রাশিয়ার বোমারু বিমান ইউক্রেনে হানা দেওয়ার ঠিক আগের দিনই ভারতে ফিরে এসেছিলেন রিয়া সাইনি। এমবিবিএস-এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী রিয়ার একটাই চিন্তা ছিল, অনলাইনে ক্লাস যেন চালু থাকে! প্রায় ৩৫-৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে বাবা-মা বিদেশে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছেন। কোর্স শেষে দেশে ডাক্তারি করতে হলে পরীক্ষায় বসতে হবে। তাতে পাশ করা বেশ কঠিন হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী তো বলেই দিয়েছেন, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনই ফেল করে। অতএব অনলাইনে হলেও পড়াশোনাটা চালু থাকা দরকার।
যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পরে যে সব এমবিবিএস পড়ুয়া ফেরত আসছেন, তাঁরা আর এ সব ভাবার সময় পাননি। ইউক্রেনে খারকিভে গোটা বিশেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সেখানেই রাশিয়া বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। গোটা শহর মাটির নীচে বাঙ্কারে। কোনও মতে প্রাণে বেঁচে ফেরাটাই এখন লক্ষ্য। সেই যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কোভিড অতিমারির সময় বলেছিলেন, ‘জান হ্যায় তো জহাঁ হ্যায়’! অনলাইন ক্লাস আপাতত মাথায় উঠেছে।
আপাতত। কিন্তু তার পর? ১৮ হাজারের বেশি পড়ুয়া ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়ছিলেন। তাঁদের উদ্ধার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না বলে বিরোধীদের নিশানা। নরেন্দ্র মোদী ছাতি ঠুকে বলেছেন, তিনি সবাইকে ফেরাবেন। কিন্তু তার পরে রিয়াদের পড়াশোনার কী হবে? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে কবে আবার পড়াশোনা চালু হবে? বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়া মোবাইল টাওয়ার ফের খাড়া করে কবে আবার অনলাইন ক্লাস চালু হবে? কবে পড়ুয়ারা ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবেন?
কেউ জানেন না। কারও এ সব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কারণ এ সব নিয়ে ভোটের বাজার গরম হয় না। কেন এত ছাত্রছাত্রীকে বিদেশে যেতে হয় ডাক্তারি পড়তে? কতগুলো নতুন মেডিক্যাল কলেজ খুলেছে গত সাত-আট বছরে? প্রহ্লাদ জোশী বলেই দিয়েছেন, ও সব নিয়ে বিতর্কের সময় এখন নয়। প্রধানমন্ত্রী ভোটের প্রচারে ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধারের বড়াই করেন। তাঁদের পড়াশোনার কী হবে, তা নিয়ে একটি কথাও বলেন না।
যুদ্ধ হোক বা অতিমারি, প্রথমেই পড়াশোনা লাটে ওঠে। কিন্তু এ দেশে রাজনীতির লড়াইয়ে সেই পড়াশোনার প্রসঙ্গই আসে না। ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কথা নাহয় ছেড়ে দিলাম। ফেসবুক-টুইটারে রাতদিন বোঝানো হচ্ছে, ওঁরা তো বড়লোকের সন্তান। এ দেশে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ না পেয়ে বিদেশে টাকার জোরে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছে। কিন্তু অতিমারির কোপে গত দু’বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ। গোটা বিশ্বে একমাত্র উগান্ডা ছাড়া আর কোনও দেশে এত দিন স্কুল বন্ধ থাকেনি। গত দু’বছরে নির্বাচন হল, জনসভা হল, কিন্তু স্কুলের পড়াশোনা কেন ঠিকমতো হল না, নেতা থেকে ভোটার কেউই কি সে কথা ভাবেন?
দেশের ১৫ লক্ষ স্কুলের ২৫ কোটি ছেলেমেয়ে দু’বছর স্কুলে যায়নি। অনলাইনে পড়াশোনা করেছে সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা। গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের অনেকের ইন্টারনেট বা স্মার্টফোন জোটেনি। জুটলেও পড়াশোনা হয়নি। এখন সবাই স্কুলে যাওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, মধ্যবিত্ত হোক বা গরিব, লেখাপড়া আদতে কিছুই হয়নি। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর মাত্র চার ভাগের এক ভাগ দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়তে শিখেছে। প্রথম শ্রেণিতে উঠে যাওয়া পড়ুয়াদের অনেকেই অঙ্কের ক্লাসে এক থেকে দশের বেশি কোনও সংখ্যা চেনেনি। এক মাস আগে সংসদে পেশ হওয়া মোদী সরকারের আর্থিক সমীক্ষাই বলছে, অতিমারি পর্বে স্কুলে ভর্তির হার কমছে। সাত থেকে দশ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
দেশের পাঁচটা রাজ্যের নির্বাচন চলছে। এই সব সমস্যা, শিক্ষা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে কোনও বিতর্ক শুনেছেন? বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ভোট চলছে। নেহরু থেকে জিন্না, অযোধ্যা থেকে মথুরা, পরিবারবাদী থেকে হিন্দুত্ববাদী, ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-যাদব-দলিত সব কিছু ভোটের বাজারে রয়েছে। নেই শুধু পড়াশোনার কথা। বলা হয়েছিল, স্কুল খোলার পরে পড়ুয়াদের পুরনো পড়াশোনা ঝালিয়ে নিতে একশো দিনের ‘ব্রিজ কোর্স’ করানো হবে। কিন্তু পাঠ্যক্রম না কমালে শিক্ষক-শিক্ষিকারা একশো দিনে পুরনো পড়া করিয়ে পাঠ্যক্রম শেষ করবেন কী ভাবে? তৃণমূল বা বিজেপি নেতারা এ সব নিয়ে মাথা ঘামান না। রাজনীতিতে এ সবে হাতে গরম ফল মেলে না।
মোদী সরকারের আমলে প্রথম পাঁচ বছরে তিন দফায় ১৫৭টি নতুন মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কলেজ তৈরি হলে অন্তত ১৫,৭০০ নতুন এমবিবিএস আসন যোগ হবে। খুব খারাপ ট্র্যাকরেকর্ড বলা যায় না। উত্তরপ্রদেশ বা অন্য চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি নেতাদের এ সব বলে ভোট চাইতে দেখেছেন? গত বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। মতুয়া থেকে মুসলিম তোষণ, সিবিআই-ইডি থেকে সিএএ-এনআরসি— তরজা চলেছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে যত বিতর্ক হয়েছিল, বিদ্যাঙ্গনের পড়াশোনা নিয়ে তত চুলোচুলি হয়েছে কি? স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হলে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়। তার পরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলে গিয়ে পড়ালেন, না কি শাসক দলের নেতার তোষামোদে ব্যস্ত থাকলেন, সে নিয়ে রাজনীতি কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায়ই নতুন ভারতের কথা বলেন। এখন তাঁর মুখে স্বাধীনতার ৭৫তম বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত ‘অমৃত কাল’-এর কথা শোনা যাচ্ছে। দেশে এখন ১০০ জন স্কুলের গণ্ডি পার হলে ৭০ থেকে ৭৫ জনই কলেজ বা অন্যত্র উচ্চশিক্ষার পথ মাড়ায় না। অমৃত কালে কি তাঁরা উচ্চশিক্ষার অমৃতের স্বাদ পাবেন? কেউ জানে না।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের কথা ভাবা যাক। বিজেপি তার ইস্তাহারে বলেছিল, পড়ুয়াদের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নতুন ব্যবস্থা চালু হবে। কিন্তু শিক্ষায় কত খরচ হবে, তার কোনও উল্লেখ ছিল না। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যাওয়ার সমান সুযোগ পায়। কংগ্রেস তার ইস্তাহারে বলেছিল, শিক্ষাকে সংবিধানের যৌথ তালিকা থেকে রাজ্যের অধিকারের তালিকায় যোগ করা হবে। কিন্তু সব রাজ্যে যে সমান মানের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির ক্ষমতা রয়েছে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? লোকসভা ভোটে পুলওয়ামা, বালাকোট নিয়ে জোর লড়াই হয়েছে। কারা আসল দেশপ্রেমী, তার ময়নাতদন্তে শিক্ষার প্রসঙ্গ শিকেয় উঠেছিল।
কর্নাটকের মুসকান খানের কথা মনে পড়ে যায়। মাণ্ড্য প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে কমার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মুসকান স্কুটি চালিয়ে কলেজে পৌঁছতেই তাঁকে ঘিরে ধরে গলায় গেরুয়া উত্তরীয় ঝোলানো ভিড়। ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি ওঠে। রামের জয়গান নয়। রামের জয়ধ্বনি তখন হিজাব পরিহিত মুসকানকে হেনস্থা করার হাতিয়ার। মুসকান পাল্টা ‘আল্লা হু আকবর’ বলে চেঁচিয়েছিলেন। একদল বলছে, কেন মুসকানরা হিজাব পরে স্কুলে আসবে? আর এক দলের প্রশ্ন, হিজাব পরার অধিকার কেন থাকবে না? বিজেপি থেকে আসাদুদ্দিন ওয়েইসি এ নিয়ে উত্তরপ্রদেশের ভোটে ফয়দা তোলার চেষ্টা করছে। কংগ্রেস কর্নাটকের ভোটে লাভের আশা দেখছে।
কেউ কি ভেবেছেন, মাণ্ড্যর ওই সরকারি কলেজে পড়াশোনা কেমন হয়? শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাসে পড়ান? গত দু’বছরে অনলাইনে ঠিকমতো ক্লাস হয়েছে? কত জন ছাত্রছাত্রী ওই কলেজ থেকে পাশ করে চাকরি পেয়ে থাকেন? এ নিয়ে নেতানেত্রীদের বাক্যুদ্ধ করতে শুনেছেন?
শুধু পড়াশোনা নিয়ে বিজেপি বনাম কংগ্রেসের কবে ভোটে লড়াই হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy