গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
চলতি সময়কে ভুল সিদ্ধান্ত এবং বেপথু চিন্তাভাবনার মরসুম বলা যেতেই পারে। এর মধ্যে সাম্প্রতিকতম হল ব্যক্তিগত কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং নোটবুক আমদানির লাইসেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত। এর আগেও বেশ কয়েক বার যে আমদানি লাইসেন্সের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সে সব তিন দশকেরও আগেকার কথা। বাণিজ্যনীতির সংশোধনী বা পুনর্বিন্যাস সাধারণত শুল্কবৃদ্ধির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। পাঁচ বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত শুল্কস্তরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শুল্কহ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এখন সরকার এক কদম এগিয়ে আবার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করতে চাইছে। এর লক্ষ্যগুলি অবান্তর নয়। নিরাপত্তা ও আমদানি সংক্রান্ত পরিবর্তের কথা মাথায় রেখেই এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এর আগেও বেশ কিছু এমন শুভ উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বিপাকে পড়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, শুল্কের মতো অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের যন্ত্রাংশকে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসন। এবং তা থেকেই জন্ম নেয় ‘লাইসেন্স-পারমিট রাজ’-এর ধারণা। এ বিষয়ে আর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হল, বাসমতী ব্যতিরেকে অন্যান্য সাদা চালের রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি। যদিও দেশে তার উদ্বৃত্ত যথেষ্ট এবং ‘বাফার স্টক’ (কোনও পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য যা মজুত রাখা হয়)-এও ঘাটতি নেই। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূলত মূল্যবৃদ্ধি রোধ এবং ঘাটতি রুখতেই এমন পদক্ষেপ করা হয়েছে। এখানে অর্থনৈতিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে যোগানের বৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে সরকারি গুদাম থেকে চাল সহজে বাইরে সরবরাহ হয়, সে দিকে নজর রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার বদলে যা ঘটেছে, তা প্রশাসনের তরফে রফতানি-নিষেধাজ্ঞা জারি। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের বিশ্বস্ত সরবরাহকারী হিসেবে ভারতের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অথচ বিশ্বের চালবাজারে এক সময় ভারতই ছিল সর্ববৃহৎ রফতানিকারক দেশ।
বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই হস্তক্ষেপ অহেতুক জটিল নিয়মের মধ্য দিয়ে ঘটে। ব্যবস্থা থেকে সুবিধা নিতে তৎপর হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং বিবাদ দেখা দেয়। নীতিগত ক্ষেত্রে আবহাওয়া বেশ তিক্ত আকার নেয়। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি নির্মাণ শিল্পে ‘ইনসেন্টিভ’ দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থা আপাতদৃষ্টিতে কিছু প্রতারণামূলক দাবি তুললে সরকার ইনসেন্টিভের হার ৪০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। যা থেকে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, প্রাথমিক অবস্থায় ৪০ শতাংশ ‘ইনসেন্টিভ’ কি প্রয়োজনাতিরিক্ত ছিল? যদি তার প্রয়োজন থাকতও, তবে এই শিল্পক্ষেত্রের অভ্যন্তরেই সে বিষয়ে অনুসন্ধানের অবকাশ কি ছিল না? ইনসেন্টিভের হার আকস্মিক ভাবে কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎচালিত দু’চাকার গাড়িগুলির দাম হঠাৎই বেড়ে যায় এবং অনিবার্য ভাবে তার বিক্রি কমে আসে।
সামঞ্জস্যবোধ এবং যৌক্তিক দিক থেকে দেখলে মাইক্রন-এর মতো সংস্থার তরফে প্রস্তাবিত গুজরাতে ‘চিপ অ্যাসেম্বলিং’ এবং টেস্টিং কারখানা (চিপ নির্মাণ কারখানার মতো মূল ব্যবসা নয়)-য় বিনিয়োগের বিষয়টিকে ভাবা যেতে পারে। সরকারি নীতি অনুযায়ী পুঁজিতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া যায়। কিন্তু গুজরাত সরকার তার উপরে আরও ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেবে বলে স্থির করে। সুতরাং প্রস্তাবিত বিনিয়োগের ২.৭৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের মধ্যে ২ বিলিয়ন ভারতীয় করদাতাদের গাঁটের কড়ি থেকেই দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। এখন প্রশ্ন, কোন যুক্তিতে এবং কোন হিসাব মোতাবেক সার্বিক ভাবে বিদেশি মালিকানাধীন এক উদ্যোগে এমন ভর্তুকি দেওয়াকে সমর্থন করা যায়? এ ক্ষেত্রে ঝুঁকির প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেও চলবে না।
কখনও কখনও আবার বাজারের প্রতিনিধিদের আলোচনায় বসার আগেই নীতি ঘোষিত হয়ে যায়। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক খরচাপাতির উপরে কর ঘোষণার বিষয়টি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে আগেই কর্মকাণ্ড ঘোষিত হয়েছে। ভাবনাচিন্তার অবকাশ ঘটেছে তার পরে। এই ধরনের কর (মনে রাখা দরকার, যতক্ষণ না পর্যন্ত কর প্রদানের বিষয়টি নথিবদ্ধ হচ্ছে, ততক্ষণ সেটিকে কর বলেই ধরা যায় না) আদায়ের ক্ষেত্রে বাস্তব অসুবিধাগুলি ব্যাঙ্ক এবং ক্রেডিট কার্ড সংস্থাগুলির সঙ্গে আগে থেকে আলোচনার মধ্যে গেলে সহজেই বোঝা যেত। এবং সেই মোতাবেক নীতি ঘোষণা করা যেত।
কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, কর চালু হওয়ার নির্ধারিত দিনটি একাধিক বার পাল্টানো হয়েছে এবং ঘোষিত নীতির বিষয়ে বার বার সংশোধনী আনতে হয়েছে। খরচের উদ্দেশ্য এবং পরিমাণের সাপেক্ষে তিন রকমের হার চালু করতে হয়েছে। এমন কাণ্ডকে প্রয়োগগত ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! এমন উদ্দেশ্যহীন ঘটনা সম্ভবত ভারতেই একমাত্র ঘটে থাকে!
১৯৯১ এবং তার পরবর্তী সময়ের বাজারমুখী সংস্কার সরকারের সঙ্গে কর্মরত অর্থনীতিবিদদের দ্বারা নির্ধারিত ও গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়। তাঁদের প্রভাবে এবং ইচ্ছায় নির্ধারিত বিশ্ববাজারে নিজেকে মেলে ধরার নীতির সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভরাডুবি ঘটে। কার্যত আমলারাই ব্যবস্থার বিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ান। দেশে মজুত মুদ্রার ৮৬ শতাংশ রাতারাতি বাতিল করার নীতিকে কোনও অনুভবশক্তি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নিশ্চিত ভাবে সমর্থন করবেন না। কোনও নীতি নির্ধারণ ও ঘোষণার আগে তাই অর্থনীতিকে প্রধান্য দেওয়া জরুরি এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা সেরে এগোনোই বাঞ্ছনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy