Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
রসিকতা, আর কদর্যতা
Afghanistan Crisis

সমাজমাধ্যমে চলছে তালিবান উত্থানকে ব্যবহার করার খেলা

কেনই বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র তাঁর আজ়াদ হিন্দ ফৌজ-এ যে ভাবে অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধ ভারতের রূপরেখা এঁকেছিলেন, সেই ঐতিহ্যের দিকে তাকাব না?

 সংগ্রাম: আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা হাতে তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ১৯ অগস্ট, কাবুল।

সংগ্রাম: আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা হাতে তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ১৯ অগস্ট, কাবুল। রয়টার্স ।

অর্কদেব সিংহ
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২১ ০৬:০৭
Share: Save:

বারোশো বর্গগজের বাগানসমেত চার কামরার বাংলো চাই? মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকায়?’ প্রশ্নের পর বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তার পর দেওয়া আছে বাংলোটির ভৌগোলিক অবস্থান— ‘উত্তর কাবুল: সঙ্গে বিদ্যুৎ আর গাড়ির তেল ফ্রি’! সমাজমাধ্যমে এমত ‘রসিক’ মন্তব্য ঘুরছে। নির্মম রসিকতা। তালিবানরা কাবুল দখল করার পরও যে মহিলা সাংবাদিকের দল রাস্তায় দাঁড়িয়ে সরকারি টেলিভিশনে সংবাদপাঠিকাদের বরখাস্ত হওয়ার প্রতিবাদ জানানোর সাহস দেখান, বা সারা করিমি-র মতো আফগান মহিলা চিত্র পরিচালক যখন বিশ্বের সকল চলচ্চিত্রকার ও সিনেমাপ্রেমী বন্ধুদের উদ্দেশে টুইটারে লেখেন: “ভগ্নচিত্তে ও গভীর আশা নিয়ে লিখছি যে, আমার (দেশের) সুন্দর মানুষদের, বিশেষত চিত্রনির্মাতাদের, বাঁচাতে আমার সঙ্গে যোগ দিন”— তখন আমাদের সমাজমাধ্যমে হাত-ঘোরা এই সব ‘পোস্ট’ কেবল কুৎসিত নয়, তার মধ্য দিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যের অন্য আখ্যানও উঁকি মারে। এই আখ্যানটিই নানা রূপে ভারতের অভ্যন্তরের রাজনীতির আগামী বছর দুয়েকের ‘অ্যাজেন্ডা’ নির্ণয় করে দিতে চাইবে।

অনেকে অবশ্য সামান্য সূক্ষ্মতার আবডালেরও ধার ধারে না। এদের অনেকেরই মন্তব্য অশালীন, কিন্তু খুল্লমখুল্লা এবং স্পষ্ট। ফেসবুক প্রধানত এই সব ‘বাঁধানো’ মন্তব্যের আবাদভূমি। সেখানে তালিবানের উত্থানে আনন্দে উদ্বাহুদের সংখ্যা কম নয়; মন্তব্য দেখলে বোঝা যায়, অধিকাংশই আফগানিস্তানে আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দিশেহারা অবস্থানের চেয়ে, ভারতের আগত ও অনাগত ‘দুর্দশায়’ বেশি উল্লসিত। পাল্টা রে-রে করে লেগে পড়েছেন ভারতীয় ‘ভক্ত’-এর দল। যুক্তি-তথ্যের ধার না ধেরে অনর্গল বয়ে চলেছে পয়ঃপ্রণালীর ক্লেদাক্ত ধারা।

প্রথমে উল্লিখিত নির্মম রসিকতার সঙ্গে শেষোক্ত মন্তব্যরাজির আপাত রুচিগত তফাত থাকলেও, তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে যে, দু’টির উদ্দেশ্যই কিন্তু এক ও অভিন্ন— বিভাজন। প্রথম রসিকতায় যেমন ভয়ঙ্কর অনিশ্চিতি ও অন্ধকারের সামনে দাঁড়ানো আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সুস্থিতির ব্যঙ্গাত্মক তুলনা করা হয়েছে, একই রকম ভাবে ভারতে গাড়ির তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনও নেটিজ়েন মন্তব্য করায় তাঁকে ‘কাবুলে গিয়ে বসবাস’ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। অস্যার্থ, ভারতের ‘সুস্থিতি’ ও তার পরিচালনব্যবস্থা নিয়ে কোনও প্রশ্ন, এমনকি অর্থনৈতিক প্রশ্নও করা যাবে না। করলে, কাবুলে গিয়ে থাকতে হবে। এর আগে যেমন বর্তমান ‘ভাগ্যবিধাতা’দের বিষয়ে কোনও গণতান্ত্রিক প্রশ্ন তুললেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সুপরামর্শ দেওয়া হত। দ্বিতীয় শ্রেণির (অতি নিম্নরুচির হলেও) মন্তব্যের মধ্যে সেই ‘আমরা-ওরা’র দেশ ও সম্প্রদায়গত বিভাজনই অতি কুৎসিত ভাবে বিবৃত। এই মনোভাব এতই ছোঁয়াচে যে, যে মানুষদের যুক্তিবাদী ও উদার মনে হত, তাঁদেরও অনেকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানাচ্ছেন, ‘আসলে ওদের ধর্মের মধ্যেই এ সবের বীজ আছে’। নেট-বিস্ফোরণ নির্ভর ‘উত্তর-সত্য’এর যুগে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অনেক সংবাদমাধ্যমও তালিবানের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় (বিশেষত উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে) সংগ্রামরত আফগান জনতা, বিশেষত মেয়েদের লড়াইয়ের কথা ‘চেপে’ রেখে কেবল ভয় ও সন্ত্রাসের সংবেদনশীল খবরই পরিবেশন করছে।

ফলে, প্রশ্ন উঠছে না যে, ভয়ঙ্কর জেনেও তালিবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এই মানুষগুলোও তো ধর্মপরিচয়ে মুসলিম; তাঁরা প্রাণ হাতে নিয়ে, অত্যাচারের পরোয়া না করে প্রতিবাদ করে চলেছেন কিসের জোরে? অথবা, কাবুলে তালিবান উত্থানের প্রভাবে বাংলাদেশে কোনও নতুন মৌলবাদী/সন্ত্রাসী সঙ্কট ঘনিয়ে উঠবে কি না? বা, বাংলাদেশের উদারপন্থীরা— যাঁরা মৌলবাদী চোখরাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে প্রতি বছর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে ‘নববর্ষ’ পালন করেন, মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘ব্লগ’ লেখেন, বা একাত্তরের মুক্তি-সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন করেন— তাঁরা এই সঙ্কটের মোকাবিলা কী ভাবে করবেন? প্রশ্ন উঠছে না, কেননা কাবুল-সহ দক্ষিণ এশিয়ার (বিশ্বজনীন ভাবেও) নানা দেশের মুসলিম জনসমাজের বহুবর্ণিল অবস্থান এবং পারস্পরিক ভিন্নতার কথা বোঝার চেয়ে একমাত্রিক পরিচয়জ্ঞাপনে এই অঞ্চলে, বিশেষত ভারতে, ধর্মপরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি করার সুবিধা অনেক বেশি। ফলত, এ বার যখন সাড়ম্বরে ‘আজ়াদি কা অমৃত মহোৎসব’ পালন করা হচ্ছে, তখন তাতেই থেমে না থেকে, ১৫ অগস্টের আগের দিনটি (১৪ অগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস) দেশভাগের ‘বিভীষিকা দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ‘আমরা’ যেন দেশভাগের যন্ত্রণা ও তজ্জনিত অমানুষিক হিংসার কথাও ভুলে না যাই! বলা বাহুল্য, এই ‘আমরা’ হল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের একটা অংশকে, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হওয়ার অব্যবহিত আগের হিংসায় নিজের জন্মস্থান ছেড়ে ভারতে ‘আশ্রয়’ নিতে হয়েছিল।

এই আখ্যানের অভীষ্ট মর্মবাণীর সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের পঞ্জাব ও বঙ্গপ্রদেশের যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্বভাগের নানা অঞ্চলে ঘটা নিন্দনীয় ও অমানবিক ঘটনার মিল আছে, তা স্বীকার করে নিলেও প্রশ্ন ওঠে, পঞ্জাব ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র, যেমন, ‘সিন্ধ’ প্রদেশেও কি এমনটা হয়েছে? পূর্ব পাকিস্তানেও নোয়াখালিতে হিংসার যে মাত্রা, তা কি সর্বত্র একই রকম ছিল? বা, এই হিংসার ‘বিভীষিকা’ কি ‘একতরফা’ ছিল? পাকিস্তান হওয়ার আগে ও পরে কি ভারতীয় মুসলিম জনসমাজ কোনও ‘দোটানায়’ ভোগেনি? তাঁদেরও অনেককে কি— বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে— পূর্বপুরুষের ঘরদোর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় চোখের জল ফেলতে হয়নি? সংখ্যাগুরু ও রাষ্ট্রের প্রবল সন্দেহের মুখে কি তাঁদের বার বার প্রমাণ দিতে হয়নি যে, তাঁরা প্রথমে ‘ভারতীয়’, পরে ‘মুসলমান’? এম এস সথ্যু পরিচালিত ছবি গরম হাওয়া-তে (১৯৭৪) বলরাজ সাহনি অভিনীত ‘সলিম মির্জা’ চরিত্রটি এই ‘দোটানা’র এক অবিস্মরণীয় প্রতিনিধি।

কিন্তু যদি স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও শতাব্দীর লক্ষ্যে সামনের দিকে না তাকিয়ে পিছন ফিরেও তাকাতে হয়, তবে কেবল ১৯৪৬-এর কলকাতা, নোয়াখালি বা পঞ্জাবের দাঙ্গার দিকে কেন তাকাব? তার এক বছর আগে (১৯৪৫) ঘটা, লাল কেল্লায় আজ়াদ হিন্দ বাহিনীর বিচারপর্বকে কেন্দ্র করে, বাংলা তথা সারা ভারত জুড়ে সব ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় মিলে ছাত্র-শ্রমিক-নৌসেনাদের যে ঐক্যবদ্ধ উপনিবেশ-বিরোধী শেষ লড়াই, সে দিকে তাকাব না কেন? কেনই বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র তাঁর আজ়াদ হিন্দ ফৌজ-এ যে ভাবে অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধ ভারতের রূপরেখা এঁকেছিলেন, সেই ঐতিহ্যের দিকে তাকাব না? বা, অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনকে মিলিয়ে মহাত্মা যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবিধানের চেষ্টা করেছিলেন, সে কথা কেন ভুলে যাব? পাকিস্তান সৃষ্টির মূল নায়ক হিসেবে জিন্না-র যে ভাবমূর্তি, কেবল তা মনে রাখতে গিয়ে কেন বিস্মৃত হব যে, ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্যবিধানকারী লখনউ চুক্তির পর, সরোজিনী নাইডু জিন্নাকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাষ্ট্রদূত’ বলেছিলেন?

মনে রাখব না, কেননা, সামনেই উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের বিধানসভা ভোট। তার দু’বছর পর লোকসভা। বিশেষত, পঞ্জাবে এই ‘বিভীষিকা’র পুরনো স্মৃতি কফিন থেকে ফিরিয়ে আনলে পঞ্জাবের কৃষি বিক্ষোভও হয়তো সাময়িক ভাবে চাপা পড়ে যেতে পারে। তার সঙ্গে যদি তালিবানি বর্বরতার বর্তমানকে বুনে দেওয়া যায়, তবে তো
সোনায় সোহাগা।

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan Crisis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy