সত্যজিৎ রায়ের পরিবার নিয়ে বিভিন্ন লেখক, প্রাবন্ধিক বহু আলোচনা করেছেন। সত্যজিতের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন লেখক, চিত্রকর, গায়ক এবং বাঙালি ছাপাখানা শিল্পের পথপ্রদর্শক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের লেখার অনুরাগী— তাঁকে বিদেশি ও প্রখ্যাত দেশি সাহিত্য রচনা অনুবাদ করতে, ও সেই ধরনের গল্প অনুসরণ করে লিখতে উৎসাহ দিতেন কবি। তবে প্রায়শই তাঁদের বাড়ি যাওয়ার সুবাদে সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায় হয়ে ওঠেন তাঁর প্রিয় অল্পবয়সি বন্ধুদের এক জন। সুকুমার রায় নিজেও ছিলেন মহাপ্রতিভাধর, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যিনি নিজের উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখেছেন।
ভাবতে গিয়ে মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের জীবনে যে মেয়েদের প্রভাব ছিল, তাঁদের নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসকদের অন্যতম কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের এক জন। অ্যান্ড্রু রবিনসনের জীবনীতে মেলে, সত্যজিতের জন্ম হয়েছিল কাদম্বিনীর হাতে। যদিও সে ভাবে তাঁকে চেনেননি সত্যজিৎ (তাঁর দু’বছর বয়সে কাদম্বিনী মারা যান), কিন্তু মা সুপ্রভা রায়-সহ, রায় পরিবারের মহিলাদের উপরে কাদম্বিনীর যে প্রগাঢ় প্রভাব ছিল, তা তিনি অনুভব করতেন। সত্যজিতের মা ছিলেন খুবই দৃঢ়চরিত্র এবং সম্ভ্রান্ত-স্বভাবা। স্বামীর অকাল-প্রয়াণের পরে তিনি তিন বছরের সত্যজিৎকে নিয়ে ভবানীপুরে তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে চলে আসেন। অল্পবয়সে বিধবা হয়েও ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে কাজের সূত্রে তিনি প্রতি দিন বাসে করে দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতা যাতায়াত করতেন। ওই সময়ে তিনি বিদ্যাসাগর বাণীভবনে হস্তশিল্প বিভাগে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এর থেকে সত্যজিতের মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কর্মরতা মহিলার চরিত্রটির কথা মনে পড়তে পারে অনেকের। সুপ্রভা খুব ভাল সেলাই করতে পারতেন। বিশেষত, কাশ্মীরি কাজে তিনি ছিলেন পটু। তিনি অসাধারণ ভাস্করও ছিলেন। সত্যজিতের মা-ই তাঁকে বড় করেন, দেখাশোনা করেন, লেখাপড়া শেখান এবং সত্যজিতের মধ্যে রায় পরিবারের সৃজনশীল ও সাহিত্যিক সত্তা বিকশিত করতে সাহায্য করেন। তিনিই সত্যজিৎকে রাজি করান তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে কাটাতে। সেখানে থাকাকালীনই তিনি আঁকা শেখেন নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রখ্যাত শিল্পীর কাছ থেকে। পরে, অপরাজিত ছবিতে দুনিয়া দেখেছিল সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলা সর্বকালের অন্যতম সেরা মা-ছেলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ছবির গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস থেকে নেওয়া হলেও, ছবিটি দেখে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটি কতখানি তাঁর আত্মজীবনীমূলক। রায় পরিবারের ঐতিহ্যে প্রোথিত শিকড় এবং মায়ের বড় করে তোলা— এই দুইয়ের মিশ্রণ ঘটেছিল সত্যজিতের মধ্যে।
পরবর্তী জীবনে সত্যজিতের শৈল্পিক ভাবনা ও অন্যান্য বিষয়ে এক বড় স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়। তাঁর লেখা অপূর্ব স্মৃতিকথা মানিক অ্যান্ড আই: মাই লাইফ উইথ সত্যজিৎ রায় পড়লে যে কেউ তাঁদের নিবিড় সম্পর্কের আঁচ পেয়ে যাবেন। যে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, কী ভাবে বিজয়া ছিলেন সত্যজিতের সবচেয়ে বড় সমালোচক এবং সঙ্গী। এই সূত্রে আমি আলোচনা করতে চাই অপরাজিত, মহানগর এবং চারুলতা-পরবর্তী ছবিগুলিতে সত্যজিৎ কী ভাবে মহিলা চরিত্রদের উপস্থাপিত করেছিলেন। মাথায় রাখা ভাল, ১৯৫০-এর দশকে সিমোঁ দ্য বোভোয়া-র বিখ্যাত বই দ্য সেকেন্ড সেক্স প্রকাশিত হওয়ার পরে নারীবাদী আন্দোলনে জোয়ার এসেছিল। এবং এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৩ সালে বানানো মহানগর ছবিটি ছিল নারীবাদী দুনিয়া এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মহানগর-পরবর্তী সময়ে ছবিগুলিতে সত্যজিৎ নারীচরিত্রদের কী ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, বিশেষ করে ধ্রুপদী পারিবারিক কাঠামোকে অতিক্রম করে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলি নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল, তার গভীরে ঢুকতে চাই।
সময়ের সঙ্গে তাঁর নারীচরিত্রগুলি ছবির মূল চরিত্রের বিবেক হয়ে উঠেছিল। উদাহরণস্বরূপ নায়ক, অরণ্যের দিনরাত্রি এবং সীমাবদ্ধ— তাঁর এই তিন ছবিতে শর্মিলা ঠাকুরের অভিনীত চরিত্রগুলির কথাই ধরা যাক। নায়ক-এ শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রটিকে উত্তমকুমারের আয়না হিসেবে দেখানো হয়েছিল, যেখানে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘ম্যাটিনি আই়ডল’-এর ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরেছিলেন। অরণ্যের দিনরাত্রি-তে তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটির নৈতিকতার অভিমুখ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন— তা সে ভালবাসাই হোক বা সামাজিক শ্রেণিগত আচরণ। সীমাবদ্ধ ছবিতেও বরুণ চন্দের শ্যালিকা হিসেবে তিনি প্রায় একই রকম ভাবে বেআব্রু করেন কর্পোরেট দুনিয়ার আত্মপ্রবঞ্চনা ও ভঙ্গুরতাকে।
পরবর্তী কালের ছবিতে মমতাশঙ্করের চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে নারী চরিত্রের এই রূপটি প্রবহমান থাকে। যেমন, আগন্তুক, শাখাপ্রশাখা এবং গণশত্রু-তে তাঁকে ফুটিয়ে তোলা হয় এক ভাল, সৎ ও নীতিপরায়ণ মেয়ে হিসেবে। সত্যি বলতে কী, চরিত্রের জটিলতার অনুসন্ধান ও উন্মোচনের নিরিখে এ সব ছবিতে নারীচরিত্রগুলিকে সে ভাবে তুলে ধরা হয়নি, যে ভাবে সত্যজিৎ তাঁর আগের ছবিগুলিতে দেখিয়েছিলেন। মানের বিচারেও এগুলি আগের ছবিগুলির উচ্চতা স্পর্শ করতে পারেনি। দর্শক হিসেবে আমাদের এই নারীদের আপন আপন অন্তর্জীবন, তাদের চরিত্রের জটিলতা সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু এই ছবিগুলোর সব ক’টাতেই প্রধান চরিত্র পুরুষ, নারীচরিত্রগুলি কেবল পুরুষদের চরিত্রচিত্রণ আরও স্পষ্ট, প্রকট করার জন্য কাজ করে গিয়েছে।
কৌতূহল জাগে যখন দেখি, সমাজে সচরাচর মেয়েদের যেমন ভূমিকায় দেখা যায়, সেই সব সামাজিক গণ্ডিকে অতিক্রম করছে মেয়েরা— এমন চরিত্রও তাঁর বেশ কিছু ছবিতে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় অরণ্যের দিনরাত্রি-তে কাবেরী বসু-র চরিত্রটি। ছবির সেই দৃশ্য, যেখানে তিনি প্রলুব্ধ করছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, সেটি আমার দেখা অবদমিত যৌনতার এক সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এক জন বিধবা হিসেবে তিনি নিজের যৌন চাহিদা, ভঙ্গুরতা এবং উদ্বেগকে ওই চরিত্রে যে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা অবিস্মরণীয়।
ছবিতে যৌনতা প্রদর্শনের ব্যাপারে সত্যজিতের অস্বস্তিটি স্পষ্ট। মনে করা যাক, ঘরে বাইরে-তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখার অপ্রত্যয়ী চুম্বনের দৃশ্যটির কথা। এমনকি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি পিকু-তেও শারীরিক মিলনের দৃশ্যটি তিনি কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে তুলেছিলেন। পিকু-তে অপর্ণা সেন-এর চরিত্রটি ছিল এক বিবাহিত মহিলার, যাঁর একটি ছোট সন্তান রয়েছে। তিনি ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রটির সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত। আর এই সম্পর্কের কারণে নিজের ছেলে এবং অসুস্থ শ্বশুরের প্রতি অবহেলা, এবং তার জন্য তাঁর আত্মগ্লানিই যেন ছিল এই ছবির মূল বক্তব্য। দেখে মনে হতে পারে, পরিচালক সত্যজিৎ যেন ভাল-মন্দ বিচারের মনোভাব থেকে চরিত্রটিকে দেখছেন। নারীবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সত্যজিতের এই ছবিগুলি দেখলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মেয়েদের সিদ্ধান্তের স্বাধিকারের প্রশ্নে তাঁর ভাবনা কী ছিল।
এর বিপরীতে দেখা যায় অপর্ণা সেন-এর পরমা ছবিটিকে। এই ছবিতে রাখি গুলজ়ার-এর মাধ্যমে এই ধরনের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ককে আরও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। পরমার চরিত্রটিকে ওই সম্পর্কের সব রকম পরিণামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তিনি ওই সম্পর্কের জন্য অনুতপ্ত নন। নারী-মনস্তত্ত্বের চিত্রণে এই ফাঁকগুলি ভরাতে সত্যজিৎ-পরবর্তী বাংলা ছবিতে আরও গভীর ভাবে অনুসন্ধানী হয়েছেন অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকরা। অপর্ণার পারমিতার এক দিন, যুগান্ত এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন ও দোসর ছবি তার দৃষ্টান্ত।
আর, এ ভাবেই চলচ্চিত্রের পরম্পরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy