বুকার-জয়ী ঝুম্পা লাহিড়ী ইটালীয় ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষ। ২০১৫-য় ইন আদার ওয়ার্ডস বলে তাঁর একটি মূল ইটালীয় ভাষায় বই প্রকাশিত হয়। একটি ‘অন্য’ ভাষা শিক্ষার আনন্দের কথা বলেছেন তিনি সেখানে। বইটির সূচনায় ইটালীয় লেখক ও ভাষা-বিশেষজ্ঞ আন্তনিয়ো তাবুক্কির একটি এপিগ্রাফ: “আমাকে একটা অন্য ভাষা ব্যবহার করতে হল, এমন একটা ভাষা যেটা স্নেহের ছায়া, চিন্তার খোরাক।”
ঝুম্পা চমৎকার বর্ণনা করেছেন কী ভাবে, বাংলা ও ইংরেজি— মাতৃভাষা ও অর্জিত দ্বিতীয় ভাষার মধ্যে টানাপড়েন থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি একটি তৃতীয় ভাষা ইটালীয়র শরণাপন্ন হলেন। কারণ এই তৃতীয় ভাষাটি একদম দাবিহীন, চাপহীন। এটি তাঁর স্বাধীন নির্বাচন। বাংলার মতো নিরন্তর শিকড়ের আকুতি, বা ইংরেজির মতো ক্রমাগত এলিটিজ়মের ফতোয়া, এই দুইয়ের থেকে মুক্ত। প্রথম ভাষা যদি হয় মা, দ্বিতীয়টি তবে সৎ মা এবং তৃতীয়টি হবে মনের মানুষ। তাই এই তৃতীয় ভাষা নির্বাচনের মধ্যে একটা পলায়নপর মনোবৃত্তি উঁকি দেয়। আফিমের মৌতাতে লড়াইয়ের ময়দান ভুলে থাকার উপায়।
কিন্তু মৌতাতের সুখ যে লড়াইয়ের ময়দানেও পাওয়া সম্ভব, তার উজ্জ্বল নিদর্শন সদ্য বুকারজয়ী আর এক ভারতীয় গীতাঞ্জলি শ্রী (ছবি)। হ্যাঁ, মূল হিন্দিতে লেখা যাঁর উপন্যাস রেত সমাধি, ইংরেজি অনুবাদে টুম্ব অব স্যান্ড বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি পেল, এনে দিল ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার’ পুরস্কার। ভারতীয় সাহিত্যের এমনিতেই ভুবনজোড়া খ্যাতি। সেই খ্যাতির ভাগ পেল এ বার ভারতীয় ভাষার সাহিত্যও।
রচনাকারের সঙ্গে রচনা ও তার ভাষার সম্পর্কে কিছু কথা মনে ভাসছে এই বই প্রসঙ্গে। তবে যে কোনও রচনাকার নন। সৃষ্টিশীল রচনাকার, যাঁদের সৃষ্টিকর্ম ভারতের বাইরে। যাঁদের লেখা স্থানীয় বৃত্ত ছাড়িয়ে, গ্লোবাল পাঠকসমাজকে আকর্ষণ করতে পেরেছে। ইউটিউবে গীতাঞ্জলির একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতা শুনছিলাম। বিষয়, কেন হিন্দিতে লিখি? অ্যাকাডেমিক ইংরেজিতে লেখা অসাধারণ এক উপস্থাপনা। সেখানেই জানতে পারি দিল্লিনিবাসী গীতাঞ্জলি ইতিহাসের পিএইচ ডি এবং অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। বাবা ছিলেন পদস্থ আমলা।
বিস্মিত হতে হয়। কারণ তিনি অনায়াসে ইংরেজি আখ্যান-রচনায় নিজেকে প্রস্তুত করে আরও সহজে আন্তর্জাতিক অঙ্গন আলো করতে পারতেন। তা না করে, কেন ভারতীয় ভাষার পথ ধরলেন লেখিকা?
লেখিকার অনুযোগ, সমাজের চোখে এই নির্বাচন একাধারে নির্বোধ এবং দুঃসাহসিক, অতএব উদ্ভট, ইগজ়টিক। কিন্তু তাঁর দাবি, দেশপ্রেম, বা বঞ্চিতের প্রতি সহমর্মিতা, এ সব কোনও প্রণোদনাই এর পিছনে কাজ করেনি। হিন্দির উদ্ভব হয়েছিল ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আধিপত্যের বিপরীতে ভারতের আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণের দায় থেকে। আধুনিক হিন্দি পারসিক, সংস্কৃত, আরবি, অওয়ধি, ভোজপুরি, মৈথিলী ইত্যাদি নানা ভাষার সংমিশ্রণ থেকে তার সৃষ্টি। অর্থাৎ এক বহুবাচনিক, বিচিত্র ও অশুদ্ধ ভারতের উপযুক্ত প্রতিনিধি সে। ইদানীং, যদিও ভারতের এই বহুস্বরের কণ্ঠরোধ করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। মোটামুটি এই ভাবে গীতাঞ্জলি লড়াইয়ের ছবিটি নিখুঁত তুলে ধরলেন। সেই ময়দানে এক দিকে যেমন হিন্দির লড়াই ইংরেজির সঙ্গে, অন্য দিকে প্রাদেশিক ভাষার উপর হিন্দির দাদাগিরি।
কথায় কথায় প্রেমচন্দের সমাজবাস্তবতার কথাও এল। এল প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কিন্তু ভাষা-সাহিত্যিক প্রতর্কে ও ক্ষমতার টানাপড়েনে জেরবার লেখিকার প্রজন্মকে নিঃশ্বাসের বাতাস নেওয়ার উপায় খুঁজতে হল। কোথায়?
পরের কথাগুলিতে যেন হুবহু ঝুম্পা লাহিড়ীর কণ্ঠস্বর। স্থানকালের ফারাকটুকু বাদ দিলে আমেরিকার ঝুম্পার হৃদয়ের সাক্ষাৎ বোন যেন দিল্লির গীতাঞ্জলি। ঝুম্পা বলেছেন, “আমার প্রথম ভাষা বাংলা, বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়া, চার বছর বয়েস অবধি, যত দিন না আমেরিকায় স্কুলে ভর্তি হলাম। সেই ভাষাতেই আমি স্বচ্ছন্দ… আর ইংরেজি? তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎটি বড় কঠিন, বিশ্রী।” কারণ এই ভাষার কঠিন শৃঙ্খল শিখিয়েছিল স্কুলের শৃঙ্খলা। আর বাংলা? দজ্জাল পর্দানশিনার মতো, লোকচক্ষু থেকে দূরে, পর্দার আড়াল থেকে তাঁকে ক্রমাগত স্নেহের শাসন করত।
আর গীতাঞ্জলির অভিজ্ঞতা? শৈশবে কনভেন্ট স্কুলে ইংরেজির আধিপত্য, কিন্তু বাড়িতে, পাড়ায় হিন্দির রমরমা। স্কুলে শেখানো হয় প্রাথমিক সরল এক হিন্দি। ইচ্ছে সত্ত্বেও পরে হিন্দিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ঘটেনি। স্কুলের হিন্দিশিক্ষা যেমন নিস্তেজ, ইংরেজি শিক্ষাও তেমন পলকা। এর থেকে পরিত্রাণ? ওই ঘরোয়া আটপৌরে হিন্দি। ক্ষমতা-কেন্দ্রের বাইরের। যে হিন্দিতে কথা বলে বাড়ির মালি, রাঁধুনি, দারোয়ান বা বাইরের নাপিত, মুচি, দর্জি। যে হিন্দি দাদিমার মুখ-বাহিত হয়ে পুরাণ-কাহিনি থেকে ঝরে পড়ে। নাটক-পালা, কবিতা বা গানের আসর থেকে নেমে আসে যে মৌখিক ধ্রুপদী হিন্দি।
ভাষা ও সাহিত্যের এই প্রান্তিকতা গীতাঞ্জলিকে আকৃষ্ট করেছিল হিন্দি সাহিত্যের প্রতি। হিন্দি তাঁর শৈশবের স্মৃতির জিম্মাদার, লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর ফেলে আসা জীবনকে সুতো দিয়ে টেনে তোলার সহায়। ইংরেজি লৌকিক সমাজজীবনের সঙ্গে সংযোগমাধ্যম, হিন্দি অন্তর্গত ব্যক্তিজীবনের ধূসরতার আহ্বায়ক। হিন্দির অপ্রাতিষ্ঠানিকতার ভিতর তাঁর শৈশবের পুনরুদ্ধার।
ঝুম্পাও বলছেন তাই। ইংরেজি হল তাঁর বর্তমান, যার উপর তিনি দাঁড়িয়ে। বাংলা অতীত, ইটালীয় ভবিষ্যৎ। শেষোক্ত ভাষা দু’টি তাঁর শৈশব ও আনন্দের উৎস। যে স্বপ্ন-ভাষার সন্ধানে ঝুম্পাকে তৃতীয় ভাষার কাছে যেতে হয়, গীতাঞ্জলি তাকে পেয়ে যান মাতৃভাষা হিন্দির মধ্যেই। হিন্দির মধ্যেই তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক, বিদ্রোহী পরিসর খুঁজে নেন। তবে মাতৃভাষার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কটি ঠিক সরাসরি নয়, ইংরেজির প্রতিক্রিয়াজাত।
বিশ্বায়ন বোধ হয় ভাষাবোধকে লেখকের মধ্যে দ্বিধা ও সঙ্কটের মধ্যে এনে ফেলেছে। বাধ্য করেছে লেখককে এর সঙ্গে ‘ডায়াস্পোরা’, কল্পিত হারানো দেশ ও দেশান্তর, সীমান্ত, উপান্তবর্তিতার প্রসঙ্গগুলি জুড়ে দিতে। আশ্চর্য, প্রবাসী ঝুম্পার ক্ষেত্রে দেশান্তর যেমন ব্যক্তিগত সঙ্কট, স্বদেশে স্থিত গীতাঞ্জলিরও তাই। ভৌগোলিক অনুষঙ্গ ছাড়িয়ে, বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ের আত্মপরিচয়ের সঙ্কটের ইঙ্গিতবাহী। নির্বাসিত সংখ্যালঘুর ধারণাটিকে সাংস্কৃতিক পরিসরের ভিতরে এনে ফেলা যায় এ ভাবে।
শ্রীর কাহিনিতে যে সীমান্তের কাঁটাতারের উল্লেখ, তা তো শুধু দুই দেশের মধ্যে অবস্থিত নয়। বরং ছিদ্রবহুল সেই কাঁটাতারের বেড়া ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, লিঙ্গ এবং পরিশেষে ঘর ও বাহির, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যেও সক্রিয়।
ঝুম্পা ও গীতাঞ্জলির প্রকাশের ভাষা হয়তো ভিন্ন, কিন্তু ভাষা ও রচনা সম্পর্কে তাঁদের চিন্তার অভিমুখ বোধ হয় তা নয়।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy