Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
শিক্ষাপ্রসারে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ দায় চেয়েছিলেন তিনি
Ishwar Chandra Vidyasagar

বিদ্যাসাগরের দোহাই

শিক্ষা-সংস্কৃতির এই আবর্তে বিদ্যাসাগর ঝাঁপ দিলেন। ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজে যেটুকু ইংরেজি পড়া যেত পড়লেন, তার পর পড়লেন শিক্ষক রেখে।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৯
Share: Save:

বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটা মজার কথা বলেছেন: কাক যেমন কোকিলের ছানা পালন করে, বিধাতা তেমনই ‘বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন’। ‘চারিত্রপূজা’-র ওই প্রবন্ধে কবি বাঙালিদের বিস্তর গাল দিয়েছেন। ধন্দে পড়েছেন, কোন বদখেয়ালে বিধাতা চার কোটি বাঙালির মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতো ‘দুই-একজন মানুষ’ গড়ে বসেন।

তবু কাক বেচারাই তো কোকিলকে ‘মানুষ’ করে। বিদ্যাসাগরের বিরল মনুষ্যত্ব বঙ্গভূমিতেই লালিত, তার ছাপ যাবে কোথায়? আছে তাঁর ধুতি-চাদর-চটিতে, আধুনিক বাংলা ভাষা সৃষ্টিতে তাঁর অবদানে, বাংলার ছেলেমেয়েদের (হ্যাঁ, মেয়েদেরও) শিক্ষার জন্য তাঁর জীবনভর প্রয়াসে। অথচ ধুতি-চাদর আঁকড়ে থাকার এই জেদে রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছেন এক অন্তরস্থ সাহেবিয়ানা— ‘অনুকরণগত সাদৃশ্য’ নয়, চরিত্রগত। সেই সাহেবিয়ানাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি পরিচয়কে তুলে ধরতে।

মোট কথা, তাঁকে নিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্স চলবে না। দু’শো বছর আগের যুগসন্ধিতে পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উদ্যোগে নতুন পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার জন্য হিন্দু কলেজ আর সাহেবি উদ্যোগে সাবেক প্রাচ্য বিদ্যাচর্চার জন্য সংস্কৃত কলেজ। নামেই ফাঁস, দুটোই সোনার পাথরবাটি। সংস্কৃত ভাষা হিন্দু পরিচিতি কি রক্ষা করবে বিজাতীয় কলেজ? কলেজি সাহেবি বিদ্যাই বা ঠাঁই পাবে কোথায়?

শিক্ষা-সংস্কৃতির এই আবর্তে বিদ্যাসাগর ঝাঁপ দিলেন। ছাত্রাবস্থায় সংস্কৃত কলেজে যেটুকু ইংরেজি পড়া যেত পড়লেন, তার পর পড়লেন শিক্ষক রেখে। অধ্যক্ষ হয়ে চাঞ্চল্যকর ‘নোটস’-এ সুপারিশ করলেন, সংস্কৃতের সব ছাত্রকে ইংরেজি শিখতে হবে। সেই বক্তব্য বিস্তারে লিখলেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন সাহেবের সমীক্ষার জবাবে। ব্যালেন্টাইনের মতে সংস্কৃতের ছাত্রদের ইংরেজি শেখাতে হবে সাবধানে মেপে মেপে, নইলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিদ্যার ঠোকাঠুকিতে তারা ভেবে বসবে সত্য দু’রকম। জ্ঞানের এই দ্বিত্ব বিদ্যাসাগর মানতে পারেননি; দৃঢ় ভাবে বলেছেন সত্য সত্যই, তার খাতিরে কখনও বা প্রাচ্য বিদ্যা ত্যাগ করে নব্য পাশ্চাত্য বিদ্যাকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। আক্ষেপ করেছেন, প্রাচীন শাস্ত্রে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের লেশমাত্র তত্ত্ব মেলে, কিছু লোকে বিজ্ঞান অস্বীকার করে শাস্ত্রবচনকে আরও আঁকড়ে ধরবে। আজকের ভারতে কথাটা বড়ই প্রাসঙ্গিক।

মাঝেমধ্যে বিদ্যাসাগর বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন— যেমন বেদান্ত আর সাংখ্যদর্শনকে সোজাসুজি বলেছেন ভুল বা মিথ্যা। বলেছেন, পাশ্চাত্য দর্শন পড়া উচিত ভারতীয় দর্শনের ভুল ধরার জন্য। সেই সঙ্গে বলেছেন, প্রাচীন সংস্কৃত গণিতশাস্ত্রের বদলে পড়া উচিত আধুনিক পাশ্চাত্য গণিত আর বিজ্ঞান— ঠিক যেমন রামমোহন লাটসাহেব আমহার্স্টের কাছে সওয়াল করেছিলেন ত্রিশ বছর আগে। আমহার্স্ট রামমোহনের পরামর্শ ফেলে স্থাপন করলেন সংস্কৃত কলেজ। সেই বিদ্যায়তনেই রামমোহনের স্বপ্নপূরণ করলেন বিদ্যাসাগর, স্থানমাহাত্ম্যে যোগ হল সংস্কৃত উত্তরাধিকারের মহত্তম অংশ। বাদ গেল রামমোহনের চর্চিত ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, বাদ থেকেই গেল পরবর্তীকালে। এই অপ্রাপ্তির বিষময় ফল আজও আমরা দেশ জুড়ে ভোগ করছি।

ওই একটি ব্যতিক্রম বাদে আমাদের আফসোস থাকতে পারে যে স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতিতে বিদ্যাসাগরের ভাবনা কখনওই স্বীকৃত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের অতি-স্বকীয় চিন্তা বরং গোড়ায় খানিক হয়েছিল, শান্তিনিকেতনের দৃষ্টান্তে এবং শিক্ষা নিয়ে তাঁর বহু রচনার দরুন। শিক্ষাদর্শ নিয়ে বিদ্যাসাগর বিশেষ লেখেননি। তাঁর প্রচেষ্টায় স্থাপিত বিদ্যালয়গুলি কিছু সরকারি, বাকিগুলিও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত, শান্তিনিকেতনের মতো বিপ্রতীপে নয়। যে শিক্ষা-কাঠামোর মধ্যে তিনি কাজ করেছেন (আর কিছুটা গড়ে তুলেছেন) তা আজও টিকে আছে। কিন্তু তাঁর যে পাঠপ্রকল্প আর মূল্যবোধ, বৌদ্ধিক ও মানবিক আদর্শ, তা বিস্মৃতপ্রায়।

কী ছিল সেই পাঠপ্রকল্প? ১৮৫২-র ‘নোটস’-এ তিনি বলছেন, সংস্কৃত ছাত্রেরা ইংরেজি পড়বে যাতে তারা ভাল করে বাংলা লিখতে শেখে। ব্যালেন্টাইনের জবাবি চিঠিতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখছেন, বঙ্গবাসীরা শিক্ষার জন্য আকুল। সেই চাহিদা মেটাতে সাবেক পণ্ডিতদের অগ্রাহ্য করে রাজ্য জুড়ে নতুন ধাঁচের বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হোক, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপাদান নিয়ে বাংলা পাঠ্যপুস্তক লেখা হোক। তাঁর নতুন পাঠ্যক্রমের ছাত্রেরা হবে তার উপযুক্ত শিক্ষক।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিদ্যাসাগরের ‘প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। আধুনিক বাংলার কাঠামো গড়ায় তাঁর অবদান বিশাল ও মৌলিক: বাক্যগঠন আর পদক্রম থেকে শুরু করে যতিচিহ্নের ব্যবহার, যুক্তাক্ষরের রূপ, মুদ্রণবিধি— কী নয়? সেই সঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রসারেও তাঁর যুগান্তকারী ভূমিকা। মধুসূদন বা বঙ্কিম যে অর্থে সাহিত্যিক, বিদ্যাসাগর তা নন। বাংলা ভাষার ইতিহাসে তাঁর অতুল কীর্তি ভাষাটাকে সিস্টেমিক গুরুত্ব দেওয়া, ব্যবহারিক ভাবে সমৃদ্ধ করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র স্থায়ী ভূমিকার উপযোগী করা। এই কাজের সবচেয়ে ফলপ্রসূ মাধ্যম অবশ্যই শিক্ষা: শান্তিনিকেতনের মতো ব্যতিক্রমী কেন্দ্র নয়, সাধারণ সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা।

বিদ্যাসাগরের কীর্তির একটা আপাত স্ববিরোধ আছে। এক দিকে তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী, আপসহীন সংস্কারক ও উদ্ভাবক। কিন্তু সেই উদ্ভাবন তিনি স্থাপন করতে চান একটা নৈর্ব্যক্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে: একটা-দুটো স্কুল গড়ে নয়, সরকারপুষ্ট স্কুলব্যবস্থায়; দু’-এক জন বিধবাকে আশ্রয় দিয়ে নয়, বিধবাবিবাহ আইন পাশ করিয়ে। তিনি বুঝেছিলেন, কোনও ব্যবস্থা স্থায়ী করতে চাই এমন পোক্ত ভিত। আধুনিক এস্টাব্লিশমেন্ট তখন সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তার পর দুই শতকে অমানবিক দৈত্যাকার ধারণ করেছে। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা-পরিকল্পনায় সমাজ আর প্রতিষ্ঠানের মেলবন্ধনের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটাও আমরা হেলায় হারিয়েছি।

তাই আজ তিনি প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্বল করার, ভেঙে ফেলার, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর করায়ত্ত করার অভিযান চলছে। সমান প্রাসঙ্গিক তাঁর কর্মকাণ্ডের ‌আর এক গুণ ধর্ম-নির্লিপ্ততা (ধর্মনিরপেক্ষতা নয়)। তাঁর শিক্ষাসূচিতে নীতিশিক্ষার স্থান আছে, ধর্মশিক্ষার নেই। বিধবাবিবাহ আন্দোলনে তিনি সনাতন হিন্দু শিবিরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, ভোগ করেছিলেন অশেষ অপমান (আজকের ভাষায় ট্রোলিং), এমনকি শারীরিক আক্রমণ। তিনি নিজে কিন্তু বিধবাবিবাহকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে দেখেননি। কেবল বাস্তববুদ্ধিতে বুঝেছিলেন, ধর্মীয় বিধান না মিললে সমাজ ব্যাপারটা মানবে না, আইনও পাশ হবে না। তাই তিনি রাতভর গ্রন্থাগারে পুঁথি ঘেঁটেছেন, পরাশর শাস্ত্রে অনুকূল বিধান পাওয়ার ইউরেকা-মুহূর্ত পর্যন্ত।

ধর্ম যদি না হয়, কী ছিল তাঁর চালিকাশক্তি? এর উত্তরও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন: ছিল দয়া। এই দয়া দুর্বল স্নায়ুর মন-ভেজা আবেগ নয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব’। ধর্মীয় অনুপান ছাড়া নির্ভেজাল মনুষ্যত্ব পালন সহজ নয়। ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় বিশ্ব জুড়ে বিশ্বমানবের অশেষ উপকার সাধিত হয়। আবার বহু ক্ষেত্রে সেই মানবসেবা ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে, বাকি মানবজাতির জোটে ঔদাসীন্য বা বিদ্বেষ। বিদ্যাসাগর যেমন স্বহস্তে কলেরা-আক্রান্ত দলিত নারীর সেবা করেছিলেন, মুসলমান সম্প্রদায়কে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন, জনজাতিকে কাছে টেনেছিলেন, তেমন করার তাগিদ থাকে না; বরং অপরত্বে দেগে-দেওয়া এই গোষ্ঠীগুলিকে প্রাণে হোক ভাতে হোক মারার প্রবণতা জন্মায়। শেষ এক বার রবীন্দ্রনাথের শরণ নিই: “এই চরিত্ররচনার প্রতিভা কোনো সাম্প্রদায়িক শাস্ত্র মানিয়া চলে না। ...যাঁহারা যথার্থ মনুষ্য, তাঁহাদের শাস্ত্র তাঁহাদের অন্তরের মধ্যে, অথচ বিশ্বব্যাপী মনুষ্যত্বের সমস্ত নিত্যবিধানগুলির সঙ্গে সে-শাস্ত্র আপনি মিলিয়া যায়।”

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এক বিশিষ্ট গোষ্ঠী ছিলেন শিক্ষাব্রতী পণ্ডিতের দল। এঁদের মূল বিদ্যাক্ষেত্র ভাষা ও পাঠচর্চা। অনেকে প্রশাসন বা রাজনীতিতেও যোগ দিতেন, অনেকে দিতেন না; কিন্তু স্রেফ মেধা ও বিদ্যার জোরে এঁদের অনেকে সমাজে ও ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবশালী ছিলেন। ধর্মবোধ ও নীতিজ্ঞানকে এঁরা যুক্তি ও মনুষ্যত্বের ব্যাপক পরিসরে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বিদ্বানদের হিউমানিস্ট বলা হয়। শব্দটার উৎপত্তি এক বিশেষ ঐতিহাসিক সূত্রে, কিন্তু অবধারিত ভাবে তাতে সঞ্চার হয়েছে ‘হিউমান’ শব্দের বৃহত্তর মনুষ্যত্বের ব্যঞ্জনা। উনিশ শতকের বাংলায় নতুন নৈতিক ও সামাজিক চেতনা বিলক্ষণ সেই হিউমানিস্ট ধাঁচে। বিদ্যাসাগর তার উজ্জ্বলতম প্রাণপুরুষ।

শত চেষ্টা সত্ত্বেও নবজাগরণের উত্তরাধিকার আমরা পুরোপুরি বিকিয়ে দিতে পারিনি। যেটুকু বাকি, বিদ্যাসাগরের দোহাইয়ে সেটুকু ধরে রাখলে আমাদেরই মঙ্গল।

অন্য বিষয়গুলি:

Vidyasagar Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy