Advertisement
E-Paper

সংরক্ষণের লক্ষ্য

মুশকিল হল, অধুনা ভারতীয় রাজনীতি এমনই লঘু দোষারোপ, অভিযোগ, ভিত্তিহীন বিদ্বেষ রাজনীতির কক্ষপথে ঘুরে চলেছে যে এই ধরনের মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে গভীর প্রণিধানের প্রয়াস বা অবকাশ ক্রমেই দুর্লভ।

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ ০৭:১২
Share
Save

বছর ঘুরতে চলল, এখনও সুরাহা সুদূর অস্ত্। গত বছর মে মাসে কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে রাজ্যের ওবিসি সংরক্ষণ তালিকা থেকে ৭৭টি গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, যার মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। বিষয়টি অতঃপর রাজ্য সরকারের নির্বন্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়, এবং বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। দুই দিন আগে, গত মঙ্গলবার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে তিন মাসের মধ্যে একটি নতুন তালিকা তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে। যে সব গোষ্ঠী কমিশনের কাছে এই সুযোগের জন্য আবেদন করছে, তাদেরই উপর সমীক্ষা চালিয়ে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারে। বিচারপতি গাভাই আশ্বাস দিয়েছেন, সংরক্ষণ তালিকা প্রকাশিত হলে যদি কোনও পক্ষেরই ক্ষোভ না থাকে তা হলেই বিষয়টি মীমাংসার দিকে যাবে। দু’টি নাছোড় প্রশ্ন থেকে যায়। সত্যিই কি এমন একটি প্রশ্নে সব পক্ষের ক্ষোভ দূর হতে পারে? দ্বিতীয়ত, সরকারি কাজে বছর হয় আঠারো মাসে, অর্থাৎ তিন মাসটি অবলীলায় সাড়ে চার, কিংবা এমনকি সাড়ে চব্বিশে পৌঁছে যেতে পারে। সে বিষয়ে কি দৃষ্টি রাখা হবে? সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষেরই স্মরণে রাখা কর্তব্য, এই মামলার সন্তোষজনক মীমাংসার উপর বহু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে, বিশেষত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। সুতরাং, নিষ্পত্তি যেন বহু-বিলম্বিত না হয়।

তবে তার সঙ্গে এও ঠিক যে, দ্রুত এগোতে গিয়ে এত সুদূরপ্রসারী গুরুত্বের বিষয় নিয়ে ছেলেখেলা চলতে পারে না। কথাটি উঠছে এই জন্য যে, ওবিসি সংরক্ষণে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, এই প্রশ্নে যুক্তির অপেক্ষা আবেগ ও সংস্কারের প্রাবাল্যই এই দেশে বারংবার দৃষ্ট হয়েছে। প্রসঙ্গত, যে ৭৭টি গোষ্ঠী আদালতের রায়ে তালিকাবর্জিত হয়েছিল, তার মধ্যে ৪২টি ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (অর্থাৎ বামফ্রন্ট আমলে) তালিকাভুক্ত হয়, যার মধ্যে ৪১টি মুসলমান গোষ্ঠী। বাকি ৩৫টি গোষ্ঠী ২০১২ সালের মে মাসে (অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর) অন্তর্ভুক্ত হয়, যার মধ্যে ৩৪টি মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সুতরাং, বামফ্রন্ট সরকার বা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ ওঠানো যায়, ওঠানো হয়েছে। এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা— তার বাইরেও কিন্তু একটি বৃহত্তর ও মৌলিকতর বিচার্য আছে। সেটি হল ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংরক্ষণের যে ধারণা, তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটি ঠিক কী হওয়া উচিত। অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ কি ওবিসি সংরক্ষণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত না অনুচিত।

মুশকিল হল, অধুনা ভারতীয় রাজনীতি এমনই লঘু দোষারোপ, অভিযোগ, ভিত্তিহীন বিদ্বেষ রাজনীতির কক্ষপথে ঘুরে চলেছে যে এই ধরনের মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে গভীর প্রণিধানের প্রয়াস বা অবকাশ ক্রমেই দুর্লভ। ২০২৪ সালে যখন উচ্চ আদালতে শোনা গিয়েছিল, ‘ধর্মের ভিত্তি’তেই এই সংরক্ষণ পশ্চিমবঙ্গে করা হয়েছে, সে সময়ে এই রাজ্যের বাস্তবটি আলাদা করে বিবেচিত হয়েছিল কি না, সংশয় জাগে। কেননা সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন, এ রাজ্যে ওবিসি অর্থাৎ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে বিবিধ ধর্মের মানুষের সন্নিবেশ ঐতিহাসিক কারণেই। ফলে উপ-শ্রেণিবিভাগ বা সাব-ক্লাসিফিকেশনের বিশদ বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে অতীব জরুরি। কর্নাটকে ৩২ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের মধ্যে ৪ শতাংশ সংরক্ষণ ছিল ২০২৩ পর্যন্ত। কেরলে ৩০ শতাংশ ওবিসি কোটার মধ্যে ৮ শতাংশ মুসলমান সাব-কোটা এখনও আছে। তামিলনাড়ু, বিহারেও একই পরিস্থিতি। ভারতীয় জনসমাজের গঠন এতই জটিল ও বহুস্তরীয় যে কেবল ধর্ম কিংবা কেবল রাজনীতির মানদণ্ডে বাস্তবের বিচার অসম্ভব, অনুচিত, পরিত্যাজ্য। কমিশন, রাজ্য সরকার ও বিচারবিভাগ, সব তরফেরই উচিত, এই অতি স্পর্শকাতর সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টির বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব সামাজিক বিশেষত্বটিকে মর্যাদা দেওয়া।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Supreme Court of India OBC Certificate OBC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}