কর্নাটক হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ সে রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে হিজাব পরিধানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির বহুবিতর্কিত নির্দেশটিকে বহাল রাখল। এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার সিদ্ধান্তটির পিছনে মূলত তিনটি যুক্তি দিয়েছে আদালত। এক, একাধিক ধর্মীয় নথি পর্যালোচনা করে আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, হিজাব পরিধান ‘এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিসেস’ বা মৌলিক ধর্মাচরণ নয়। দুই, আদালত জানিয়েছে যে, হিজাব পরিধান সংবিধানের ১৯ (১)(ক) ধারা অনুযায়ী মতপ্রকাশের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত নয়; সংবিধানের ২১ ধারা, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার থেকে প্রাপ্ত (সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে) ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারেরও অন্তর্গত নয়। এবং তিন, আদালত জানিয়েছে যে, হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তটি চরিত্রে বৈষম্যমূলকও নয়, কারণ এই সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে সব ছাত্রীকেই অভিন্ন ইউনিফর্ম ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও বলা প্রয়োজন যে, তিনটি যুক্তির মধ্যেই যুক্তিগত এবং সাংবিধানিক ফাঁক রয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্নটিতে আদালত জানিয়েছে যে, স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম স্থির করে দেওয়া, এবং সেই ইউনিফর্ম পরতে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করাকে মতপ্রকাশের অধিকারের উপর একটি রিজ়নেব্ল রেস্ট্রিকশন বা যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ হিসেবে দেখাই বিধেয়। আদালতের এই যুক্তি নিয়ে আপত্তি তোলার সঙ্গত কারণ রয়েছে। ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মামলার ক্ষেত্রে জানিয়েছিল, কোনও বাধানিষেধ যুক্তিসঙ্গত কি না, তা নির্ভর করবে সেই নিষেধটি টেস্ট অব প্রোপরশনালিটি বা সমানুপাতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে কি না, তার উপর। সেই পরীক্ষার অন্যতম মাপকাঠি হল, যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, তা সব সম্ভাব্য বিকল্পের মধ্যে মতপ্রকাশের অধিকারের উপর ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করবে। পোশাকবিধি এবং ইউনিফর্মের ক্ষেত্রে ন্যূনতম হস্তক্ষেপের চরিত্র কী রকম হতে পারে, সেই প্রসঙ্গে ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি (নালসা) বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রিজ়নেব্ল অ্যাকমোডেশন বা যুক্তিসঙ্গত অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিল। এই কথাটির অর্থ হল, যেখানে কোনও একটি প্রশ্নে অধিকারের ভিত্তিতে দু’টি ভিন্নমুখী দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়, সেখানে ডিফল্ট বা প্রচলিত অবস্থা থেকে সবচেয়ে কম বিচ্যুত হওয়ার পথটি সন্ধান করাই বিধেয়। বর্তমান মামলাটিতে অবশ্য এই পন্থাটি অনুসৃত হয়নি। আদালত দৃশ্যত নালসা রায়ের দার্শনিক অবস্থানটিকে অগ্রাহ্য করেছে।
গোপনীয়তার অধিকারের প্রশ্নে আদালত যে যুক্তি পেশ করেছে, তা আরও ঘোরানো-প্যাঁচানো। আদালতের মতে, শ্রেণিকক্ষ যে হেতু কোয়েসাই-পাবলিক স্পেস বা উপ-গণপরিসর, এই ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকারের প্রয়োগ খুবই সীমিত। এই যুক্তিক্রমটি গোপনীয়তার অধিকারের অন্তর্নিহিত দর্শনকে অস্বীকার করে। কারণ, ব্যক্তিগত পরিসর ও গণপরিসরের মধ্যবর্তী ব্যবধানরেখাটি মুছে দেওয়া নয়, এই অধিকারের মূল কথা ছিল ব্যক্তিনাগরিকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধিকার— সেই অধিকারটির ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হলে উপরোক্ত যুক্তিসঙ্গত অন্তর্ভুক্তির নীতিটি মেনে করতে হবে। হিজাব নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্তটি বৈষম্যমূলক নয়, এই অবস্থানেও যুক্তির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। সবাইকে একই ইউনিফর্ম পরতে হবে, এই অবস্থানে আপাতদৃষ্টিতে কোনও প্রত্যক্ষ বৈষম্য নেই বটে, কিন্তু স্পষ্টতই পরোক্ষ বৈষম্য রয়েছে— এই ব্যবস্থাটি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর উপর বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব ফেলে।
এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিসেস বা মৌলিক ধর্মাচরণের প্রশ্নটি আরও অনেক বেশি সমস্যাসঙ্কুল। সংবিধানের ২৫(১) ধারা অনুসারে ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক অধিকার, এবং অবাধে ধর্মাচরণ, ধর্মপ্রচার ও প্রসারের যে অধিকার সব ভারতীয়র রয়েছে, ইদানীং তাতে হস্তক্ষেপের প্রবণতাটি ক্রমবর্ধমান। অন্য সব মৌলিক অধিকারের মতোই এই অধিকারটিও চূড়ান্ত নয়— ২৫(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে আইনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, স্বাস্থ্য, এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারের উপর নির্ভরশীল। সেই শর্ত অনুসারেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাত্রে লাউডস্পিকার বাজানোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৈধ। সংবিধানের ২৫(২) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রকে নাগরিকের ধর্মীয় পরিসরে হস্তক্ষেপের আরও বেশি অধিকার দেয়। ২৫(২)(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে, ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত যে কোনও আর্থিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনও সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ পরিসরকে রাষ্ট্র চাইলে খর্ব করতে পারে। ২৫(২)(খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে, সমাজকল্যাণ ও সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকার আইন তৈরি করতে পারে, এবং গণপরিসরে অবস্থিত যে কোনও হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে হিন্দুধর্মভুক্ত সব শ্রেণি ও গোষ্ঠীর জন্য খুলে দিতে পারে। অর্থাৎ, সংস্কারের জন্য রাষ্ট্র চাইলে ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বহু দূর অবধি খর্ব করতে পারে, বা ধর্মের পরিসরের বাইরে থাকা বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে যে, ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত কোন কাজটি ধর্মীয় বিষয়ের পরিধি টপকে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ের গণ্ডিতে পড়ে, আদালতের পক্ষে কী ভাবে তা সংশয়াতীত নিশ্চয়তার সঙ্গে স্থির করা সম্ভব, এবং সে বিষয়ে রাষ্ট্রের খবরদারির অনুমোদন দেওয়া সম্ভব? ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারতে আদালত এই কাজটি করে এসেছে, এবং এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম হয়েছে এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিসেস নামক মাপকাঠিটির। এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, মৌলিক ধর্মাচরণের মাপকাঠিটিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে— ধর্মের পরিসরটি ক্রমেই সঙ্কীর্ণতর হয়েছে, এবং রাষ্ট্রের খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণের কাজটি ক্রমে অবাধ হয়েছে। ১৯৫৪ সালের শ্রীরুর মঠ মামলায় বিচারপতি বিজন মুখোপাধ্যায় এই মৌলিক ধর্মাচরণের মাপকাঠিটি তৈরি করার সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, ধর্মগ্রন্থের বয়ান, এবং ধর্মানুসারীদের বিশ্বাস, এই মাপকাঠিতে উভয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ, যে আচরণ বা প্রথা মূলগত ভাবে ধর্মীয়, তাকেই মৌলিক ধর্মাচরণ হিসাবে দেখা হবে।
কিন্তু, ১৯৬০-এর দশকে বিচারপতি প্রহ্লাদ বালাচার্য গজেন্দ্রগডকরের দু’টি রায়ে— প্রথমটি ১৯৬১ সালে, অজমের শরিফ দরগার খাদিমদের বিষয়ে, এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬৩ সালে, নাথওয়াড়া মন্দির বিষয়ে— মৌলিক ধর্মাচরণের মাপকাঠিটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে। যে কোনও ধর্মীয় আচরণ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আদালত একটি ত্রিমুখী পরীক্ষার ব্যবস্থা করে— প্রথমে দেখতে হবে, যে রীতি বা আচরণটি নিয়ে প্রশ্ন, তা কি চরিত্রগত ভাবে ধর্মীয়; দ্বিতীয়, যদি প্রথম প্রশ্নটির উত্তর ইতিবাচক হয়, তা হলে দেখতে হবে, এই প্রথাটিকে কি ধর্মের মৌলিক বা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলা চলে; এবং তৃতীয়, দেখতে হবে যে, এই রীতির সমর্থনে আদালতের সামনে ধর্মের মূল নীতি এবং ধর্মাবলম্বীদের মনোভাবের সাক্ষ্য যথেষ্ট পেশ করা হয়েছে কি না। এবং, এই বিচারের প্রক্রিয়ায় আদালত দ্বাররক্ষকের ভূমিকা পালন করবে— ধর্মীয় বিশ্বাসের চাল থেকে বাদ দেবে কুসংস্কারের কাঁকর। এখানে এসেই আখ্যানটি বদলে গেল— যা ছিল কোনও রীতি চরিত্রগত ভাবে ধর্মীয় কি না, তা বিচার করার মাপকাঠি, এ বার তা হয়ে গেল সেই রীতিটি ধর্মের পক্ষে অপরিহার্য কি না, তা স্থির করার পন্থা। এবং, এই বিচারের অধিকার সম্পূর্ণত ন্যস্ত থাকবে আদালতের উপর।
ধর্মকে ক্রমেই আরও বেশি আমলাতান্ত্রিক করে তোলার প্রবণতা দেখা গেল ১৯৯০-এর দশকে, বিচারপতি কে রামস্বামীর বেশ কয়েকটি রায়ে (যার মধ্যে কাশী বিশ্বনাথ, পুরী জগন্নাথ, মাতা বৈষ্ণোদেবী সংক্রান্ত মামলা ছিল)। এতটাই যে, রাজীব ধবন ও ফলি নরিম্যান লিখেছেন, বিচারপতি রামস্বামী উৎসাহের সঙ্গে দেশের প্রধানতম কিছু ধর্মীয় কেন্দ্রের ‘জাতীয়করণ’-কে সমর্থন করেছেন। এসেনশিয়াল রিলিজিয়াস প্র্যাকটিসেস-এর পরিসর কতখানি সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে, তার আরও একটি উদাহরণ ১৯৮০-র দশকে কলকাতার রাস্তায় আনন্দমার্গীদের ‘তাণ্ডব’ করার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান। নেহাত আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নেই এই মামলার ফয়সালা হতে পারত। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট মৌলিক ধর্মাচরণের প্রসঙ্গে ঢুকেছিল। আনন্দমার্গীদের ‘তাণ্ডব’ প্রথাটি যে হেতু বেশ নতুন, তাকে আদৌ মৌলিক ধর্মাচরণ বলা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছিল শীর্ষ আদালত। স্পষ্টতই এতে চাপা পড়ে গিয়েছিল একটি সত্য— সংগঠন হিসাবে আনন্দমার্গীরাই মাত্র কয়েক দশকের পুরনো, ফলে তাঁদের কোনও ধর্মাচরণকেই মৌলিক ধর্মাচরণের সংজ্ঞায় বৈধ বলা অসম্ভব।
এই ধরনের উদাহরণগুলি বলছে যে, কোনটিকে মৌলিক ধর্মাচরণ বলা যাবে, ধর্মীয় আর ধর্মনিরপেক্ষ রীতির মধ্যে আদর্শ সীমারেখাটিই বা কোথায়— সে বিষয়ে তর্কের মাত্রা বাড়ছে। কোনও বহুমাত্রিক বিবাদে, বিশেষত যে বিবাদের নিষ্পত্তির অতি সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রয়েছে, এমন একটি বিতর্কিত মাপকাঠিকে বিচারের কাজে ব্যবহার করা যায় কি না, সেই তর্ক ওঠা স্বাভাবিক।
আইনবিদ্যা বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy