Advertisement
E-Paper

অগণিত প্রাণ যাঁর দান

হ্যারিসন জন্মেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ। যখন বছর পনেরোর কিশোর, তখন তাঁর বুকে একটি বড় অস্ত্রোপচার হয়। সে সময় তাঁকে রক্ত দিয়ে প্রাণে বাঁচান এক অপরিচিত।

রুমি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫ ০৬:৪৯
Share
Save

চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন আর্ম’। কোনও জিনিস খুব দামি বোঝাতে সোনার তুলনা টানা হয় বটে, তবে প্রাণ যদি হয় সোনার চাইতেও দামি, তা হলে এই ‘স্বর্ণবাহু’ রক্তদাতার হাতের মূল্য ছিল জাগতিক হিসেবের বাইরে। আঠারো বছর থেকে একাশি বছর, এই ছয় দশক ধরে নিয়মিত রক্তদান করেছিলেন তিনি, মোট এগারোশো বারেরও বেশি। তাঁর রক্তে একটি বিরল ‘অ্যান্টিবডি’ ছিল, যা থেকে তৈরি ওষুধে বহু গর্ভস্থ ভ্রূণ প্রাণে বেঁচে যায়। অস্ট্রেলিয়ার সরকার তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে তাঁকে জাতীয় সম্মানে ভূষিত করেছে। জেমস ক্রিস্টোফার হ্যারিসনের (১৯৩৬-২০২৫) প্রয়াণে তাঁর প্রতি সম্মান প্রকাশ করেছে বহু দেশ।

হ্যারিসন জন্মেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ। যখন বছর পনেরোর কিশোর, তখন তাঁর বুকে একটি বড় অস্ত্রোপচার হয়। সে সময় তাঁকে রক্ত দিয়ে প্রাণে বাঁচান এক অপরিচিত। সেই রক্তদাতা তাঁকে অনুরোধ করেন, সময় হলে তিনিও যেন রক্তদান করে আর এক জনের জীবন বাঁচান। সুচ ফোটানোতে বড্ড ভয় পেতেন জেমস। তা সত্ত্বেও বয়স আঠারো বছর পেরোলে ১৯৫৪-তে প্রথম রক্তদান করেন। ভয় কেটে গেলে এর পর থেকে মাঝে মাঝেই রক্তদান করতে থাকেন।

প্রায় এক দশক পর জানা গেল, তিনি বিরল রক্তের অধিকারী। তাঁর রক্তে রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী অ্যান্টিবডি— রোগ প্রতিরোধক জৈবকণা। যা দিয়ে অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন তৈরি করা যায়। সেই ইনজেকশন বহু শিশুর প্রাণ রক্ষা করতে পারবে। এই তথ্য জেনে জেমস উজ্জীবিত হন। সেই থেকে দু’সপ্তাহের ব্যবধানে নিয়মিত রক্তরস দান করতে শুরু করেন। একাশি বছর বয়স অবধি সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। বহু জীবন বাঁচিয়ে অষ্টাশি বছরে একটি নার্সিং হোমে নিজের জীবন থেকে বিদায় নিলেন বিপত্নীক হ্যারিসন।

অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন কেন এত জরুরি? কেন তা জীবনদায়ী? বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি আরএইচ নেগেটিভ হয়, আর সেই মায়ের সন্তান আরএইচ পজ়িটিভ হয়, তা হলে দ্বিতীয় সন্তানটি মাতৃগর্ভেই ‘হিমোলাইসিস’ নামের মারাত্মক রক্তের অসুখে আক্রান্ত হয়। তার কারণ, যে কোনও শিশু জন্মানোর সময়, বা অন্য কোনও ভাবে, সন্তানের কিছু রক্ত মায়ের শরীরে চলে যায়। মায়ের রক্ত আরএইচ নেগেটিভ হওয়ার অর্থ তাঁর লোহিত রক্তকণিকায় অ্যান্টিজেন নেই। তাই সন্তানের আরএইচ পজ়িটিভ রক্তের অ্যান্টিজেন মায়ের রক্তে অচেনা। সেই অচেনা অ্যান্টিজেন-এর মোকাবিলা করতে মায়ের শরীর প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এতে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধে হয় না। সমস্যা দেখা দেয় মা আবার গর্ভধারণ করলে। মায়ের শরীরে জমে-থাকা অ্যান্টিবডি ভ্রূণের লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে। সেগুলোকে ভাঙতে (লাইসিস) শুরু করে। এটাই হিমোলাইসিস। ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে থাকে। অনেক ভ্রূণ গর্ভাবস্থাতেই মারা যায়। আর শিশু যদি বা জন্মায়, তবে জটিল শারীরিক ত্রুটি দেখা দেয়।

এর থেকে শিশুকে বাঁচাতে পারে অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন। আরএইচ নেগেটিভ প্রসূতির প্রথম শিশু জন্ম হওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টি-ডি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন প্রসূতিকে দেওয়া হয়। যা সন্তানের শরীর থেকে উৎসারিত আরএইচ অ্যান্টিজেনকে ঢেকে রাখে। তাই মায়ের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অচেনা অ্যান্টিজেন-এর উপস্থিতি টের পায় না। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে অ্যান্টিবডি তৈরিও করে না। তাই পরবর্তী সন্তানের কোনও সমস্যা হয় না।

জেমসের রক্তরস দিয়ে তৈরি অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন তাঁর মেয়ে ও নাতবৌও গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মেয়ে ট্রেসির বড় ছেলে জেরড জানাচ্ছেন, “ভাবলে অবাক লাগে, আমার জন্মের সময় মা এই ইনজেকশন পেয়েছিলেন। তাই আমি ছোট ভাই স্কটকে পেয়েছিলাম। পরে আমার স্ত্রী রেবেকাও এই ইনজেকশন পায়। আমার সন্তানদেরও প্রাণ বাঁচায় এই ইনজেকশন।”

দীর্ঘ ষাট বছরের বেশি সময় হ্যারিসনের নিয়মিত রক্তদানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সরকার তাঁকে জাতীয় সম্মানে ভূষিত করেছে। তাঁর কাছে রক্তদান ছিল সমাজসেবার অঙ্গ। এই উদ্যোগের সঙ্গে ব্যবসায়িক সংযোগে তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি মনে করেতেন, ব্যবসায়িক ভাবে‌ এই রক্তদান শুরু হলে স্বেচ্ছাসেবীরা এগিয়ে আসবেন না।

অস্টেলিয়ার রেড ক্রস সোসাইটির হিসাব মতো, হ্যারিসনের দান করা প্লাজ়মা থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ ডোজ় অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন তৈরি হয়েছিল। তাতে প্রায় চব্বিশ লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান মহিলা উপকৃত হয়েছিলেন। বেঁচে গিয়েছিল বহু গর্ভস্থ ভ্রূণ। ১১ মে ২০১৮ শেষ বার রক্তদান করেন হ্যারিসন। সেটি ছিল জেমসের ১১৭৩-তম রক্তদান! সে বার তিনি বলেছিলেন, “আশা রাখছি এই রক্তদানের উপযোগিতা উপলব্ধি করে অন্য কেউ এগিয়ে আসবে, এবং আমার রেকর্ড ভাঙবে।” এখন কৃত্রিম ভাবে জেমসের অ্যান্টিবডি তৈরি করার চেষ্টা করছেন গবেষকরা। এই গবেষণাকে চলতি ভাষায় ডাকা হয় ‘জেমস ইন আ জার’ (বোতলে জেমস) নামে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Blood Donation Red Cross Society Blood

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}