একটি ফুড ডেলিভারি অ্যাপ কোম্পানির সিইও ক’দিন আগে একটা দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছিলেন। ঝকঝকে লাল ইউনিফর্ম পরে বাইকে চেপে কাস্টমার-দের হাতে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। অনেকটা ওই ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতার মতো তিনি এক দিনের জন্য ডেলিভারি পার্টনার সেজেছিলেন। একা যাননি যদিও, সঙ্গে ক্যামেরাপার্সন ছিলেন জনাচারেক। তাঁরা ছবি তুলেছেন, ভিডিয়ো বানিয়েছেন, কাস্টমাররা সেলফি তোলার আবদার করেছেন। যে বহুতলে লিফটের গায়ে লেখা থাকে— “ডেলিভারি বয়/ কুরিয়র সার্ভিস এবং বাড়ির কাজের লোকেদের লিফট ব্যবহার বারণ”— তারাই উদ্বাহু মালিকের এক দিনের মহাযজ্ঞে। সমাজমাধ্যমের পাতায় প্রশস্তি লেখা হয়েছে, নতুন প্রজন্মের উদ্যোগপতির পোস্টার বয়ের কথা।
এ দিকে যাঁরা প্রতি দিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সাইকেল চালান, যাঁদের শপিং মলে প্রবেশের অনুমতি মেলে না, সেই তাঁদের কথা বলবে কে? রাস্তায় মারধর করে খাবার ছিনিয়ে নিলে, কাস্টমার গালিগালাজ করে পয়সা না দিলে, ১২ ঘণ্টা কাজ করার পর ৫০০ টাকা রোজগার করতে না পেরে শুকনো মুখে বাড়ি ফেরেন যে শ্রমিক-বাবা, তাঁদের ভিডিয়ো কে করে?
সরকারি মতে, দিল্লিতে একিউআই ১০০০ ছাড়িয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হল ভারতের রাজধানী। রাইড সোর্সিং-এ নিযুক্ত এক কর্মী বলছিলেন বাইরের বাতাস বিষাক্ত বলে গলা, চোখ, নাক এবং ফুসফুসে অস্বস্তি হয় নানা রকম। কিন্তু উপায়ান্তর নেই, কাজে না বেরোলে টাকা আসবে না, টাকা না থাকলে বাড়ির লোকজন খাবে কী? তাই তিনি বিষধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালান, কাচ দেওয়া হেলমেট পরেন, বাড়ি ফিরে গরম জলে স্নান করে নেন। জন হেনরির কথা মনে পড়ে, শ্রমিক শ্রেণির একমাত্র পুঁজি তাঁর নিজের শরীর।
ভারতে গিগ ওয়ার্কার্স নামে পরিচিত ‘ডিজিটাল লেবার প্ল্যাটফর্ম’ কর্মীদের নিজস্ব কিছু অভিযোগ ও দাবি রয়েছে, কম মজুরি থেকে শুরু করে দুর্ঘটনা ঘটলে আপৎকালীন সহায়তা পর্যন্ত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত নানা অবক্ষয়ের জন্য যে শারীরিক ক্ষতি তাঁদের হয়, তার জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি এখনও জোরালো হয়নি। অথচ, নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাপূর্ণ কাজের পরিবেশের অধিকার কেবল মৌলিক অধিকার নয়, ২০৩০-এর রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস’ (এসডিজি)-এরও গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভারতীয় শ্রম আইনে বলা আছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত সরকারি কর্মীদের যেন ‘রিস্ক অ্যালাওয়েন্স’ দেওয়া হয়। আর বেসরকারি জগতের কর্মীদের?
এই দূষণকালে মালিকদের রাস্তায় ডেলিভারি করার অভিজ্ঞতা, শুনতে বেশ রোম্যান্টিক মনে হলেও কোনও সমাধান নয়। কোম্পানির মালিক এবং রাষ্ট্রের মালিকদের দায়িত্ব নিতে হবে। সস্তার শ্রম আছে বলেই ফুলে-ফেঁপে উঠছেন ডিজিটাল লেবার প্ল্যাটফর্ম-এর মালিকরা। অতএব এই মুনাফার বাঁটোয়ারা থাকা উচিত, ‘রিস্ক অ্যালাওয়েন্স’-এর আইনি পরিধি বাড়িয়ে সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিককে তার আওতায় আনা হতে পারে একটা পথ। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যবিমাও থাকা উচিত।
ভারতে শ্রম সস্তা এবং বেকারত্ব আরও সস্তা। পিএইচ ডি করেও গ্রুপ ডি-র চাকরিতে নাম লেখান মানুষ। সস্তা শ্রম আছে বলেই দূষণ থেকে বাঁচতে আমরা বাড়ি বসে ফোনের বোতাম টিপে পেয়ে যাই চারাগাছ, পোস্ট করি পরিবেশ বাঁচানোর, কিন্তু গণপরিবহণ ব্যবহার করি না, ‘কার পুলিং’-ও করি না। এ দেশের ধনকুবেরদের কথা বাদই দিলাম, উচ্চ অর্থনৈতিক সম্বলের মানুষ এক মুহূর্তও পরিবেশের কথা না ভেবে বিলাসী দিনযাপন করেন, আর তাতে বিপন্ন হন সেই সব মানুষ, যাঁদের নিজেদের সুরক্ষিত রাখার ক্ষমতা নেই। তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়তে পারে ব্রাজ়িলের শ্রমিক নেতা চিকো মেন্ডেস-এর কথা। তিনি বলেছিলেন, শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া পরিবেশ সংগ্রাম হল কেবল ‘গার্ডেনিং’ করার শামিল। না, খালি গাছ লাগালেই প্রাণ বাঁচবে না। প্রাকৃতিক সম্পদকে দেদার লুট করে আমাদের সম্পন্ন শ্রেণি সম্পন্নতর হওয়ার দৈনিক সাধনা করছে। এবং তার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। সেটা বদলানো দরকার।
এই সবে বাকু-তে বিশ্ব জলবায়ু ‘উৎসব’ শেষ হল। তার মধ্যে এ কথাটা এক বারও উঠে এল না যে, জলবায়ু পরিবর্তন বা দূষণবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ‘স্টেকহোল্ডার’ আসলে কায়িক শ্রমে বাঁচা মানুষ, যাঁরা খরা বা অতিবৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, পরিবেশ সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হন— অথচ এই সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে যেতে যাঁরা সবচেয়ে নাছোড়বান্দা। এঁদের কথা কে বলবে, কার আছে সেই দায়বোধ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy