ভব মনে করেন কি না? দায়িত্ব নিতে রাজি আছেন কি না? জেলা আধিকারিক থেকে ইস্কুল-অঙ্গনওয়াড়ি, সর্বত্র শোনা গেল, ‘উপর থেকে’ নির্দেশ এসেছে, দেওয়া হবে শুধু চাল আর আলু। যেন দৈববাণী। কেন, কেউ জানে না। মাঝেমাঝে অঙ্গনওয়াড়িতে ছোলা, মিড-ডে মিলে সয়াবিন বিলি হয়েছে, যেগুলো প্রোটিন জোগানোর ভান মাত্র। ডিম থেকে শিশুর শরীর যত প্রোটিন গ্রহণ করতে পারে, সয়াবিন বা ছোলা থেকে পারে তার সামান্যই।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো অবশ্য খাদ্যের অধিকার রক্ষার ভানও করেনি। যে শিশুদের প্রতি দিন খিচুড়ি, অন্তত আধখানা ডিম, সব্জি-সয়াবিন, ছাতু-গুড়ের লাড্ডু পাওয়ার কথা, তাদের জন্য অতিমারি কালে ‘আইসিডিএস ডিরেক্টরেট’ বরাদ্দ করেছে গোটা মাসে দু’কেজি চাল, দু’কিলো আলু আর তিনশো গ্রাম মুসুর ডাল। হায় রে, গর্ভবতী মহিলার দিনে ১৮ গ্রাম প্রোটিন; হায়, কোলের শিশুর দিনে ১২ গ্রাম প্রোটিন পাওয়ার সরকারি নির্দেশ! প্রতি মাসে ৩০০ গ্রাম ডাল মিলেছে, ধরে নিলেও লকডাউনের পর প্রথম ন’মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০২০) অন্তত সাড়ে আঠারো হাজার টন ডাল মার গিয়েছে শিশু ও মায়েদের বরাদ্দ থেকে, হিসাব কষে বলছে পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি।

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে টানা চার-পাঁচ মাস ওই যৎসামান্য ডালও বিলি হয়নি, কারণ খাদ্য বিতরণই বন্ধ করেছিল অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এল, ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ে ছিন্নভিন্ন সুন্দরবনের বহু ব্লকে গণরসুই খোলা হল। খুলল না শুধু অঙ্গনওয়াড়ি। নানা জেলায় গ্রামের মানুষ জানতে চেয়েছিলেন, স্কুলে খাবার দেওয়া হচ্ছে, আইসিডিএস কেন্দ্রে হচ্ছে না কেন? অঙ্গনওয়াড়ি দিদিমণি, সুপারভাইজ়ার, ব্লক স্তরের আধিকারিক, সকলেই উত্তর দিয়েছেন, “আমরাই জানি না, তো জানাব কী?” ছ’মাস থেকে ছ’বছরের শিশুরা এ বছর অন্তত ৫৯৪ কোটি টাকার খাবার হারিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি খাবার দেয়নি বলে। এমন কার্পণ্য, এত প্রতারণা, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।

বরাবরই অঙ্গনওয়াড়ি চলে তাচ্ছিল্যে, অবহেলায়। যথেষ্ট কর্মী নেই, সুপারভাইজ়ার নেই, বহু আধিকারিক পদ শূন্য— বাঁ হাতে মনসাপুজোর মতো চলছে শিশুপুষ্টি প্রকল্প। জঙ্গলমহলের এক প্রত্যন্ত এলাকার সুপারভাইজ়ার, যাঁর অধীনে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় আড়াইশো কেন্দ্র চলে, জানালেন যে প্রায় সর্বত্র এক জন কেন্দ্রের কর্মী দিয়ে দু’টি বা তিনটি কেন্দ্র চলছে। কী করে? “পড়ানোর দিদিমণি একটা কেন্দ্রে রান্না করেন, রান্নার হেল্পার অন্য কেন্দ্রে।” আর তৃতীয় কেন্দ্রে? “ওঁরাই নিজের মাইনে থেকে টাকা দিয়ে লোক রাখেন।” এ ভাবেই সরকার গরিব শিশুর পাতের খাবার, গরিব মেয়ের শ্রমের টাকা আত্মসাৎ করে।

কেন্দ্রের সংখ্যা কম, বাড়ি থেকে অনেক দূরে, এই জন্যও বহু শিশুকে ‘খিচুড়ি-ইস্কুলে’ পাঠায় না পরিবার। এখন সেই পরিবারগুলিও মাসে এক দিন গিয়ে ‘রেশন’ নিয়ে আসছে, তাই গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পুষ্টি? দিদিমণিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওজন করছেন শিশুদের। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে মাঝারি অপুষ্টি (‘হলুদ’) ও চরম অপুষ্টিতে ভোগা (‘লাল’) শিশু বাড়ছে। মুর্শিদাবাদের এক জেলা আধিকারিক একান্তে জানালেন, চরম অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা তিনগুণ হয়ে গিয়েছে। এর কতটা শেষ অবধি সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়বে, বলা কঠিন। সরকারের ব্যর্থতার মেছো গন্ধ ঢাকা হয় সাজানো পরিসংখ্যান দিয়ে। লুকোনো অপুষ্টি প্রকট হয় যখন সাধারণ ভাইরাল জ্বরে একের পর এক শিশু মরণাপন্ন অবস্থায় ভর্তি হয় হাসপাতালে। পুষ্টির অভাব ঘাতক হয়ে ওঠে। আর ওজন মেপেই বা কী হবে, অপুষ্ট শিশুদেরও বরাদ্দ সেই এক চাল-আলু, একই পরিমাণে। কী করেন দিদিমণিরা তা হলে? “মায়েদের বলি, ফ্যান ভাতের সঙ্গে একটু সব্জি দিতে।” অধিকাংশ মায়েরও ওজনে ঘাটতি, বিশেষ করে যদি প্রথম প্রসূতি হয়। কর্মব্যস্ত মায়েরা সকালে শিশুর হাতে ধরিয়ে দেন একটু মুড়ি বা বিস্কুট। গরম ভাত নামতে নামতে বেলা হয়ে যায়। মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ির খাবার সেই ফাঁকটুকু ভরায় ছাতু, ডিম, খিচুড়ি দিয়ে। অতিমারিতে পরিবারে অভাব বেড়েছে, সরকারি খাবার কমেছে।

শিশুদের খাদ্যের অধিকারের সুরক্ষা চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি। সমিতির তরফে অনুরাধা তলোয়ার বলেন, “আক্ষরিক অর্থেই শিশুর মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে নিচ্ছে সরকার। তিন প্রজন্ম ধরে এর দাম চোকাতে হবে— আজকের মা, তার কম-ওজনের সন্তান, আর সেই কন্যাদের সন্তান। অপুষ্টি আজ আপৎকালীন পর্যায়ে। এখনই দরকার ‘দুয়ারে ডিম’ প্রকল্প।”

আদালত নির্দেশ দিলে হয়তো শিশুরা ডিম ফিরে পাবে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এক দিন চাইবে ওই শিশুরা। তাদের ডিম, সয়াবিন, ডালের টাকায় কোন জরুরি কাজ করেছে তাদের দেশ?

অন্য বিষয়গুলি:

Eggs Mid Day Meal Protein-Rich Foods
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy