Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
ধর্মের সুখসন্ধানী, ক্রিয়ামূলক মডেলই স্বামী বিবেকানন্দের লক্ষ্য
Swami Vivekananda

এক স্বাদেশিক সন্ন্যাসী

বিবেকানন্দকে নিছক হিন্দুত্ববাদীর কোঠায় এ কারণেই ফেলা যাবে না, কারণ দেশ-কালের সাপেক্ষে স্বাদেশিক অহমিকার, ধর্মীয় আদর্শের নির্মাণে সচেষ্ট হলেও তার সীমাবদ্ধতা তিনি নিজেই জানেন।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৯
Share: Save:

দীর্ঘজীবী ছিলেন না স্বামী বিবেকানন্দ। বিশ শতকের দ্বিতীয় বছরে প্রয়াত এই অনতি-চল্লিশ সন্ন্যাসীর জীবন মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর দেশ-কাল-সমাজ ভাবনা দ্বারা নির্মিত। অধ্যাত্মপন্থাগামী এই মানুষটির জীবনে দেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে ধরা দিয়েছিল। তাঁর আধ্যাত্মিকতার অন্তরঙ্গ লক্ষ্য ‘মোক্ষ’ হলেও দেশের অধিকাংশ মানুষকে বহিরঙ্গ লক্ষ্য ‘ধর্ম’-এ নিয়োজিত করা, সে কথা বলা যেতেই পারে। ধর্ম শব্দটিকে বিশেষার্থে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রচনায়। “ধর্ম্ম কী? যা ইহলোকে বা পরলোকে সুখ ভোগের প্রবৃত্তি দেয়। ধর্ম্ম হচ্ছে ক্রিয়ামূলক। ধর্ম্ম মানুষকে দিনরাত সুখ খোঁজাচ্ছে, সুখের জন্য খাটাচ্ছে।” পরলোকের কথা বাদ দিয়ে বলা যেতে পারে, সুখপ্রদায়ী জাগতিক উন্নতির ক্রিয়ামূলক সহায়ক পন্থা হতে পারে নীতিনিষ্ঠ ধর্ম। বিবেকানন্দের প্রয়াণের কয়েক বছর পরে ম্যাক্স ওয়েবার আলোচনা করেছিলেন, প্রোটেস্টান্টদের নীতি কী ভাবে বিশেষার্থে জাগতিক উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। সে বই (দ্য প্রোটেস্টান্ট এথিক অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজ়ম) তখনও ভবিষ্যৎ-গর্ভে।

বিবেকানন্দ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই ভ্রমণকাহিনি যখন জাহাজে বসে লিখছিলেন, তখন শিকাগো ধর্মসভার সাফল্যে তিনি আলোকিত। শিকাগোতে গিয়ে আমেরিকার সভ্যতার বাহ্য-সমৃদ্ধি তিনি দেখেছেন। প্রাচ্যের ভাল আর পাশ্চাত্যের ভাল, দুইয়ের সম্মিলনই যে সভ্যতার অগ্রগতির মাঙ্গলিক উপায়, এ কথা আরও অনেকের মতো তাঁর প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পাচ্ছিল। লেখার ভাষায় তাঁর মুখের কথার ভঙ্গি ধরা পড়ছিল। তবে যখন শিকাগো ধর্মসভার খ্যাতি তাঁকে স্পর্শ করেনি, তখনও তাঁর লেখায় নানা ভাবে উঠে এসেছিল ‘দেশের কথা’। দেশ নামক কল্পনার অবয়বটিকে স্বাস্থ্যে সমৃদ্ধিতে গড়ে তুলতে চাইছিলেন এই স্বাদেশিক সন্ন্যাসী। তাঁর আচার্য রামকৃষ্ণদেবের কথামৃতে এ ভাবে দেশের কথা আসেনি— রামকৃষ্ণদেব মরমিয়া সাধক। কৌতুক করে বলতেন: সেবাকার্য ভাল, তবে মাতৃদর্শনের কাছে সব তুচ্ছ। বিবেকানন্দ ক্রিয়ামূলক সুখসন্ধানী ধর্মের সংস্কৃত রূপ কী হবে, হিন্দুধর্মের সাপেক্ষে ঔপনিবেশিকতার নিরিখে তা ভাবার চেষ্টা করছিলেন। শিকাগো বক্তৃতার সাফল্য তাঁর ভাবনাকে গতি দিয়েছিল।

শিকাগো ধর্মমহাসভায় তখনও যাননি। দেশ যতটা সম্ভব ঘুরে দেখেছেন। তার পর বিদেশ যাত্রার সুযোগ যখন এল তখন চলেছেন আমেরিকায়— ধর্মমহাসভায় ভারতবর্ষীয় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে। পথে এশিয়ার আর দু’টি দেশকে, চিন ও জাপান এই দেশ দু’টিকে, খানিক দেখেছেন— সেই দেখার সূত্রে তাঁর মনে পড়ছে নিজের দেশের কথা। আর আমেরিকায়! সেখানে যে সমাদর তিনি পাচ্ছেন, সেই সমাদরের অন্তরালে ভারতীয় প্রতিনিধিকে দেখার বিচিত্র কৌতুকময় কৌতূহল যে কাজ করে যাচ্ছে আমেরিকাবাসীদের মধ্যে, সেই কৌতূহল নিরসনের তৃপ্তির জন্যই যে সমাদর প্রদর্শন করা হচ্ছে তা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হয় না। শিকাগো বক্তৃতার আগে বিবেকানন্দের লেখা চিঠির সংখ্যা, অন্তত যা পাওয়া যাচ্ছে, তা খুব বেশি নয়। তার মধ্যে দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১০ জুলাই ১৮৯৩। বিবেকানন্দ তাঁর মাদ্রাজের শিষ্যদের চিন ও জাপান দেখে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের যুবকেরা দলে দলে প্রতি বৎসর চীন ও জাপান যাক্‌। জাপানে যাওয়া আবার বিশেষ দরকার।” কেন? যেতে হবে দেখতে ও জানতে। বিবেকানন্দ যে সুখসন্ধানী ক্রিয়ামূলক ধর্মপন্থার কথা ভাবেন, তা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে। দেশে বসে ‘আমাদের সব ছিল’ বলায় তিনি বিশ্বাস করেন না। চিঠিতে বিবেকানন্দের আহ্বান ইংরেজি ভাষায় ধ্বনিত হয়েছিল। বাগ্মী বিবেকানন্দের সেই ভাষা বঙ্গানুবাদে ঢাকা পড়েনি। “তোমরা দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!!... এস মানুষ হও। প্রথমে দুষ্টু পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ, এই মস্তিষ্কহীন বোকাগুলো কখনও ভাল কথা শুন্‌বে না— তাদের হৃদয়ও শূন্যময় [অসংবেদী, অনুভূতিহীন, অদরদি], তারও কখনও প্রসার হবে না।” পরে শিকাগো বক্তৃতায় কুয়োর ব্যাঙের অভিজ্ঞতাহীন গুমোরের কথা বলেছেন বিবেকানন্দ, সে কথাই এই অনুদারচিত্ত দুষ্ট পুরুতদের কথায় আভাসিত। এই যে অভিজ্ঞতামূলক ধর্মের নির্মাণের কথা ভাবছেন, তা ‘বিরোধমূলক’ হয়ে উঠুক একেবারেই চাইছেন না তিনি। এই ধর্ম অভিজ্ঞতা-নির্মিত বলেই পরিবর্তনশীল। সনাতনের আবর্তে পাক খাওয়া কাজের কথা নয়। চিঠিতে লিখেছেন, “পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ।”

লক্ষ করার বিষয়, কেবল পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গেই বোঝাপড়ায় যাচ্ছেন না বিবেকানন্দ, এশিয়ার অন্যতম প্রধান দু’টি সভ্যতা পশ্চিমি ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে বোঝাপড়ায় কী অবস্থান গ্রহণ করছে, তাও জানতে-বুঝতে চাইছেন। চিনের থেকেও জাপান সম্বন্ধে তিনি অধিকতর আশাবাদী। জাপানিদের ঐক্যশক্তি, উৎপাদনশীল মেধার তিনি গুণগ্রাহী। ‘ইউরোপীয় মস্তিষ্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এককণা’ গ্রহণ করে অনুকরণলিপ্সা প্রকাশ করেনি জাপান— ওসাকা, কিয়োটো, টোকিয়ো তিনটি শহরই দেখেছেন। ওসাকায় নানা শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর তাঁর দেশ ভারত? কেমন করে সে জাগতিক সমৃদ্ধির অংশীদার হবে? তাঁর দেশের মানুষ ‘সারা জীবন কেবল বাজে’ বকছে।

প্রাচ্য থেকে আমেরিকায় গিয়ে বুঝতে পারলেন, সে সভ্যতা আর এক রকম। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিচিত্র ভাবনার তাঁরা অধিকারী। বিবেকানন্দকে মাঝেমাঝেই নানা উৎপাত সহ্য করতে হচ্ছে। ১৮৯৩-এর ২০ অগস্ট আলাসিঙ্গাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, বস্টনে সহৃদয় আশ্রয় পেয়েছেন। এতে তাঁর অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই সহৃদয়তা বাদামি সভ্যতার প্রতি শ্বেত সভ্যতার সমমর্মী বন্ধুতা নয়। “...তিনি তাঁহার বন্ধুগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া ভারতাগত এক অদ্ভুত জীব দেখাইতেছেন!! এ সব যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবেই।” বিবেকানন্দ অনাহার, শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আর বিচিত্র বস্ত্র পরিহিত বলে পথচলতিদের উপহাসও তাঁকে সইতে হচ্ছে। বিবেকানন্দ না লিখলেও বোঝা যায়, যে ভাবে চিড়িয়াখানায় পশুদের দেখে স্নেহমিশ্রিত আমোদ উপভোগ করেন দর্শকেরা, এও খানিক তেমন। শ্বেত সভ্যতার কাছে তিনি প্রদর্শবস্তু।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রমের জন্য প্রয়োজন যে আত্মবিশ্বাস, তাকে জাগিয়ে রাখতে গেলে বাগ্মিতার অস্ত্র ধারণ করতে হয়। বিবেকানন্দ তা-ই করেছিলেন। বলিয়ে-কইয়ে সুদর্শন সন্ন্যাসী শ্বেতাঙ্গ হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ধর্মের যে সুখসন্ধানী ক্রিয়ামূলক আদর্শ বা মডেল তিনি নির্মাণ করতে চান, তাতে পাশ্চাত্যের উপাদান যোগ করেছিলেন। তবে দ্বন্দ্ব ছিল— লড়াইও বলা চলে। সেখানে বাগ্মিতার পাশাপাশি স্বাদেশিক আত্মমর্যাদাবোধ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশের মাটিতে হিন্দুধর্মের ক্রিয়ামূলকতার যে আদর্শ এই স্বাদেশিক সন্ন্যাসী নির্মাণ করেছিলেন, তাঅতীতের হিন্দু-ভারতের সমৃদ্ধির কল্পনায় অনেক সময়েই ভরা।

প্রশ্ন হল, বিবেকানন্দের এই যে অবস্থান, ধর্ম সম্বন্ধে এই যে ভাবনা, তা দেশ-কালের সাপেক্ষে বিচার্য। ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বিবেকানন্দের ঐক্যমূলক ধর্মের মডেলটিকে দেশ-কালের সাপেক্ষেই বিচার করেছিলেন। পরিবর্তিত দেশকালে বিবেকানন্দের ধর্মাদর্শের যে দিকগুলি গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা আবশ্যক। তার অর্থ এই নয়, বিবেকানন্দের কোনও স্থাণুমূর্তি নির্মাণ করতে হবে। বিবেকানন্দ নিজেও বুঝি তা চাইতেন না। তাঁর ধর্মের মডেলটি যে বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে গড়ে তুলেছিলেন, তা তিনি মানতেন। এই কর্মময়তার স্রোত থেকে নিজেও কি মুক্তি চাইতেন না! ‘কালী দ্য মাদার’ কবিতা লেখার অব্যবহিত আগে ও পরে তাঁর মন ঊর্ধ্বগামী। নিবেদিতাকে বলেন, “পেট্রিয়টিজ়ম ইজ় আ মিসটেক।” দেশবাসনা গুরুত্বপূর্ণ, সুখসন্ধানী ধর্মবাসনাও উন্নতিপ্রদায়ী। তবে মাত্রা ছাড়ালে চলবে কেন? তখন তা ভ্রান্তি, ভ্রম।

বিবেকানন্দকে নিছক হিন্দুত্ববাদীর কোঠায় এ কারণেই ফেলা যাবে না। কারণ দেশ-কালের সাপেক্ষে স্বাদেশিক অহমিকার, ধর্মীয় আদর্শের নির্মাণে তিনি সচেষ্ট হলেও তার সীমাবদ্ধতা তিনি নিজেই জানেন। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তাই। বিবেকানন্দকে, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতাকে, দেখেছিলেন বলেই হয়তো গোরার রূপান্তরিত ভাব-যাত্রাপথের ছবি এক রকম করে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গোরা-য় বিবেকানন্দ আছেন, আবার নেইও। স্বাদেশিকতা আর উগ্র জাতীয়তাবাদের, গীতা-উপনিষদের উদারতার ও হিন্দুত্বের সঙ্কীর্ণতার বিভাজন রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকে করতে সমর্থ হয়েছিলেন, কারণ উনিশ শতকের ফেলে আসা ইতিহাসের ইতি ও নেতি তিনি দেখেছিলেন। অকালপ্রয়াত বিবেকানন্দ দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হলে সম্ভবত নিজের ভাবনার বিচার করতেন—তাঁর আচার্যদেব ‘যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি’র আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda Religion Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy