ছ’দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এসেছে। একশোটির বেশি দেশের নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেকটাই নির্ভর করেছে আমেরিকার অর্থ সাহায্যের উপরে। পরিবার পরিকল্পনা, এইচআইভি প্রতিরোধ, নবজাতক ও শিশুর স্বাস্থ্য, টিকাকরণের বিবিধ প্রকল্প চলত ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট বা ‘ইউএসএড’-এর মাধ্যমে। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প কোপ বসিয়েছেন ইউএসএড-এর কাজে। সংস্থার কয়েক হাজার কর্মীকে প্রথমে ছুটিতে পাঠিয়ে পরে ছাঁটাই করেছেন; আপাতত বহাল মাত্র ২৯০ জন কর্মী। ট্রাম্পের শপথগ্রহণের দিনই ইউএসএড-এর সঙ্গে সংযুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও কর্মীদের জানানো হয়, তারা কাজ বন্ধ রাখছে।
এই সিদ্ধান্তে বিপর্যস্ত হতে পারে আফ্রিকার মালি, নাইজার, দক্ষিণ সুদান, ইথিয়োপিয়ার মতো গরিব দেশগুলোর মহিলারা। ইউএসএড-এর সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের গর্ভনিরোধক মিলত এই দেশগুলিতে। একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, কেবল ২০ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কম-বেশি আটত্রিশ লক্ষ মহিলা গর্ভনিরোধে সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আফ্রিকার এই দেশগুলিতে পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবার প্রয়োজন অপরিসীম। নাইজারে মহিলারা এখনও গড়ে ছ’সাতটি সন্তানের জন্ম দেন। উপযুক্ত গর্ভনিরোধকের অভাবে জনসংখ্যা বাড়বে, দারিদ্রও। মেয়েদের উপরে হিংসার হারেও এই দেশগুলি বিশ্বের শীর্ষের দিকে। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, লেসোটোর মতো দেশগুলিতে যৌনরোগ পরীক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতির কেন্দ্রগুলিতে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, সুরক্ষিত গর্ভপাত, শিশুদের টিকাকরণ প্রভৃতি বন্ধ হওয়ার জন্য মৃত্যুহার বাড়তে চলেছে। যথাসময়ে অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল চিকিৎসা না হওয়ায় প্রসূতির থেকে সন্তানে এডস সংক্রমণের হারও বাড়ছে। এক অসরকারি সংস্থার হিসাব, অনুদান বন্ধের ফলে প্রতি দিন অন্তত ১৪০০ নবজাতক এডস নিয়ে জন্মাচ্ছে।
ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতেও ইউএসএড নানা সহায়তা দিত স্বাস্থ্য, দারিদ্র নিরসন, বিপর্যয় মোকাবিলা-সহ নানা খাতে। ২০২৩-২৪ সালে ভারত পেয়েছিল সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা। অনুদান ব্যাহত হওয়ায় নানা ধরনের পরিষেবা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনই কর্মহীন হয়েছেন বহু নারী-পুরুষ। বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের মতো দেশ আন্তর্জাতিক অনুদানের উপরে বেশি নির্ভরশীল হওয়ায়, তাদের উপর প্রভাবও পড়েছে বেশি। বাংলাদেশের উন্নয়ন ক্ষেত্রে অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন বলে অনুমান।
আমেরিকার জনগণের একাংশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে খুশি। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, এই অনুদান নিছক খয়রাতি নয়। ষাটের দশকে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার শীতল যুদ্ধ চলাকালীন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিজেদের শিবিরে রাখতে আমেরিকার অন্যতম কৌশল ছিল অনুদান। আমেরিকার আধিপত্য বৃদ্ধিতে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বিশ্ব জুড়ে অর্থ সাহায্য শুরু করেন। এই কর্মকাণ্ডের তদারকির জন্য ১৯৬১-তে ইউএসএড প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ নানা ধরনের প্রকল্প চালাত এই সংস্থা।
ট্রাম্পের বিরোধী শিবির ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, ইউএসএড-এর কাজ বন্ধ করা বেআইনি। ইউএসএড তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসের ‘ফরেন অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে। এটি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। ট্রাম্পের কলমের আঁচড়ে এটা থেমে যেতে পারে না। এর জন্য আদালত ও কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে ট্রাম্পকে। অন্য দিকে, ট্রাম্প চেষ্টা করছেন, ইউএসএড-এর ক্ষমতা খর্ব করে তাকে আমেরিকার বিদেশ নীতি-বিষয়ক ‘স্টেট ডিপার্টমেন্ট’-এর সঙ্গে জুড়ে দিতে।
হোয়াইট হাউস একটি তালিকা প্রকাশ করে দেখিয়েছে, ইউএসএড-এর অর্থ কী ভাবে অপব্যয় করা হয়। সেই তালিকায় রয়েছে সার্বিয়ায় এলজিবিটিকিউ-দের সহায়তা, ভিয়েতনামে বৈদ্যুতিক যান চালানোর জন্য খরচ, বা মিশরে পর্যটন শিল্পে ব্যয়। অথচ, ২০১৯-এ ট্রাম্পের সময়ই মিশরে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল উত্তর সিনাইতে জল, শিক্ষা, ও পরিবহণের সহায়তায়। যদি ধরা হয় ইউএসএড-এর বরাদ্দ অর্থের একটা অংশের অপব্যয় হচ্ছে, তার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, বহু মানুষের জীবন নির্ভর করছে এই সহায়তার উপর।
২০২৪ সালে আমেরিকার ফেডারাল বাজেটের মাত্র ০.৩% বরাদ্দ হয়েছিল ইউএসএড-এর জন্য। কাজেই সংস্থাটি তুলে দিলেও আমেরিকার সাশ্রয় নগণ্য। ফলে আমেরিকার মধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে, সহায়তা বন্ধ করে লাভ হচ্ছে, না কি ক্ষতি? অনেকেই বলছেন, এর ফলে আমেরিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্মান হারাবে, অসামরিক ক্ষেত্রে প্রভাব হারাবে, আন্তর্জাতিক নানা সঙ্কটের মোকাবিলায় নেতৃত্বের স্থান হারাবে। জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত দুর্যোগ কি দেশের সীমানা বোঝে? কিংবা সংক্রামক রোগের জীবাণু? শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার দ্বারা উন্নয়নের যে আদর্শ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব দেশ গ্রহণ করেছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল আমেরিকা, ইউএসএড-এর উপর খাঁড়ার ঘা আসলে সেই আদর্শের বিনাশের একটি প্রতীক।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)