অণুঘটনা এক। ৭ জুন ২০২০: এক দল প্রতিবাদী জনতা ব্রিস্টল শহরে এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি টেনে নামিয়ে আনেন এবং সেটিকে টেনে হিঁচড়ে ব্রিস্টল বন্দরের জলে নিক্ষেপ করেন। তাঁরা বলেন, এই কলস্টন ঘৃণ্য দাসব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, অতএব এই শহরে মানুষটির মূর্তির প্রয়োজন নেই।
অণুঘটনা দুই। নভেম্বর ১৮৪৪, ম্যাসাচুসেটস-এর স্যামুয়েল জোসেফ মে’র কাছে একটি প্যাকেট এসে পৌঁছয়। প্রেরক, ব্রিস্টলের ডক্টর জন বিশপ এস্টলিন। প্যাকেটগুলির মধ্যে ছিল কয়েকটি চুলের গোছা, যার মালিক ১১ বছর আগে ব্রিস্টলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই মৃত ব্যক্তিটি আর কেউ নন, রাজা রামমোহন রায়। ডক্টর এস্টলিন, রামমোহনের শব-ব্যবচ্ছেদের সময় এই চুলগুলি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। স্যামুয়েল মে ছিলেন এক জন র্যাডিক্যাল এবং ইউনিটারিয়ান যাজক, তিনি এবং তাঁর বিশেষ বন্ধু উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন মিলে আমেরিকা দাসপ্রথা বিলোপ সমিতিকে সংগঠিত করেন। এস্টলিনের বিশ্বাস ছিল, রামমোহনের চুলের গোছা নিলাম করলে যে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে, তাতে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করা যাবে। এস্টলিনের অনুমান বৃথা যায়নি। চুলের গোছাগুলি নিলাম করে আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা গিয়েছিল।
ঘটনা দু’টির সময় ভিন্ন হলেও সমাপতনের দিক থেকে তাদের বেশ মিল। দু’টি ঘটনায় জড়িয়ে আছে ব্রিস্টল শহর ও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় রামমোহনের খ্যাতি এ দেশ পার করে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং শুধু ইংল্যান্ডে নয়, সুদূর আমেরিকাতেও তাঁর গুণমুগ্ধের অভাব ছিল না। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাগর পেরিয়ে রামমোহনের নাম আমেরিকায় পৌঁছে গেল কী ভাবে? ওবেরলিন কলেজের শিক্ষক মাইকেল ফিশার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমেরিকান জাহাজ বাণিজ্য করতে কলকাতায় আসা-যাওয়া করত। আমেরিকা স্বাধীনতা পাওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খবরদারি থেকে মুক্ত হয়ে নিজেরাই স্বাধীন ভাবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করত। বাণিজ্য করে ফেরার পথে তারা রামমোহনের লেখার ইংরেজি অনুবাদ সঙ্গে নিয়ে যেত। সুতরাং, নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের কাছে রামমোহনের অপরিচিত ছিলেন না। তাই রামমোহন যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তখন আমেরিকান শিল্পী রেমব্রান্ট পিল নিজেই সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে রামমোহনের একটি প্রতিকৃতি করেন। রামমোহনের মৃত্যুর পূর্বে এই প্রতিকৃতিটি বর্তমানে আমেরিকার এসেক্স পিবডি মিউজ়িয়ামে প্রদর্শিত আছে (ছবি)। কয়েক বছর আগে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে এই অসামান্য প্রতিকৃতিটি কিছু দিন প্রদর্শিত হয়েছিল।
রামমোহন যখন ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন তিনি প্রাচ্য থেকে আগত এক জন অভিযাত্রী নন, তিনি এক সেলেব্রিটি। ম্যাঞ্চেস্টারে তিনি জাহাজ থেকে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল জনতা, যাঁরা অধিকাংশই কারখানার শ্রমিক, তাঁকে দেখার জন্যে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেন— অনেকটা ১০০ বছর পরে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে যে রকম উন্মাদনা হয়েছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৮৩০ সালে লন্ডন ব্রিজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে রামমোহনের বসার স্থান রাজপরিবারের সঙ্গে। লন্ডনে যখন পৌঁছলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর বেরোতে লাগল তিনি কোন হোটেলে উঠেছেন, ইউনিটারিয়ানদের সভায় লোকে বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়িয়েছিল তাঁকে এক বার চোখে দেখার জন্যে। রামমোহনের সই-সহ তাঁর ছবির তখন বিপুল কদর ইংল্যান্ডে। এই ছবি আর সই বিশেষ ভাবে আগামী দিনে প্রচারিত হবে। ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম এই রকম একটি রামমোহনের সই করা ছবি সংগ্রহ করে। ডিউক অব সাসেক্স রামমোহনের এই রকম একটি ছবি তাঁর লাইব্রেরিতে রেখে দেন রামমোহন রায়ের গ্রন্থের সঙ্গে। শিল্পীরা পেনসিলে বা জলরঙে এই ছবির দেদার কপি করতে থাকেন। জেমস সাদারল্যান্ডের বিবরণ থেকে জানতে পারি রামমোহন যখন ১৮৩১ সালে লিভারপুলে পৌঁছন, তখন এই সই করা ছবি প্রতিটি ছাপার দোকানে শোভা পেতে থাকে, এমনই ছিল রামমোহনের জনপ্রিয়তা। ব্রিটিশ ইউনিটারিয়ানদের কাছে রামমোহনের খ্রিস্টীয় ত্রিতত্ত্ববাদ বা ট্রিনিটির বিরুদ্ধে সওয়াল বিশেষ গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল, কারণ প্রাচ্য থেকে এমন গভীর মনন দিয়ে খ্রিস্টীয় ত্রিতত্ত্ববাদ বা ট্রিনিটির বিরুদ্ধে কেউ কখনও বলে ওঠেননি।
তবে কী ভাবে রামমোহনের নাম দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল? উত্তরের জন্য ভিক্টোরীয় যুগটাকে বুঝতে হবে। লিন জ্যাস্টোপিল রামমোহন রায় অ্যান্ড দ্য মেকিং অব ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেন গ্রন্থে এ নিয়ে লিখেছেন।
মানবিকতাবাদ এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছিল। লিনের মতে, ভারতে সতীদাহ প্রথা রদের আন্দোলনের সঙ্গে দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনের অনেক সামঞ্জস্য আছে। সতীদাহ প্রথার অমানবিকতা এই মানবদরদিদের কাছে খুব সাড়া ফেলেছিল। ব্রিটিশ মহিলারা নিজেদের দেশে সতীদাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। এর ফলে রামমোহন রায়ের নাম ব্রিটেনের দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের কাছে পরিচিত হয়ে যায়। এর খানিক কৃতিত্ব জেমস সিল্ক বাকিংহাম ও জেমস পেগস-এর। এঁরা দু’জন রামমোহনের লেখা ব্রিটেনের জনগণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীরা রামমোহনকে তাঁদের এই নৈতিক যুদ্ধ ও সংস্কারের অংশীদার বলে গ্রহণ করেন। লক্ষণীয়, এই দু’টি আন্দোলন মোটামুটি ব্রিটিশ ইতিহাসে একই সময়ে চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ১৮২৩ সালে টি এফ বাক্সটন পার্লামেন্টে একটি মোশন বা বক্তব্য তোলেন, যাতে প্রস্তাব করা হয় ধাপে ধাপে দাসপ্রথা অবলুপ্ত হোক ও সতীদাহ প্রথা রদ করা হোক। সতীদাহের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা হয়। ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদের পর দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিরাট জোয়ার আসে।
১৮৩৩ সালে আমেরিকাতে ইমান্সিপেশন অ্যাক্ট পাশ হয়। ব্রিটিশ ইউনিটারিয়ান ও কোয়েকাররা দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন। অনেকেই ধর্মীয় যোগাযোগ ব্যবহার করে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সে সময় রামমোহন ইউনিটারিয়ানদের কাছে যে রকম সেলেব্রিটি ছিলেন, তাঁর চুলের গোছা নিলাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা দেখতে পাই ১৮৩৩ সালে ওয়াশিংটন কংগ্রেসে দাসপ্রথা বিলোপের জন্য একটি আবেদন পেশ করা হয়। সেই ইস্তাহারে বলা হয়, আমরা এক জনের নাম করতে চাই যিনি এই যুগের সবচেয়ে আলোকিত ও হিতৈষী ব্যক্তিত্ব, যিনি আমাদের মধ্যে আছেন, কিন্তু যিনি আমাদের মতো শ্বেতাঙ্গ মানুষ নন। তাঁর নাম রামমোহন রায়।
রামমোহনের পরিচয় পশ্চিম দুনিয়ার কাছে অনেক আগেই হয়েছিল। লিন জ্যাস্টোপিল দেখিয়েছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন রামমোহনকে পশ্চিম দুনিয়ার মুক্ত চিন্তাবিদদের কাছে আদরণীয় করে তোলে। ১৮২৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, রামমোহন প্রতিবাদ করেন, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন থেকে শুরু করে প্রিভি কাউন্সিলে আপিলে স্বাক্ষর সবেতেই যোগ দেন। এই বিলের প্রতিবাদে তাঁর ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র মিরাত-উল-আখবার বন্ধ করে দেন। ১৮১৯ সালে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ৬ আইন প্রবর্তন করেন যাতে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়। রামমোহনের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল ব্রিটিশদের কাছে বিশেষ সমাদর পায়। ব্রিটিশ আন্দোলনকারীরা রামমোহনের যুক্তিগুলো ব্যবহার করেন। অনেক সময়ে তাঁর লেখা অনুবাদ করে প্রচারে লাগান। রামমোহনের যে ভাবটি তাঁদের কাছে বিশেষ দাগ কেটেছিল, তা হল মেধার উৎকর্ষ।
অর্থাৎ, আজকালকার ভাষায় রামমোহন ছিলেন এক জন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার। জেমস সিল্ক বাকিংহামের সঙ্গে রামমোহনের সখ্য কলকাতা শহরে ঘটেছিল, যখন বাকিংহাম এক জন সাংবাদিক হিসাবে এ দেশে কাজ করছিলেন। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার পর বাকিংহাম দেশে ফেরেন। ইংল্যান্ডে তিনি রামমোহনকে পরিচিত করেন, তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা তুলে ধরেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিস্টল শহর ছিল বড় বাণিজ্যকেন্দ্র। লন্ডনের পরে এটিই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ফলে এখানে দাসব্যবসাও ছিল প্রবল, দাসপ্রথা বিরোধিতাও ছিল প্রবল। আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ল্যান্ট কার্পেন্টার এবং তাঁর কন্যা মেরি, জন এস্টলিন ও তাঁর কন্যা, এস্টলিনের শ্যালক জেমস কাউলস প্রিচার্ড, টমাস বেডোস প্রমুখ। সকলেই ছিলেন ইউনিটারিয়ান ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত। ইউনিটারিয়ানরা এই দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বিশেষ জড়িত ছিলেন। ল্যান্ট কার্পেন্টার ছিলেন রামমোহনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও লিউন্স মিড চার্চের যাজক। কার্পেন্টারের বন্ধু মিস ক্যাসেল ও মিস কিডেলের স্টেপলটন গ্রোভের বাড়িতে রামমোহন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কার্পেন্টারের কন্যা মেরি রামমোহনের জীবনের শেষ ক’টি দিনের কথা দ্য লাস্ট ডেজ় ইন ইংল্যান্ড অব রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থে লিখে গেছেন। রামমোহনের সংগ্রামী মনোভাব, অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও সমাজ-সংস্কারকের অবিচল ভাবমূর্তির জন্যেই ভারতের বাইরেও মানবতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নাম চিরতরে জড়িয়ে থাকল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy