প্রতীকী ছবি।
গত বছর সংসদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে যখন পেগাসাস, কৃষি আইন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিরোধীরা শোরগোল করছেন, সেই সময়ে সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয়ে গেল ১২৭তম সংবিধান সংশোধন বিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো পুনরায় সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর অন্যান্য সম্প্রদায়ের (ওবিসি) চিহ্নিতকরণ ও তালিকা তৈরির ক্ষমতা ফিরে পেল। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাজ্যের এই ক্ষমতা খর্ব হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ মরাঠা সংরক্ষণ প্রসঙ্গে রায় দেয় যে, কেবলমাত্র অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য গঠিত জাতীয় কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এখন থেকে ওবিসি-র তালিকা তৈরি করবে সরকার। ওই রায়েই ১৯৯২ সালের ইন্দ্র সাহানি মামলার রায় অনুসরণ করে পুনরায় সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ শতাংশ স্থির করা হয়। যদিও ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু বা মহারাষ্ট্রের মতো অনেক রাজ্য এই সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। আবার ২০১৯-এ ১০৩তম সংশোধন অনুসারে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ চালু হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ফের জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি উঠেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের এক সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি জানিয়েছেন, বামপন্থী দলগুলিও এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সমস্ত দাবিকে নস্যাৎ করে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে বলেছে যে, জাতিগত জনগণনা না করার নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, সরকার জাতিগত জনগণনার বিরুদ্ধে।
১৯৩১ সালে শেষ বার জাতিগত জনগণনা হয়েছিল। সংবিধান তৈরি হওয়ার পর দশ বছর অবধি সংরক্ষণ ব্যবস্থা বহাল রাখার কথা বলা হয়েছিল। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সংরক্ষণ ব্যবস্থা চলেছে, শুধু তা-ই নয়, নতুন নতুন গোষ্ঠী সংরক্ষণের আওতায় আসতে চাইছে। এতে এটাই প্রমাণিত হয়, দেশে জাতিগত বৈষম্য এখনও বর্তমান।
তফসিলি জাতি, জনজাতির বাইরেও সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ১৯৫৩ সালে কাকাসাহেব কালেলকার-এর নেতৃত্বে প্রথম জাতীয় অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন গঠিত হয়। কমিশন তার রিপোর্টে (১৯৫৫) মোট ২৩৯৯টি অনগ্রসর সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে তাদের জন্য ৭০ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করে। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পত্রপাঠ এই সুপারিশ খারিজ করে। এর পর ১৯৭৮-এ বিন্ধ্যেশ্বরী প্রসাদ মণ্ডলের সভাপতিত্বে গঠিত দ্বিতীয় কমিশন ৩৭৪৩টি অনগ্রসর সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে, যা দেশের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। তবে সংরক্ষণের প্রশ্নে কমিশন ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করে। আশির দশকের গোড়ার দিকে এই রিপোর্ট জমা পড়ে, কিন্তু পরপর দু’টি সরকার এই রিপোর্ট নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। অবশেষে ১৯৮৯-এ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ ওই বিস্মৃতপ্রায় সুপারিশের রূপায়ণে উদ্যোগী হন। তার বিরোধিতা করে দেশ জুড়ে উচ্চবর্ণদের আন্দোলন গড়ে ওঠে, যাতে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপিও শামিল ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের আজকের অবস্থান সেই নীতিরই এক ধারাবাহিক অনুবর্তন মাত্র।
ওবিসি সংরক্ষণ চালু হওয়ার পর কেটে গিয়েছে তিন দশকেরও বেশি সময়। এই সময়পর্বে সংরক্ষণ অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নে কতটা কাজে এসেছে, কোন কোন জাতি এখনও পশ্চাৎপদ, এই সমস্ত প্রশ্নের একটা সার্বিক মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। জাতিগত গণনা না করলে এই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না, তৈরি করা যাবে না উপযুক্ত নীতি। আমরা দেখেছি, মহারাষ্ট্রে মরাঠা, গুজরাতে পটেল, হরিয়ানার জাঠ, রাজস্থানে গুর্জর প্রভৃতি সম্প্রদায় সংরক্ষণের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নেমেছে, যা অনেক সময় হিংসাশ্রয়ী হয়েছে।
২০১১ সালে তদানীন্তন ইউপিএ সরকার আর্থ-সামাজিক ও জাতিভিত্তিক জনগণনা করলেও জাতিভিত্তিক গণনার রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি, বর্তমান এনডিএ সরকার জানিয়ে দিয়েছে তারা ওই রিপোর্ট প্রকাশ করবে না। এনএসএসও-র ২০১৮-১৯ সালের কৃষিসমীক্ষা অনুসারে গ্রামীণ ভারতে প্রায় ৩৪ শতাংশ মানুষ তফসিলি জাতি অথবা জনজাতিভুক্ত, পাশাপাশি ৪৪ শতাংশ পরিবার ওবিসি-র অন্তর্গত। বাকিদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি, তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা খুবই কম। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও বিভিন্ন পরিষেবা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত পেশা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সম্পদের মালিকানা সবেতেই সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। জাতিগণনা হলে এই বাস্তব প্রতিষ্ঠা পাবে। তাই উচ্চবর্ণের তরফে এর বিরোধিতা স্বাভাবিক।
মণ্ডল কমিশনের জেরে আশির দশকের শেষভাগ ও নব্বইয়ের দশকে জাতপাত-ভিত্তিক রাজনীতি বিশেষ মাত্রা পায়। বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো হিন্দি বলয়ের বড় রাজ্যগুলিতে আরজেডি, বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টির মতো জাতপাত ভিত্তিক দলগুলোর সাফল্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। কিন্তু ওই দলগুলির অকুশলী প্রশাসন, দুর্নীতি, এবং ভূমি সংস্কারের মতো মৌলিক সমাধানে অনাগ্রহের জন্য ক্রমশ মানুষের আশাভঙ্গ হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যেও সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতাকে কৌশলে কাজে লাগিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। বিগত কয়েক বছরে বিজেপি পশ্চাৎপদ শ্রেণি তথা জাতির যে সমর্থন পেয়েছে, তা কোনও সামাজিক ন্যায়ের কর্মসূচি সামনে রেখে পায়নি। বিজেপি এক অখণ্ড হিন্দুত্বের ধারণা সামনে এনেছে, যা আত্তীকরণ করে নিয়েছে জাতপাতের রাজনীতিকে।
এই বৃহত্তর হিন্দুত্বের যোগ্য দোসর হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা সকল হিন্দুর ঐক্যের কথা বলে কিন্তু দলিতদের কেন নির্যাতিত হতে হয় সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সামাজিক ন্যায়কে দূরে সরিয়ে রেখে, উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্ণের সামাজিক বিভাজনকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে, নিম্নবর্ণের মধ্যে বিভিন্ন জাতিকে কৌশলে লড়িয়ে দিয়ে উচ্চবর্ণের আধিপত্য বজায় রেখে যে নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় তা বার বার দেখা গিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ হিন্দুত্বের আর এক ভিত্তি ধর্মীয় বিদ্বেষ, যা সামাজিক ন্যায়ের লড়াই, আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিমুখকে ঘুরিয়ে দেয় কোনও বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর দিকে। বলা হয়, সব দুর্দশার জন্য নাকি তারাই দায়ী।
এই ভাবে হিন্দু সমাজকে একটা সমস্বত্ব সমাজ দেখানোর যে অপচেষ্টা চলছে, যে মিথ্যার নির্মাণ গড়ে উঠেছে, তাকে ভেঙে দিতে পারে জাতিগত গণনা। সেই জন্যই জাতিগণনার প্রতি বিজেপির এই সর্বাত্মক বিরোধিতা। বিদ্বেষের রাজনীতির এই কানাগলিতে আজ হারিয়ে গিয়েছে আম্বেডকরের জাতিবিলোপ, ফুলে বা পেরিয়ারের ব্রাহ্মণ্যবিরোধিতার দর্শন। তাঁদের সেই আদর্শের দীপশিখা জ্বালিয়ে বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতির নির্মাণই হয়ে উঠুক এই সময়ের দাবি, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy