Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
নতুন মায়ের কেরিয়ারে কাঁটা ফোটায় সভ্যতার নারীবিদ্বেষ
Society

‘পিছিয়ে পড়তে হয়’

কিন্তু তবুও এটা অত্যাচারের গল্প নয়, বৈষম্যের; যে কাঁটাটা অনেক সময় গোপনই থাকে, এমনকি যখন প্রকাশ পায়, তখনও এতই সূক্ষ্ম, যে আহত হয়, শুধু সে-ই অনুভব করে।

—প্রতীকী ছবি।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৪ ০৮:২১
Share: Save:

গল্পটা আসলে নারীদিবসের। হ্যাঁ, আমি নারীদিবস পালনে বিশ্বাস করি। আরও নানা রকম দিবস পালনেও বিশ্বাস করি, সে কথায় পরে আসছি। আগে একটি মেয়ের গল্প বলি। জন্মসূত্রে মেয়েটি ভারতীয় নারীসমাজের সেই ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর সদস্য যারা জন্ম ইস্তক পরিবারের সম্পদ হিসাবেই গণ্য হয়েছে, বোঝা হিসাবে নয়। এমনকি ২৫ বছরেও যাদের শুধুমাত্র ‘বিয়ের জন্য’ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি, যারা যদ্দূর সম্ভব যেমন ইচ্ছে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে, স্বয়ম্ভর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, এ হল সেই দলের মেয়ে।

এই মেয়েটি যখন নারীদিবসের ‘এক্সপোজ়ার’ পেয়েছিল, তখন সে যথেষ্ট পরিণত। তাই ‘নারীদিবস নয়, মানবদিবসে বিশ্বাস করি’ এ-হেন কথা সে কোনও দিনই বলেনি। কিন্তু যাদের জন্য নারীদিবস, তার ধারণা ছিল সে নিজে তাদের মধ্যে পড়ে না। কারণ নারী হিসাবে কিছু অসুবিধার মুখোমুখি হলেও সে একটা সময় পর্যন্ত তেমন কোনও বৈষম্যের শিকার হয়নি।

তার পর এক সময় সে মা হল মহানন্দেই। নতুন বাবাটির সহযোগিতায় নতুন মায়ের যাবতীয় দায়িত্ব, শারীরিক ও মানসিক ধকলকে সামলে সামান্য প্রলম্বিত মাতৃত্বজনিত ছুটির পর সে নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করল বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে ‘রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট’ হয়ে। এক দল সদ্য-স্নাতকোত্তর গবেষকের দলে এক জন অ্যাসোসিয়েট, যে পদটা কিছুটা ‘সিনিয়র’ গবেষকের জন্যই রাখা থাকে। আর সেই সময় থেকে শুরু হল তার অন্য রকম হয়ে পড়া। শিশুটির কারণে ব্যাহত ঘুমের ধারাবাহিকতায় ক্লান্ত, মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত, সকালে আয়াদিদির না আসা, দেরিতে আসা, শিশুটির না খাওয়া বা জ্বরে ভোগা— এই সব নানা রকম ধকল সামলে ল্যাবে পৌঁছতে কোনও দিন কিছুটা দেরি হলে সহকর্মীদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি, আর বিজ্ঞানী বস-এর ঠান্ডা তিরস্কার— “তোমার কি মনে হয় তুমি নিজের কাজটার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারছ!”

মজা হল এই পর্যন্ত এসেও মেয়েটি কিন্তু কাউকে দোষ দেয়নি, নিজেকে ছাড়া। নিজের অপারগতায় নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে উঠেছে, মুঠো মুঠো ব্যথানাশক খেয়েছে, সামান্য দেরিতে ল্যাবে পৌঁছনোর খামতি পূরণে থেকেছে দেরি পর্যন্ত আর তার পর আয়া চলে যাওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছতে পারা-না-পারার প্রচণ্ড উদ্বেগে ও অপরাধবোধে ভুগেছে প্রায় রোজ। মনে রাখবেন, মেয়েটির চাকরিটা কিন্তু কর্পোরেট জব নয়, দশটা-পাঁচটার বাঁধাধরা কাজও নয়, স্থায়ী চাকরিও নয়, এমনকি কিছু শেষ করার তাড়াও নেই। এমন একটা কাজে, হাজিরাটা ততটা জরুরি নয়, মনঃসংযোগ যতটা। বিশেষত, এই মেয়েটি যে প্রকল্পে কাজ করত, সেই মুহূর্তে সেখানে হাতে-কলমে কাজের চেয়ে পড়াশোনাটাই বেশি দরকারি ছিল। সেই কাজটার জন্য ‘ফ্লেক্সিবল আওয়ার’ এমনকি বাড়ি থেকে কাজও করা চলতে পারত, নির্দিষ্ট সময়ে কাজটুকু হচ্ছে কি না সেটা দেখাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, তাই সে কী পারছে তার চেয়ে কী পারছে না সেটা জরুরি হয়ে উঠছিল, কেন পারছে না সেটার অঘোষিত ব্যাখ্যা ছিল যে সে অসমর্থ। তার তুলনা হচ্ছিল বয়সে দশ বছরের ছোট (পুরুষ) সহকর্মীদের সঙ্গে, যারা প্রায় সবাই অবিবাহিত এবং হস্টেলবাসী। ওদের বয়সে মেয়েটাও যে সেই রকমই ছিল, সেটা মেয়েটার নিজেরই অবিশ্বাস হত।

কিন্তু তবুও এটা অত্যাচারের গল্প নয়, বৈষম্যের; যে কাঁটাটা অনেক সময় গোপনই থাকে, এমনকি যখন প্রকাশ পায়, তখনও এতই সূক্ষ্ম, যে আহত হয়, শুধু সে-ই অনুভব করে। অর্থাৎ, মাঝে মাঝে আহত হলেও তরুণ সহকর্মীরা ও মুখ্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে রোজকার ওঠাবসায় মোটের উপর এমন একটা চলনসই সম্পর্ক ছিল, যাকে মেয়েটাও ‘প্রফেশনাল রিলেশন’ বলে মেনে নিতে পারত। হ্যাঁ, কর্মস্থলের নিষ্ঠুরতা ও উদাসীনতাকে মেয়েটি পেশাদারিত্ব বলেই মেনে নিতে চাইত। নিজেকেই বোঝাত তার বাচ্চা ছোট কি না, সে রাতে ঘু্মোয় কি না সে কথা অফিস শুনবে কেন! বস্তুত, অফিস কোনও দিনই সে সব কথা শোনেনি কারণ সে শোনায়নি। দেরি হওয়ার বা কামাই হওয়ার কারণ হিসাবে সে কোনও দিন বাচ্চার দোহাই দেয়নি, শুধু ‘দুঃখিত’ বলে চেষ্টা করেছে শুধরে নেওয়ার।

আজকে এই লেখা সেই মেয়েটির ‘দোহাই’ না দেওয়ার বা ‘শুধরে’ নেওয়ার কথা নিয়েই। বলুন তো, মা হওয়ার পর শিশুসন্তানের দেখভাল কি কোনও অপরাধ যাকে ‘দোহাই’ বলতে হবে, যে অপরাধকে ‘শুধরে’ নিতে হবে প্রাণের উপর উঠে, অথবা নিঃশব্দে সরে যেতে হবে! গবেষণার মতো প্রতিযোগিতামূলক পেশায় ছ’মাস ছুটিতে থাকা ও তার পর নানা রকম সমস্যায় মেয়েরা সাময়িক ভাবে কিছুটা পিছিয়েই যায়, কিন্তু এই পিছিয়ে যাওয়াটাকে সমাজ কেন তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলে দেখবে, প্রশ্নটা সেখানেই। তাকে দায়ী না করে কেন এই টালমাটাল সময়টায় তার কাঁধে হাত রেখে বলবে না, “তুমি সামলে নাও, আমরা আছি।” তা হলে কি ‘কেরিয়ার’ বজায় রাখতে গেলে মেয়েদের ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে হবে, মাতৃত্ব বাদ দেবে জীবন থেকে! না কি মাতৃত্বের পর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া বা বাদ পড়াটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে হবে?

গল্পটা অবশ্য শেষ হয়নি। কিছু দিনের মধ্যে একটি চাকরির আবেদনপত্রে মেয়েটির সেই মুখ্য বিজ্ঞানীর পরিচিতিপত্র দরকার হয়। পরে মেয়েটি জানতে পারে সেই চিঠিতে তার ‘মেন্টর’ সেই বিজ্ঞানী, যাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি-ব্যক্তিত্বের ছটায় সে তখনও মুগ্ধ ছিল, তিনি লিখেছেন যে, “ও (মেয়েটা) ল্যাবে বিশেষ সময় দিতে পারে না, হয়তো বাড়িতে বাচ্চা আছে বলেই...।” মেয়েটি অবাক হয়ে ভেবেছিল, যে সময় ও প্রাণপণে নিজেকে ‘সকলের মতো’ করে তোলার চেষ্টা করছে, বাচ্চা থাকার ‘সুবিধা না নেওয়ার’ চেষ্টা করছে, তখন ওর কর্মক্ষেত্রে ওকে সবাই নীচের ধাপেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। যে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ও কোনও দিন ওর শিশুটি ছেলে না মেয়ে সেই কথাটুকুও বসকে জানায়নি (তিনিও জানতে চাননি), সেই পেশাদারিত্বের চাপ সহন আদৌ কোনও কাজে লাগেনি। ধাক্কাটা সইতে সময় লেগেছিল মেয়েটার।

এটা কোনও রূপকথার গল্প নয় যে জাদুমন্ত্রে মেয়েটি বিশাল সাফল্য পাবে আর তাকে দেখে সকলের মাথা নত হয়ে যাবে, কিংবা হতাশায় মেয়েটি পাগল হয়ে যাবে বা আত্মহত্যা করবে, যা শেষ অবধি লোককে ভাবাবে। সে সব কিছুই হল না। প্রথিতযশা সেই বিজ্ঞানীর দলে সে ভাবে কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় মেয়েটি গবেষণার জীবনে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে অন্য পেশায় চলে গেল, এইটুকুই। তিন পুত্রসন্তানের গর্বিত জনক এই বিজ্ঞানী দাবি করেন সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি ‘মাতৃত্ব পালন’ করেছেন, পিতৃত্বও। নিশ্চয়ই করেছেন, কিন্তু তার পর সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছেন, যে ভাবে সবাই আসে। আর সেই জায়গায় ফিরতে হবে না, কারণ ওঁর কোনও মেয়ে নেই।

এইখানে এসে নারীদিবসের গল্প আর মাতৃদিবসের গল্প মিলেমিশে যায়। পরিচারিকার, যৌনকর্মীর, মুখচোরা গৃহবধূর সঙ্গে এক আসনে বসে পড়ে উজ্জ্বল মেয়েটির গল্প যে হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল টেনে তোলার জন্য, ধরে ওঠার জন্য নয়। হ্যাঁ, আমি মাতৃদিবস পালনেও বিশ্বাস করি। মাতৃত্বের গৌরব, ভালবাসা, চাপ এমনকি আত্মত্যাগের কথা পেরিয়ে মাতৃদিবস তার আস্তিনের নীচে এমন অনেক বৈষম্য আর পিছিয়ে পড়ার গল্পও লুকিয়ে রাখে। ইটভাটায়, রাজমিস্ত্রির কাজে, আয়া সেন্টারে, নিষিদ্ধ পল্লিতে কাজ করা মেয়েদের রগরগে গল্পের পাশে, পাহাড়ে চড়া, বাইক চালানো, লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-গুলি চালানো দশভুজা বীরাঙ্গনাদের ঝকঝকে গল্পের পাশে এই ফুলটুসি রিসার্চ স্কলার, যে নাকি নিজের ফুলের মতো সন্তানের ঘায়েই মূর্ছা গিয়েছিল, তার কথা এই নারীদিবস আর মাতৃদিবস ছাড়া সারা বছরে শোনার সময় কই আমাদের! মাতৃত্বকে যে জীবনের আর পাঁচটা ঘটনার মতোই একটা ঘটনা হিসাবে দেখেছিল, সেও শেষ অবধি সেই ফাঁদেই আটকে গেল আর তার জন্য তার যে ক্ষতি হল সেটা ‘ফুটো পাইপ’-এর পরিসংখ্যান কিছু বাড়াল। এইটুকুই, ব্যস।

পুনশ্চ: মহিলাদের উপর থেকে মাতৃত্ব ও সন্তানপালনকালীন চাপ কিছুটা কমাতে বেশ কিছু বছর ধরে ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ (সিসিএল) নামে এক বিশেষ ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মাতৃত্বের জন্য কেরিয়ারে পিছিয়ে পড়া রুখতে গেলে ‘সিসিএল’ পুরুষের জন্যও নির্ধারিত থাকা উচিত। আছেও সামান্য মাত্রায়। সন্তানের ১৮ বছর বয়সের আগে এক জন পুরুষ সন্তানপালনের জন্য মোট ৩০ দিন ছুটি পেতে পারে। সম্প্রতি কলকাতার একটি কলেজ কোনও কারণ না দেখিয়েই এক জন পুরুষ শিক্ষকের সিসিএল-এর আবেদন অগ্রাহ্য করেছে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Society men Women Misogyny
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy