Advertisement
E-Paper

শিক্ষক, অতএব দরিদ্র

নেতাজি ইনডোরে মুখ্যমন্ত্রীর সভা এবং পর দিন পুলিশ দিয়ে শিক্ষকদের পেটানোয় তাই দুঃখিত হলেও হতবাক হইনি। এটি মহাভারতের শিক্ষা!

গুরু: কুরু রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন দ্রোণাচার্য। নন্দলাল বসুর ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস।

গুরু: কুরু রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন দ্রোণাচার্য। নন্দলাল বসুর ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:২৭
Share
Save

দরিদ্র, নুন আনতে পাম্তা ফুরোয় অথচ আপাদমস্তক নির্লোভ এবং সৎ। ‘যোগ্য’ শিক্ষকের গুণ এটিই। অন্তত, মহাকাব্য এবং পুরাণকথা আমাদের এ রকমই শিখিয়েছে। মহাভারত সাফ বলেছে, রাজা এবং শিক্ষাগুরু দু’জন সতীর্থ হলেও কেউ কারও বন্ধু নন। পাঞ্চাল দেশের রাজপুত্র দ্রুপদ এবং ভরদ্বাজ মুনির পুত্র দ্রোণাচার্য দু’জনই অগ্নিবেশ ঋষির আশ্রমে লেখাপড়া শেখেন, খুব বন্ধু। দ্রুপদ বন্ধুকে বললেন, আমি তো রাজা হব। ভবিষ্যতে দরকার পড়লে এসো, আমি দেখে নেব। দরিদ্র দ্রোণাচার্য এক দিন দায়ে পড়ে বন্ধুর রাজসভায় গেলেন। দায় কী রকম? তাঁর একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামা জীবনেও দুধ খায়নি, পিটুলিগোলা খেয়ে সে মহানন্দে ‘দুধ খেয়েছি’ বলে নাচানাচি করছে। দ্রুপদ কিন্তু পুরনো বন্ধুকে অপমান করে রক্ষীকে ডেকে বন্ধুকে বার করে দিলেন, “ধুস, রাজা আর দরিদ্র ব্রাহ্মণে বন্ধুত্ব হয় নাকি!” নেতাজি ইনডোরে মুখ্যমন্ত্রীর সভা এবং পর দিন পুলিশ দিয়ে শিক্ষকদের পেটানোয় তাই দুঃখিত হলেও হতবাক হইনি। এটি মহাভারতের শিক্ষা!

শিক্ষক কী করবেন? রাস্তায় রাস্তায় অনাহূতের মতো ঘুরে বেড়াবেন। হস্তিনাপুর প্রাসাদে বাচ্চা ছেলেরা কন্দুক বা বল খেলছিল। খেলতে খেলতে সেটি কুয়োয় পড়ে যায়। রাস্তা দিয়ে যাওয়া পক্বকেশ এক ব্রাহ্মণ ছেলেদের কান্নাকাটি শুনতে পেয়ে সেখানে এলেন। তার পর ‘হে বালকবৃন্দ, তোমাদের ক্ষাত্রবলে ধিক, তোমাদের অস্ত্রশিক্ষায়ও ধিক’ ইত্যাদি বলে নিজের আঙুলের আংটিটাও কুয়োয় ফেলে দিলেন। বললেন, “সবগুলিই তুলে আনব। দেখো না, এই কুশ ঘাস দিয়ে লম্বা তির বানাব, তার পর তোমাদের বল, আমার আংটি সব তুলে আনব।” কিন্তু তাঁর শর্ত একটাই, “এর পর আমাকে ভাল করে খেতে দিতে হবে।” বালকদের মধ্যে যুধিষ্ঠির বয়সে বড়। তিনি বললেন, “মহাশয়, আপনি যদি কূপ হইতে গুলিকা উদ্ধার করিতে পারেন, তাহা হইলে কৃপাচার্যের অনুমতিক্রমে চিরকাল ভিক্ষা পাইবেন।” অতঃপর বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একটার পর একটা তির কুয়োয় ছুড়লেন। প্রত্যেকটা তির আগেরটার লেজে গিয়ে বিঁধল, তৈরি হল তিরের লম্বা দড়ি। বল উঠে এল। কিন্তু কে এই মহাবল ধনুর্ধর? ব্রাহ্মণ আত্মপরিচয় দিলেন না, বললেন, “যাও, তোমাদের পিতামহ ভীষ্মকে গিয়ে আমার কথা বলো।”

এ বার কালীপ্রসন্নের ভাষায়, “মহাত্মা ভীষ্ম কুমারগণের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র বুঝিতে পারিলেন যে, দ্রোণাচার্য আগমন করিয়াছেন। ইতিপূর্বেই তিনি একজন সুশিক্ষকের হস্তে কুমারগণকে সমর্পণ করিবার মানস করিয়াছিলেন, এক্ষণে দ্রোণাচার্য স্বেচ্ছাক্রমে... আগমন করিয়াছেন শুনিয়া যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইলেন।” তাঁর এই সন্তুষ্টির ঢের আগে থেকে কৃপাচার্য কিন্তু কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা দেন। মানে, পিতামহ মনে করেন, কৃপ যোগ্য নন। দ্রোণাচার্যই রাজকুমারদের যোগ্য শিক্ষক। শিক্ষকেরা নন, অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রও নন, তাঁর পরামর্শদাতা, চিরকুমার পিতামহই শুধু জানেন, কে যোগ্য, কে অযোগ্য! যোগ্য-অযোগ্যের সাম্প্রতিক বাছাবাছি তাই মনে করাল মহাভারত নিয়ে সেই প্রবাদ, ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে’।

শিক্ষকের দুর্নীতি? সে-ও মহাভারতে প্রচুর। একলব্যের চেনা গল্প বলে পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনের ইচ্ছা নেই। বরং অন্য গল্প বলি। বারুণী অস্ত্রে অবিলম্বে জলপূর্ণ হবে, দ্রোণাচার্য এ রকম একটি সরু মুখের জলপূর্ণ কলসি ছাত্রদের সবাইকে দিলেন। ওই কলসিতে জল ভর্তি করে ভোরবেলায় তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু নিজের ছেলে অশ্বত্থামাকে দিলেন বিস্তীর্ণ মুখের একটি কলসি, তাতে আরও বেশি বাণ প্রয়োগ করা যাবে, ঝটিতি কলসি জলে ভর্তি হবে। সব ছাত্রকে সমদৃষ্টিতে দেখা উচিত, তা বলে নিজের ছেলেকেও?

কিন্তু যোগ্য ছাত্র এ সবের তোয়াক্কা করে না, শিক্ষকের বিরুদ্ধে অন্যদের খেপিয়ে আন্দোলনেও যায় না। অর্জুন নিজেও সেই কাকভোরে তাঁর কলসি জলপূর্ণ করে গুরুর কাছে আসতে লাগলেন। অতএব, অশ্বত্থামা অন্যদের থেকে বেশি কিছু শিখতে পারলেন না। অস্ত্রবিদ্যায় তিনি ও অর্জুন সমান পারঙ্গম হলেন। এ-হেন দ্রোণাচার্যের নামেই এ দেশের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া-প্রশিক্ষকের পুরস্কার। এখানেও কি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারতন্ত্রের সুবাসিত বাসমতী চালে একটু কাঁকর মিশে গেল না?

কিংবা রাজার খেয়ালে যাবতীয় তত্ত্বকথা ভাঙচুর করে নতুন নীতি? কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রবিদ্যা-পরীক্ষাকালে সেখানে আচমকা হাজির কর্ণ, তাঁকে দেখে দর্শকাসনে কুন্তী অজ্ঞান। সূতপুত্র দেবে ক্ষত্রিয় কুমারদের সঙ্গে অস্ত্রপরীক্ষা? পিতামহ ভীষ্ম বা রাজা ধৃতরাষ্ট্র নন, দুর্যোধন সঙ্গে সঙ্গে কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষেক করালেন, তাঁকে ক্ষত্রিয়ত্বে বরণ করে নিলেন। কে ক্ষত্রিয় আর কে নয়, সেটা রাজা নন, রাজার কুমারই নির্ধারণ করে দেবে।

অতএব রাজসভা জানে, গুরু আসলে রাজ-অন্নে প্রতিপালিত অন্নদাস। অতএব, দ্রোণ এবং কৃপাচার্য দু’জনেই একাধিক বার জেনেশুনে কৌরবপক্ষের হয়ে লড়বেন। প্রথমে বিরাট রাজার গোধন আহরণের সময়, দ্বিতীয় বার কুরুক্ষেত্রের মহারণে। এখানেই শিক্ষকের ট্র্যাজেডি।

মধ্যযুগে বাংলার মিথ অবশ্য এই রাজ-অন্নের ট্র্যাজেডি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। রাজার প্রতিনিধি এসে বুনো রামনাথের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে, তাঁর সংসারের চাহিদা কী! গৃহিণী উত্তর দেন, ঘরে চাল আছে, গাছে তেঁতুলপাতা। দিব্য চলে যায়, তাঁদের আর কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। ‘কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষ শাসন করি’ নৈয়ায়িক রঘুনাথ যতই বাংলায় মিথিলার নব্যন্যায় নিয়ে আসুন না কেন, তাঁকে টোল খুলেই সংসার প্রতিপালন করতে হবে।

আর ছাত্রদরদ ভুলে রাজাজ্ঞায় পচা-ধচা রাজতন্ত্রের ‘সিস্টেম’ টিকিয়ে রাখা? সেটাও গুরুর দায়। সুতপুত্র কর্ণ জামদগ্ন্য পরশুরামের আশ্রমে অস্ত্রশিক্ষা শেখেন, গুরু এক দিন ছাত্রের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। রক্তচোষা এক পোকা এসে কর্ণের হাঁটুতে কামড়াল, গুরুর ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে সেই যন্ত্রণা সহ্য করে রইলেন। গুরু পুরস্কার দিলেন, কিন্তু অন্য ভাবে, “এত সহ্যশক্তি ক্ষত্রিয় ছাড়া কারও হয় না। তুই নির্ঘাত ক্ষত্রিয়, নিজেকে সূতপুত্র বলে অস্ত্রশিক্ষা করতে এসেছিস। যা, সময়কালে একটাও অস্ত্র মনে পড়বে না, তোর রথচক্র মেদিনী গ্রাস করবে।” তার পর পরশুরাম পথে পথে ঘুরে বেড়াবেন, মিথিলা থেকে অযোধ্যা যাওয়ার সময় রাম-সীতার পথ আটকে বলবেন, “তুমিই সেই হরধনু ভাঙা ছোকরা? আমার ধনুকে গুণ পরাও তো বুঝব!” আরুণি তাঁর শিষ্য উদ্দালককে কখনও শুয়ে পড়ে বাঁধের জল আটকাতে বলবেন, কখনও বা উতঙ্ককে তাঁর গুরু যমরাজ্যে গিয়ে কবচ উদ্ধারের প্রচ্ছন্ন নির্দেশ দেবেন। গুরু দরিদ্র বলেই তো শিষ্যদের এই সব আল বাঁধা, গরু চরানো, কবচকুণ্ডল নিয়ে আসার নির্দেশ!

আর রাজা? তিনি ধনরত্ন, পারিতোষিক দেওয়ার নামে ব্রহ্মবিদ্যা দানকারী ব্রাহ্মণকে লেজে খেলাবেন। রাজর্ষি জনক ব্রাহ্মণদের একটা লাঠি দিয়ে বলবেন, যত দূর ছুড়তে পারবেন, সব গোধন আপনার। যাজ্ঞবল্ক্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে লাঠি ছুড়লেন, সেটি কয়েক মাইল দূরে গিয়ে পড়ল। অতএব ওই বিস্তীর্ণ এলাকার সবৎসা, দুগ্ধবতী গাভীদের আশ্রমে নিয়ে গেলেন তিনি। কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সরকারি চুরিবিদ্যায় চাল-কাঁকর মেশানোর পরেও এত মিথ কিসের? উত্তর একটাই। সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন, মিথ আমাদের উপর যে মূল্যবোধ আরোপ করে, সেটি বয়ে নিয়ে চলাই মিথের ঐতিহ্য। অতএব, দুর্নীতিপরায়ণ শাসক যদি বলে, শিক্ষকেরা আপাতত দু’তিন মাস বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছাশ্রম দিন, সেটি মিথেরই ঐতিহ্য। অন্য পেশায় দারিদ্র নিয়ে এ রকম মহাকাব্যিক মিথ নেই, ফলে কেরানিকুল থেকে আমলা কাউকেই ও রকম বিনা পারিশ্রমিকে দুই তিন মাস কাজ করার ফতোয়া দেওয়া যাবে না।

চাল আর কাঁকর মেশানো স্কুল সার্ভিস কমিশনের উদ্দেশে আর একটি গল্প। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপ এসেছেন অ্যারিস্টটলের কাছে, পুত্র আলেকজ়ান্ডারের গৃহশিক্ষক হিসাবে ওঁকেই চান। দার্শনিককে ‘ইমপ্রেস’ করার জন্য তিনি বললেন, “ও তো রাজপুত্র, একটু দেখেশুনে পড়াবেন।” অ্যারিস্টটল বললেন, “দূর মশাই! সবাইকে কষ্ট করতে হয়, শিক্ষার আলাদা কোনও রাজবর্ত্ম নেই।’

এখনকার কথা আলাদা। যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে একটাই রাজপথ। ভারতীয় মহাকাব্যই শিখিয়েছে, শিক্ষক দরিদ্র হবেন। বিনা পারিশ্রমিকে ক্লাসে পাঠ দেবেন, খাতা দেখবেন, প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন ও যথাসময়ে সিলেবাস শেষ করবেন। এখানে চালে-কাঁকরে বা জলে-দুধে মিশে গেলে রাজা-রানি বা পারিষদদের কিছু যায় আসে না। মিথের মূল্যবোধ কি না!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mahabharata Teachers Low Salary

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}