কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় যখন মনুষ্যকৃত বহু অনুচিত কাজের সঙ্গে মিলে ভয়াবহ মাত্রা নিয়ে আছড়ে পড়ে, তখন চার দিকে সাধারণত ঘুম ভেঙে ওঠার এক মহা কোলাহল হয়। যেন লঙ্কার মহাযুদ্ধের আপৎকালে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ। বিপর্যয় যত বড় হয়, নিদ্রাভঙ্গের কোলাহলও তত উচ্চকণ্ঠ। ইয়াস-উত্তর সুন্দরবন-মেদিনীপুরের অবস্থা দেখে এই কথা আবার মনে হচ্ছে। বারো বছর আগের আয়লা সাইক্লোনের পর থেকে এই ইয়াস অবধি অন্তত চারটি ছোট-বড় সমুদ্রতুফান আছড়ে পড়েছে গঙ্গা নদীর এই সাগরমিলন অঞ্চলে। আয়লায় কোমর ভেঙে যাওয়া এই এলাকার অর্থব্যবস্থা এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তবু প্রতি বার আমরা দেখছি আগের বারের চেয়েও বড় জনমণ্ডলীকে সর্বস্বান্ত হতে— ঝড়-পরবর্তী ত্রাণ ও সমবেদনা সত্ত্বেও, আবার। ইতিমধ্যেই শুনছি, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে এই সব তুফান আসার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়বে।
কোনও বিপদের সম্ভাবনা যদি আগে থেকে জানা থাকে, তা নিবারণের চেষ্টা করা হয় দু’ভাবে— তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘস্থায়ী। উপকূল ও মোহনা অঞ্চলে তাৎক্ষণিক সাবধানতা, ত্রাণ ইত্যাদির যথেষ্ট ব্যবস্থাই ইদানীং দেখা যাচ্ছে। তবু শঙ্কা হয় যে, স্থায়ী কোনও সমাধানের প্রতি বোধ হয় ততটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অন্তত সেই বিষয়টা নিয়ে সচেতনতা জরুরি, যদি সুন্দরবনের অস্তিত্ব-সমস্যার কোনও অপেক্ষাকৃত স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতেও হয়।
সকলেই জানেন যে, সুন্দরবন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপকূল এলাকা নয়, এটি গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহের সমুদ্রমোহনা অঞ্চল। দু’টি ভিন্ন আর বিশাল প্রাকৃতিক শক্তি— ভারতের এগারোটি ছোট-বড় নদী-সংসার বাহিত মিঠেজলের বিশাল ভান্ডার আর তার সঙ্গে সেই সকল ধারার বয়ে আনা বিপুল পলিমাটি এক প্রকাণ্ড এলাকা জুড়ে মিলিত হয় নোনাজলের অকূলে। দুই জল, তার স্রোতের রূপ ভিন্ন। তার স্বভাব ভিন্ন, ভিন্ন চলন। সেই ভিন্নতা যখন পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, সেই বিশাল, জটিল, সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই তৈরি করেছে বিশ্বের বৃহত্তম নদীমোহনা অঞ্চল বলে খ্যাত সুন্দরবনকে।
হিমালয় পাহাড়ে ঝরে পড়া বৃষ্টিজল অসংখ্য ছোট-বড় ধারায় যে প্রধান নদীগুলোতে নেমে এসেছে, গঢ়বালে দেবপ্রয়াগের পর থেকে তা-ই গঙ্গারূপে ভারতের সমতলে প্রবাহিত। উপনদী-সংসার বেয়ে উত্তর ভারতের পূর্ব-পশ্চিমে বর্ষিত মৌসুমি বৃষ্টির জলও নেমেছে গঙ্গাধারাতেই। এই জানা কথার সঙ্গে অন্য একটি কথা প্রায়ই আমরা বিস্মৃত হই— নদীবাহিত পলিমাটির কথা। বিশেষত, ভারতের মতো মাটির পাহাড় হিমালয় থেকে যাত্রা শুরু করে নদীবিধৌত বিশাল সমভূমি অঞ্চল হয়ে আসা নদীরা কতখানি পলিমাটি নিয়ে আসে, সেই কথা। মাটির পাহাড় অরণ্যাবৃত হিমালয় থেকে আকরিক ও হিউমাস-সমৃদ্ধ মাটি বহন করে এনে ভারতের বিস্তৃত দোয়াব অঞ্চল তৈরি করেছে গঙ্গা ও তার সহযোগী নদীগুলি। প্রতি বর্ষায় তীব্র গতিতে ছুটে নামা জল নদীর খাত গভীর করে নদীবক্ষে জমে থাকা পলি ঠেলে নামিয়েছে সমুদ্র-সংলগ্ন মোহনায়। এগোনোর গতি ধীর হলে মানুষ যেমন ভারী বোঝা নীচে নামিয়ে রাখে, দীর্ঘ সমভূমি পার করে শ্লথগতি নদী পলি নামিয়ে রাখে স্রোতের চলনানুসারী নির্দিষ্ট জায়গায়। তৈরি হতে থাকে ব-দ্বীপ, আর নদীর মুখ ধীরে ধীরে প্রস্থে বাড়ে। সুন্দরবন বড় হয়, পলিমাটির প্রাধান্যে নোনাজল মিশে অমন ঘন সবুজ উদ্ভিদবৈচিত্রের ধাত্রী হয়। পলিমাটির বিপুল সঞ্চয় জলের ধাক্কায় বঙ্গোপসাগরের ভিতর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
এখানে গঙ্গানদীর চলনপথে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ছোটনাগপুর থেকে আসা দামোদরের। মাত্র চারশো কিলোমিটারের মধ্যে মালভূমি থেকে উপকূল এলাকায় পৌঁছনো এই দ্রুতগতি নদী গঙ্গায় মিশত মোহনার মাত্র কয়েক কিলোমিটার আগে। প্রতি দিন সমুদ্রের জোয়ারে গঙ্গার শাখানদীগুলির মুখ দিয়ে যে বালি ঢুকত, যে জমা পলি সুরধুনীর পথ রোধ করত, দামোদর হড়পা বানের ধাক্কায় তা ঠেলে দিত বঙ্গোপসাগরের গভীর অবধি। সেই জন্য সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলের নীচে মাটির ঢাল কম। সেই অপেক্ষাকৃত অগভীর জল ভেদ করে সূর্যালোক নীচের পলিমিশ্রিত মাটিতে পৌঁছয়। জলের নীচের জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্রকে সুন্দরবনের মুকুট করে তোলে। লক্ষ বছর ধরে গঙ্গানদীর এই জলমাটি খেলা ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। সেই সূক্ষ্ম আর বিশাল প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হতে শুরু করেছে গত সাত দশকে।
গঙ্গার পথ বাধার পর বাধায় আকীর্ণ। এক দিকে তার জলের সম্ভার কমে গিয়েছে অনেক, অন্য দিকে মাটির বোঝা অ-বহ হয়ে উঠেছে।
হিমবাহের জন্মঘর থেকে যে জলের প্রসাদ নিয়ে নদী নীচে নামত আর বড় হত, হিমালয়ের ছোট-বড়-মাঝারি সমস্ত স্রোতধারায় বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে সেই জল হরণ করা হয়েছে। প্রতি বছর বৃষ্টির দাক্ষিণ্য যে জলের ভান্ডার ঢেলে দেয় আকাশ থেকে, যা মাটিকে সরস রাখে আর নদীকে সচল, দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ পাম্প আর সেচখাল সেই জলকেও সরিয়ে নিয়েছে নদীর স্বাভাবিক খাত ও দু’পাশের মাঠ থেকে। সুন্দরবনের নদীগুলো গঙ্গাজলের, মিঠেজলের প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে একটু একটু করে। বিদ্যা, মাতলা, রায়মঙ্গল-সহ ছোট-মাঝারি প্রায় সব নদীতে যে জল দেখা যায়, তা খাঁড়ির নোনাজল।
ঔপনিবেশিক আমলের অরণ্যনাশকেও অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছে হিমালয়ের অরণ্যধ্বংস। হাজার বছরের প্রাচীন অরণ্যের আঙুল শুধু মাটিকে বেঁধে রাখত না, নদীকে দিত তার ধৌতজলের সমৃদ্ধি। দেশ জুড়ে নদীসন্তানরা আর্তনাদ করছেন: ‘গঙ্গা এ দেশের প্রাণধারা। তাকে রক্ষা করো।’ অন্তত দশ জন সন্ন্যাসী ঘোষিত ভাবে অনশনে ধীরমৃত্যু বরণ করলেন শুধু এই দাবিতে: ‘গঙ্গাকে বাঁধমুক্ত করো। গঙ্গাকে রক্ষা করো।’ গঙ্গা রক্ষার নামে যাঁরা প্রচুর টাকা ভিক্ষা আনেন, তাঁদের কান পর্যন্ত দেশের এই চূড়ান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ সঙ্কটবার্তা পৌঁছল না। ফলে, হিমালয়ের ভূস্খলনজাত মাটির সঙ্গে সমতলে যুক্ত হচ্ছে উচ্চফলনশীল চাষের দরুন সারা বছর কর্ষিত আলগা হয়ে থাকা মাটি। সাধারণ বৃষ্টিতেও যা নেমে আসে নদীতে। নদীর দু’পাশের প্রাকৃতিক ঢাল গিয়েছে নষ্ট হয়ে। তৃণভূমিও বনাঞ্চলের মতোই বিরলদর্শন। সমস্ত অববাহিকা থেকে বেহিসাব মাটি নেমে আসছে গঙ্গাবক্ষে। জলমাটির স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা লোপ পেয়েছে। তার ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে।
আজও এই দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য গঙ্গার উপর নির্ভরশীল। গঙ্গা আমাদের জীবনদাত্রী। তাকে সাপের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু প্রকাণ্ড সাপের মাথা যদি কেউ ঠেসে ধরে, তা হলে তার বিশাল লেজের আছাড়িপিছাড়ি সহ্য করতেই হবে।
আমরা বাংলায় আছি দেশের দু’টি বৃহৎ নদীসংসারের লেজের নাগালে। গঙ্গা আর দামোদরের মৃত্যু-সংক্ষোভ আমাদের সহ্য করতে হবে সবচেয়ে বেশি। সুন্দরবন আজ তারই মুখোমুখি। যদি সুন্দরবনে ঘন বসতি না থাকত, তা হলে জীবন-জীবিকার এমন মর্মান্তিক দুর্দশা ঘটত না। কিন্তু তাতে সুন্দরবন বাঁচত কি? গঙ্গায় মিঠেজলের প্রবাহ না থাকায়, জীবজগতের আধার যে পলিমাটি, তা বাঁধের পর বাঁধের পিছনে আটকা পড়ে উজানে অল্প বৃষ্টিতে প্রলয়ঙ্করী বন্যা ঘটায়। সেই কারণে সুন্দরবনে পলির বদলে জোয়ারের দৈনিক বালিতে নদী, খাঁড়ি ও সাগরের জলের নীচ ক্রমশ উঁচু হয়ে ওঠায় তা ভাঙতেই থাকত। কোনও ‘মজবুত বাঁধ’ই প্রাকৃতিক শক্তির চেয়ে মজবুত হয় না। তার সঙ্গে ‘মুহূর্তের লোভ’ দিয়ে বাদাবন শেষ করায়, সমুদ্র ও ভূমির মিলনস্থলে জলবালির এলাকা দখল করে পাকা রাস্তা, বড় বাড়ি তৈরি করায় প্রকৃতির ছন্দ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এই সুছন্দ শৃঙ্খলাগুলি কোটি কোটি বছরে তৈরি হয়েছে। তাকে আমূল ধ্বংস করে উপর থেকে মেরামত করা যাবে না। বাংলা, নিম্নবঙ্গ নানা রকম ছেলেভোলানো খেলনার সান্ত্বনায় পরের পর তুফানে আরও, আরও ধ্বংস হবে। রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতা যখন দুর্নীতিকেই অর্থনীতির উপায় বলে মানে, তখন নদীপ্রান্তের মানুষদের চরম দুর্দিন।
এই প্রাকৃতিক উচ্ছৃঙ্খলতাকে রুখতে হলে, কম করতে হলে, এর মূল সঙ্কটের চিকিৎসা দরকার। গঙ্গাকে রক্ষা না করলে তা করা যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy