বিস্ময়: চিনের প্রাচীর। আজকের চিন নিজেদের প্রয়োজনে নানা ‘দেওয়াল’ তুলেছে, আবার ভেঙেছেও।
বেজিং শহরে ঢুকে হর্ম্যরাজির দিকে তাকিয়ে মনে হল, চিন তা হলে গগনবিমা করে ফেলেছে? আকাশ তার হাতে? আমি ঠিক দেখছি তো? কোথাও মাও জেদং-এর ছবি নেই। কোনও দেওয়ালে কারও স্লোগান নেই। কোথাও কোনও ইংরেজি শব্দ নেই। ব্লকবাস্টার সিনেমার পোস্টার নেই। ইস্পাতের ছুরির মতো রাস্তা চলে গেছে চার পাশে। শীতল ও বহুতল ফ্লাইওভার। রাস্তায় কোনও ভিক্ষুক নেই। কী সুন্দর একটা দেশ বানিয়েছেন আপনারা। আপনাদের চোখ অর্ধেক খোলা, চোখ পুরো খুললে কী হবে?
প্রথম দিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে বেজিং ডাউনটাউন ধরে হাঁটছি— ওঁদের ডাউনটাউনে আমাদের একশোটা পার্ক স্ট্রিট ঢুকে যাবে— একটি দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এক অভিজাত প্রৌঢ়া, পরনে দামি স্কার্ট, পায়ে দামি জুতো, হাতে গ্লাভস, ফুটপাত থেকে একটি সিগারেটের টুকরো তুলে তাকালেন, তার পর ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন ডাস্টবিনের দিকে। এক জনের ফেলে যাওয়া সিগারেটের টুকরো আর এক জন এসে তুলে ফেলে দিচ্ছেন। ভেবে দেখলাম, মানবসভ্যতায় তাই তো হয়ে চলেছে, এক জনের পাপ মাটি থেকে তুলে আর এক জনকে ফেলে দিতে হয় ডাস্টবিনে। চিনে এটাই ছিল আমার প্রথম কবিতার উৎস।
চিন সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। চিন এখন উন্নতির শিখরে। বাজার কী করে খুলতে হয়, কী করে বন্ধ করতে হয়, সে জানে। অন্তরে সে কমিউনিস্ট, আসলে ক্যাপিটালিস্ট। কার্ল মার্ক্সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুনিয়ার পুঁজিবাদী এক হয়ে গিয়েছে এখানে। চিন যে ভাবে চিন হয়ে উঠেছে সেটা এক বিস্ময়। চিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রফতানিকারী, আমেরিকা থেকে যা কিনবেন সব ‘মেড ইন চায়না’।
নানজিং নামের একটা ছোট শহরে চারশো নব্বইটি বহুজাতিক সংস্থা লগ্নি করেছে গত বছর। আমি থ। আমি ওঁদের বিদেশ দফতরের এক জন অফিসারকে বললাম, দু’-একটা লগ্নি আমাকে দিন না, কলকাতায় নিয়ে যাব! শুনে তিনি হাসলেন না। চিনারা সাংঘাতিক বুদ্ধিমান, কিন্তু রসবোধ কম।
সান্টিয়াগোর কবি নিকানোর পাররা চিন দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকার গালে থাপ্পড় মেরেছিলেন তিন লাইনের একখানা কবিতা দিয়ে: “ইউএসএ/ হোয়্যার/ লিবার্টি ইজ় আ স্ট্যাচু।” সত্তর বছর আগে আমেরিকানরাও হেসেছিলেন। কিন্তু চিনের প্রাচীর নিয়ে পাররা কোনও কালো ঠাট্টা লেখেননি। তিনি জানতেন ওটা রিভার্স সুইং হয়ে যেতে পারে। আবার কেরলের কবি কে সচ্চিদানন্দন লিখলেন, “চিন/ যেখানে/ চিনের প্রাচীরই হল গণতন্ত্র।” চিনের প্রাচীরে উঠতে উঠতে প্রাণ যায়, তবু একটু দাঁড়িয়ে নিয়ে আর একটু উঠলাম, বারো নম্বর পয়েন্টে দাঁড়িয়ে, চার দিকে পাহাড় দেখে— পাহাড়ের উপর দিয়ে হাজার হাজার মাইল চলে গেছে যে প্রাচীর, তার একটা ছোট অংশ দেখে আমার মনে হল, প্রাচীর দিয়ে বাইরের শত্রু আটকানো যায়, ভিতরের শত্রু কী দিয়ে আটকাবেন?
এই সেই চিনের প্রাচীর, একমাত্র আশ্চর্য মানবকীর্তি যা চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে দেখা যায়। কোন দিন শুনব চিন চাঁদে বসতি বানাবে চাঁদ থেকে চিনের প্রাচীর দেখবে বলে। চিন থেকেই তো চিনের প্রাচীর দেখা যায়! তা বললে হবে, পৃথিবী থেকেও তো চাঁদ দেখা যায়, তা হলে পৃথিবী কেন চাঁদে যাচ্ছে? সেই টাকা দিয়ে আফ্রিকা-এশিয়াকে খেতে দেওয়া যেত। কেউ কাউকে খেতে দেয় না— সেটা চিন সবচেয়ে ভাল বুঝেছিল।
আমি সেখানকার এক সরকারি আমলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে একটা কথা বলুন, চিনে একশো পঞ্চাশ কোটি মানুষ, ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ বিলিয়ন জনসংখ্যা আপনাদের, কী করে খেতে দেন? তিনি বললেন, কোনও শস্যভূমি কেউ বিক্রি করতে পারে না। ব্যক্তির নামে জমি থাকলেও তার আসল মালিক চিন। কেউ বিক্রি করলে তার জেল হবে। চাল গম দানাশস্য যা ওঠে তাতে চিনের সংসার দিব্যি চলে যায়। এই সব মধুবাক্য শুনে অবিশ্বাস হলেও মনে হল, চিনের সংসার আমাদের সংসার হল না কেন? সবাই কবে খেতে পাবে ভারতে? চিন তার সমস্ত নাগরিককে খেতে দিতে পারে, এ জন্য চিনের সব দোষ ক্ষমা করে দেওয়া যায়। ভারতের দশ গুণ তার জিডিপি।
দোষ ছাড়া কোনও দেশ হয় না। মানুষই হয় না, তো দেশ। দেশ চালাতে হলে সবাইকে কথা বলতে দেওয়া যায় না। আমেরিকা থেকে থেকেই বলে, চিনে গণতন্ত্র নেই, কেউ কথা বলতে পারে না। সবাই ভয়ে থাকে, এই বুঝি পুলিশ এল। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে নাকি এক ধরনের সেল্ফ-সেন্সরশিপ চালু আছে। সেল্ফ-সেন্সরশিপ মানে: না বাবা আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বলতে পারব না? সেটা কোন দেশে নেই? কোনও কোনও দেশে কোনও কোনও সময়ে দোয়েল-ফিঙেও গান গাইতে পারে না, তরুলতাও মাথা দোলাতে পারে না। চিন এমন একটা দেশ যে বলে চলেছে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, তোমার সংসারে আমি নাক গলাচ্ছি না, তুমিও আমার সংসারে কান দিয়ো না।
চিনের জনবহুল রাস্তার মোড়ে আমি একটি পাবলিক টয়লেটে ঢুকেছিলাম, দরকার ছিল না, তা-ও ঢুকেছিলাম। ঢুকে দেখলাম, আমাদের থ্রি-স্টার টয়লেটের থেকে পরিষ্কার। আমি ছবি তুলছিলাম, এক জন বাধা দিল। এত ভয় কিসের? কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেছি একটা ব্যাপারে। আমার ফোনে ফেসবুক এল, আমি পোস্ট দিলাম, কোচবিহার ও ক্যালিফোর্নিয়া থেকে লাইক পেলাম। অথচ শুনে এলাম, চিনে নাকি ফেসবুক নিষিদ্ধ।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় একটি অসামান্য বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ঢোকার সময় পাসপোর্ট স্ক্যান করে ঢুকতে হল। পৃথিবীর আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখে পাসপোর্ট দেখাতে হয়নি আমাকে। রবীন্দ্রনাথের পায়ে ফুল দিয়ে মন ভরে গেল। চিনা ছাত্রছাত্রীরা ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গাইলেন, আমার গায়ে কাঁটা দিল। সেমিনার রুমে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বক্তৃতা করলেন চৈনিক অধ্যাপক। এই একটি জায়গায় দু’-একটা বাংলা বলতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সেটাও হত না। একশো বছর আগে তিনি এসেছিলেন, তাঁর কথা সবার ঠোঁটে, সবার চোখে-মুখে।
আমি যেখানে যেখানে গিয়েছি, প্রত্যেকটি জায়গায় রবীন্দ্রনাথের কথা উঠেছে। গ্রামের স্কুলে স্কুলে তাঁর কবিতা পাঠ্য। এক চিনা কমিউনিস্ট আমাকে বললেন, ছোটবেলায় তাঁর কবিতা পড়ে বড় হয়েছেন তিনি। একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যখন চিনে এসেছিলেন, খুব সুখের ছিল না তাঁর সেই সফর। কিছু তরুণ বিপ্লবী তাঁর বক্তৃতার সময় সারা হলঘরে তাঁর বিরুদ্ধে লিফলেট বিলি করেছিল। তবু চিন তাঁকে এত টেনেছিল যে তিনি দ্বিতীয় বার গিয়েছিলেন সেখানে। অন্য দিকে, শান্তিনিকেতনে চিনা ভবন হয়ে উঠেছিল চিনা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার পথিকৃৎ। এখনও এই উপমহাদেশে সেটিই চিন-চর্চার প্রধান ঠিকানা।
অতলান্তিক মহাসাগরের এ পার-ও পার থেকে কোনও ঐতিহ্য ধার না করে চিন ভাল আছে। চিনের সমাজ ‘ইউরোসেন্ট্রিক’ নয়। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ছাড়াই চিনের অস্মিতা গগন ছুঁয়েছে। কামু কাফকা প্রুস্ত দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা বিদ্যাচর্চা পালন করি। চিন নিজেকে জোকার করে তোলেনি। চিনের লি বাই কত বড় কবি সেটা বোঝাতে শেক্সপিয়র তুলে দেখাতে হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy