Advertisement
E-Paper

ভুলেই থাকব হয়তো

মজ্জার কোন স্তর অবধি কর্কট ছড়িয়ে গেলে, এই আর্তনাদও স্বাভাবিক বলে মনে হয় মানুষের? কোন জায়গায় গেলে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও চলতে পারে?

প্রতারিত: এসএসসি সংক্রান্ত মামলায় চাকরিহারাদের বিক্ষোভ, ২১ এপ্রিল।

প্রতারিত: এসএসসি সংক্রান্ত মামলায় চাকরিহারাদের বিক্ষোভ, ২১ এপ্রিল। —দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৩৯
Share
Save

অনভিপ্রেত হিংসা ছড়িয়ে পড়লেই পুলিশ-প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। রাজ্যের সাম্প্রতিক এসএসসি পরিস্থিতিতেও ওই কথা উঠে আসছে, সঙ্গত ভাবেই। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা কেবল কসবার তাণ্ডব না থামাতে পারার মধ্যে দিয়েই চিহ্নিত হয় না; আপাত-শান্তির সময়ে লক্ষ-লক্ষ চাকরির পরীক্ষা দেওয়া ছেলেমেয়ের খাতা যদি ওলোটপালট হয়ে যায়, সাদা খাতা জমা দিয়ে পাশ করে যায় কেউ, তা হলেও দায় সেই তাদের উপরেই চাপে। আক্রান্ত মানুষের ফোন কেন পুলিশ ধরেনি, এই প্রশ্ন সবচেয়ে জরুরি আজ। কিন্তু কম জরুরি নয় এই জিজ্ঞাসাও যে পরীক্ষার ওএমআর শিট যে স্ট্রং-রুমে থাকে, পুলিশি প্রহরা থাকা সত্ত্বেও, কী ভাবে সেখানে ঢুকে গিয়ে কেউ ছয়-কে নয় আর নয়-কে ছয় করে দিতে পারে?

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, মায়ানমারে বিধ্বংসী ভূমিকম্পে যখন একের পর এক অট্টালিকা ধসে পড়ছে, তখন প্রায় একই অভিঘাত সহ্য করেও ব্যাঙ্ককের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলি দাঁড়িয়ে ছিল সটান। কোন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় ব্যাঙ্কক রক্ষা পেয়ে গেল? সহজ এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, ‘সততা’। তাইল্যান্ডের ভীষণ কঠিন নির্মাণ আইন এবং ততোধিক কড়া প্রশাসক-পরিকল্পকদের পাশাপাশি, নির্মাণ-সামগ্রী তথা নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র ঢিল না দেওয়া ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যই লক্ষাধিক প্রাণ বাঁচল।

মানুষের প্রাণ এখানে সস্তা, নানা অকারণে মানুষ অহরহ মারা পড়ছে। আগেও কি পড়েনি? তখনও কি হয়নি চিরকুটের মাধ্যমে চাকরি?

মারাও গিয়েছে, ঘুরপথে চাকরিও হয়েছে। কিন্তু বজ্রশিখার এক পলকে ছাব্বিশ হাজার চাকরি মিলিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। গাজ়ায় পৈশাচিক নৃশংসতা চলছে বলার মানে যেমন হামাসের নির্বিচার হত্যা তথা অপহরণ সমর্থন করা নয়, তেমনই ব্যপম কেলেঙ্কারি অথবা কোটায় আত্মহত্যার বিভীষিকা স্বীকার করা মানেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে নেমে আসা এই সর্বনাশ শান্তচিত্তে মেনে নিতে হবে, তাও হতে পারে না।

পারে না বলেই ক্যানসার-আক্রান্ত এক শিক্ষকের চাকরি থেকে যাবে জানতে পেরে কেবল যে ক্যানসার-আক্রান্ত আরও দু’জন শিক্ষক নিজেদের দাবি পেশ করেন তা-ই নয়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক পিতার আর্তনাদ, যিনি নিজের পুত্রের চাকরি হারানোর সংবাদ পেয়ে বলে ওঠেন, “ওর যদি ক্যানসারও হত, পরিবারটা বেঁচে যেত।”

মজ্জার কোন স্তর অবধি কর্কট ছড়িয়ে গেলে, এই আর্তনাদও স্বাভাবিক বলে মনে হয় মানুষের? কোন জায়গায় গেলে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও চলতে পারে? প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যাঁরা চাকরি খোয়ালেন তাঁরা কী করছিলেন, যখন নিজেদের যোগ্য এবং বঞ্চিত বলে দাবি করা অসংখ্য শিক্ষক-পদপ্রার্থী হাজার রাত্রি পেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় পড়েছিলেন? কত জন রাস্তায় গিয়ে বসেছি তাঁদের পাশে, এক দিন? ঘরে ফিরে সেই রাতটুকু অন্তত ভাতের থালার সামনে বসে অবশ হয়ে গেছে কত জনের হাতের আঙুল?

সংখ্যাটা যদিও তেমন কিছু নয়, তবে, আজ সকলকেই ঘটমান সর্বনাশের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বনাশকে প্রসারিত করতে বলা অনুচিত। কিন্তু প্রতিবাদ করতে আসা শিক্ষকদের পুলিশ লাথি মারলে তার প্রতিবাদ হবে না, তা তো নয়। শিক্ষকদের মুখের কথা তুলে ধরে যাঁরা তাঁদের দায়ী করছেন, তাঁরা বলতে পারবেন, নিজেদের চাকরি খোয়া গেলে তাঁরা কী প্রতিক্রিয়া দেবেন?

যোগ্য আর অযোগ্যের ভিতর সীমারেখা টানা অসম্ভব হয়ে উঠল বলেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়, অনেকেই এই কথা বলছেন। সর্বশেষ নির্দেশেও মহামান্য আদালত বলেছেন যে, যাঁরা ‘দাগি’ নন সেই শিক্ষকরা ডিসেম্বর অবধি স্কুলে যোগ দিয়ে পড়াতে পারবেন, মাস গেলে মাইনেও পাবেন। ‘অযোগ্য’ বলে যাঁরা চিহ্নিত তাঁরা অবশ্যই সেই সুযোগ পাবেন না, যেমন পাবেন না গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি কর্মী অর্থাৎ শিক্ষাকর্মীরাও। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই কি যোগ্য-অযোগ্যের মুরগি লড়াই, তাই বলে?

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, অভিজাত স্বর্ণ বিপণি কিংবা বস্ত্র বিপণির কথা ছেড়ে দিন, একটা মিষ্টির দোকানের কাউন্টারের পিছনে যদি দুটো লোক না থাকে তবে শো-কেসে রাখা সন্দেশ-রসগোল্লা উধাও হয়ে যেতে কত ক্ষণ সময় লাগবে? কত জন আছে যারা সুযোগ পেলেও ফোকটে সুযোগ নেবে না? আর সব সময় কি সুযোগই নেয় মানুষ? মা কিংবা বাবা মৃত্যুশয্যায়, ছোট ভাই অথবা বোনের পড়াশোনা চালানো যাচ্ছে না, এমন অবস্থায় কেউ যখন শোনে যে অমুককে পাঁচ লাখ দিয়ে তমুকের পাকা চাকরি হয়ে গেছে, তখন সে দুর্নীতি করবে বলে এগোয় না, দুর্নীতিকেই নিয়তি মেনে আত্মসমর্পণ করে।

এখানেই সিস্টেমের দাম, যার জেরে চাইলেই পুকুরচুরি করতে পারে না কেউ। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে নিয়োগের পরীক্ষা হচ্ছে আর তার হার্ড ডিস্ক উদ্ধার হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের গাজ়িয়াবাদের জনৈক পঙ্কজ বনশলের থেকে, এটা কল্পনা করার মতো জায়গাতেও তো ছিলাম না আমরা। সমাজজীবনে কী হয়ে গেল ইত্যবসরে যে টাকার বিনিময়ে চাকরি, কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল?

কেবল রাজনীতির দিকে আঙুল উঁচিয়ে লাভ নেই, কারণ রাজনীতির কারবারিরা জাহাজ ডুবছে বুঝলে লাফ দিয়ে অন্য জাহাজে গিয়ে নিজেদের নিরাপদ করে নিতেও জানে। স্বহস্তে টাকা নেওয়ার ভিডিয়ো থাকলেও যেখানে অভিযোগ প্রমাণ হয় না, সেখানে ভিডিয়ো ছাড়া কাকে কত দিন আটকে রাখা যাবে? যায় না বলেই, এমন অনেকে বেরিয়ে আসছে যারা চাকরি দেওয়ার নামে টাকা তুলত বলে অভিযোগ।

বড় প্রশ্ন, লোকে টাকা দিত কেন? একটি গ্রামের কম-বেশি পঁচিশ জনের চাকরি হয়েছিল ২০১৬ সালের প্যানেল অনুযায়ী আর চাকরি গেছেও প্রত্যেকের। সেই গ্রামের প্রতারিত ‘অযোগ্য’দের বাবা-কাকা-মায়েরা বলছেন, ‘চাকরির দোকান লেগেছিল গেরামে। সবাই চাকরি কিনতি যেত।’

সবাই কোন দোকানে যায়? গ্যারান্টি-যুক্ত জিনিস যেখানে। এ বার গ্যারান্টির খবর কখন ভাসে বাতাসে? যখন প্রত্যক্ষ প্রমাণ সামনে দেখা যায়। তবে কি টিভির সান্ধ্য-বিতর্কে উঠে আসা এই কথাটা সত্যি যে, ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার আগে-পরে যে পরীক্ষার্থীরা দালাল ধরতে গিয়েছিল তারা দু’বছর আগের প্রাইমারি পরীক্ষায় এমন অনেককে চাকরি পেতে দেখেছিল, যাদের যোগ্যতা নিয়ে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন আছে?

উত্তর তদন্তকারীরা দিতে পারবেন। তবে, এটা ঘটনা যে তাপস মণ্ডল কিংবা শেখ শহিদ ইমামদের হাতে কেউ নিজের শেষ সঞ্চয় তুলে দিত না, যদি না নিজেদের ক্ষমতার অকাট্য প্রমাণ দিতে পারত তারা। কিন্তু বহুধা-বিস্তৃত যোগাযোগ না থাকলে তারা কাজটা করত কী ভাবে? তাই, স্কুল সার্ভিস কমিশনের শীর্ষপদে থাকা স্বনামধন্য অধ্যাপকদের যখন চাকরি-প্রাপকদের তালিকায় গরমিল করার অভিযোগে দীর্ঘ দিন জেল-বন্দি থাকতে হয়, তখন সেই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না যে পয়ঃপ্রণালীর লাইনের সঙ্গে পানীয় জলের লাইন মিশে যায়নি তো? বাঁকা পথে হাঁটতে গিয়ে যাঁদের পা দুটোই গেল, তাঁরা মুখ খুললে জানা যাবে।

আজ সাতাশ বছর হল এসএসসি-র পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এক জন শিক্ষকের গড় চাকরির সময় যদি পঁয়ত্রিশ বছর হয় তবে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলির তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষক এসএসসি দিয়েই চাকরি পেয়েছেন। ওএমআর শিট তাই কেবল চাকরির ছাড়পত্র নয়, সামাজিক ভূমিকম্পের প্রতিষেধক। আমরা তা ডিসেম্বর অবধি ভুলেই থাকব হয়তো। কিন্তু তার পর?

টাকা পেলেই নেওয়া যায় না ভুলে গেছে যে সমাজ, টাকা থাকলেই দেওয়া যায় না— এ কথা সে বোঝাবে কী করে? আর তা না পারলে, পরের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে সেই গ্যারান্টি কে দেবে? ব্যাঙ্ককের ইঞ্জিনিয়াররা?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

WBSSC West Bengal SSC Scam

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}