অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি), কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ শ্রেণিকক্ষের দুয়ার খুলল আজ। অধিকাংশ পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকরা খুশি। ঘরের মধ্যে আটকে থেকে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ভুলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল! অবশ্য এরই মধ্যে বেশ কয়েক জন শিক্ষাবিদ দক্ষ লেগস্পিনারের মতো গুগলি দিতে শুরু করেছেন! তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে কোভিড পজ়িটিভিটি রেট এখনও অন্তত দুই শতাংশ। তা হলে স্কুলের ক্লাসরুমে পঠনপাঠন এখন কেন শুরু করা হবে, যেখানে স্কুলের পড়ুয়াদের প্রায় কেউই কোভিড ভ্যাকসিন পায়নি? শেষ পর্যন্ত এই ছাত্রছাত্রীরা যদি বিদ্যালয়ে এসে করোনায় আক্রান্ত হয়, তার দায় কে নেবে?
যাঁরা বলছেন যে এই মুহূর্তে স্কুল না খুললে ভাল হত, তাঁরা বোধ হয় বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইছেন না। এই যে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা বন্ধ রয়েছে, এর জন্য বহু শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার পৃথিবী একদম ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। বিশেষত যে সব ছেলেমেয়ে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এবং গরিব পরিবারের সদস্য, তাদের লেখাপড়ার যাবতীয় সমীকরণ বিশ্রী ভাবে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গিয়েছে। স্কুলে পাঠদান এবং পাঠগ্রহণ স্তব্ধ— তাই অনেকেই নানান কাজ ধরতে বাধ্য হয়েছে।
তা ছাড়া বহু গরিব পরিবারে বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকার থেকে যা হোক একটা কাজ করাকে দাম দেওয়া হয়। অভাবের তাড়নায় কেউ ফল-শাক-আনাজ কিংবা চা-কফি-ফুচকা বিক্রি করছে। আবার কেউ শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন্রাজ্য চলে গিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা পড়ুয়া এবং লেখাপড়ার মধ্যে ইতিমধ্যেই এক স্থায়ী ‘পাঁচিল’ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। গত বছর এবং এই বছরের অধিকাংশ সময়েই ক্লাসরুমে পড়াশোনা হয়নি। এখনও যদি শিক্ষাঙ্গনের দ্বার রুদ্ধই থাকে তা হলে আরও অনেক ছাত্রছাত্রী লেখাপড়ার জগৎ থেকে চিরকালের মতো মুছে যাবে। যে ছেলেমেয়েরা সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসে, তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রধান (হয়তো বা একমাত্র) মাধ্যম হল পড়াশোনা। সেখানেই তালগোল পাকলে বাকি আর কী রইল? যাঁরা এখনও শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের উদ্দেশে একটা প্রশ্ন রয়েছে। পড়াশোনার কক্ষপথ থেকে পাকাপাকি ভাবে ছিটকে যাওয়া হতভাগ্য পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবিদরা নেবেন তো?
এবং অনলাইন লেখাপড়া। এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার। আমাদের দেশে ডিজিটাল লেখাপড়া সফল হওয়ার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার, তা নেই। গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গাতেই ইন্টারনেট পরিষেবা বলার মতো নয়। আবার অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনই (এ ক্ষেত্রে কম্পিউটারের কথা ভাবা স্রেফ বাতুলতা) কিনতে পারেনি। খুব স্বাভাবিক কারণেই এই পড়ুয়াদের কাছে ডিজিটাল পড়াশোনা আয়ত্তের বাইরে থেকে গিয়েছে। বরং লাভবান হয়েছে তারা, যারা অনলাইন লেখাপড়ার সুযোগ নিতে পেরেছে। এখানেই সৃষ্টি হয়েছে পড়াশোনার জগতে এক গভীর ক্ষত, যার নাম ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। নিশ্চিত ভাবেই অনলাইনে ‘অফ’ হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে। তারা যখন বুঝতে পারছে যে তাদের লেখাপড়া হচ্ছে না, তখন তারা ক্রমশ মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছে। এবং হীনম্মন্যতায় ভুগছে। এই সব পড়ুয়ার জন্য শিক্ষাঙ্গনে নিয়মিত ভাবে পড়াশোনা আবার শুরু হওয়া খুব দরকার ছিল।
যাঁরা বলছেন যে স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে করোনা ছড়াবে, তাঁরা একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন। এই সব ছেলেমেয়ের বাবা-রা (বহু ক্ষেত্রে মায়েরাও) তো রুটি-রুজির সংস্থানের জন্য ঘরের বাইরে বার হন। এঁদের অধিকাংশই গণপরিবহণ ব্যবহার করেন। ভিড় বাস-ট্রেন থেকেও তো করোনাভাইরাস আক্রমণ শাণাতে পারে। কারণ ওখানে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বের কোনও বালাই নেই। অনেকেই ঠিকঠাক মুখাবরণ পরছেন না। সে ক্ষেত্রে অনেক পড়ুয়ার মা-বাবারা যখন কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তাঁদের সন্তানরাও করোনাতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই কোভিড-১৯’এর নাগপাশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে স্কুলে লেখাপড়া বন্ধ করে আর কত দিন চলতে পারে, সেই প্রশ্ন উঠতই।
বরং সংক্রমণ ঠেকাতে কী করতে হবে, সেটা ভাবা দরকার। শ্রেণিকক্ষে বাড়তি জানলা বসানো যেতে পারে, তাতে আলো-বাতাস ভাল ভাবে খেলবে। ক্লাসরুমে এগজ়স্ট ফ্যান লাগানোও সম্ভব। কোনও স্কুল-কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের ছাদে রেলিংয়ের ব্যবস্থা করে কিংবা গরম পড়ার আগে খেলার মাঠে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। পড়ুয়াদের যথাসম্ভব ছোট ছোট দলে ভাগ করে স্কুলে আনা যায়।
উপযুক্ত পদক্ষেপ এবং সাবধানতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটাও কিছু কম জরুরি নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy