Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

হ্যালো, আপনি পজ়িটিভ?

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সিদের টিকাদান ঘোষণা করেছেন।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:৫৭
Share: Save:

সহন মার্ডি করোনা পজ়িটিভ। জেলার কন্ট্রোল রুম থেকে তাঁর খবর নিতে ফোন করতে ধরল ছেলে হরফ। জানাল, বাবা জানেন পরীক্ষার ফল। কোথায় তিনি? চাষ করতে গিয়েছেন।

জেলা কোভিড কন্ট্রোল রুমের কথোপকথন এই রকমই হয়। এক গ্রামে তো চোদ্দো বছরের এক ছেলে, পড়াশোনা তৃতীয় শ্রেণি অবধি, গ্রামের গোটা বারো ঘরের ফোন ধরছে এক উঠোনে বসে। পেট চালাতে করোনা পজ়িটিভরা ফোন রেখে সবাই কাজে। সরকারি অফিসের ফোন এলে কী ভাবে কথা বলতে হবে, তা ওই কিশোরকে ভাল করে শিখিয়ে গিয়েছেন বড়রা। ফলে এক পাল্টা কন্ট্রোল রুম খুলে বসেছে যশোর বাস্কে। ফোনে বলল, এটাই ওর সমাজসেবা। কন্ট্রোল রুমের ফোন এত অজরবজর শোনার জন্য ব্যস্ত রাখা নিষেধ। তবু সময়ে সময়ে কিছু কথা যেন ফুরোতেই চায় না।

তার একটা কথা হরফ মার্ডি, যশোর বাস্কের মতো কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পনেরো থেকে সতেরো বছর বয়সিদের টিকাদান ঘোষণা করেছেন। স্কুলে স্কুলে ‍ভ্যাকসিন ক্যাম্প শুরু হল। শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র ধরে আনলেন নতুন আদেশে। কিন্তু যে শিশু-কিশোররা স্কুলছুট, শিশুশ্রমিক, তাদের কী হবে? ‍গ্যারাজে কাজ করা ছেলেপুলেগুলো তৃতীয় ঢেউয়েও নৌকা বাইতে পারবে তো? ষোলো-সতেরোতেই একটু ভাল থাকতে পালিয়ে ঘরবাঁধা গার্লস স্কুলের মেয়েটি টিকা পাবে কী করে? স্কুলের উঁচু ক্লাস থেকে ড্রপআউট-এর সংখ্যা চিরকালই উদ্বেগজনক, অতিমারিতে তা কতটা বেড়েছে, তার আন্দাজও মিলেছে নানা সমীক্ষায়। ভয় হয়, স্কুল থেকে বাদ পড়া এই ছেলেমেয়েরা টিকা উৎসবেও হয়তো ব্রাত্য থেকে যাবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা তৈরির ঘোষণার মতো, সরকার হয়তো আবার টিকাপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের এক অলীক তালিকা তৈরি করে বসে থাকবে। ফোনে বাজবে সাফল্যের রিংটোন, কিন্তু সংখ্যার ভূত পিছু ছাড়বে না।

দিলরুবা বিবির মতো মানুষরা করোনা পজ়িটিভ, সাত দিন নিভৃতবাসে থাকতে হবে, এ সব সরকারি নির্দেশ শুনে দিলরুবা বিবির জবাব, “অসুবিধা কী? জ্বর নাই, সর্দি নাই, কাশি নাই। ধান গাড়বার আইসি। ও সব রিপোর্ট মানি না।” দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মৃত্যুভয়ও মরে যায়। গম্ভীর প্রশাসনিক নির্দেশ অর্থহীন লাগে। সরকারি কর্মীর দিনমজুরকে নিয়ম পালনের ব্রতকথা শোনাতে দ্বিধা হয়। উল্টে গ্রামের মানুষের থেকে শুনতে হয়, এই রোগ নাকি শহুরে বাবুদের রোগ। “তাজপুর, পার্ক স্ট্রিট, সান্দাকফু বেড়াতে আমরা যাইনি। পেটে ভাত নেই, আবার তুষারপাত! সব মিছা কথা।” শুনে কথা হারায় বড়বাবুর। অফিস ভরদুপুরেও নির্জন। তবু দায়িত্বপালনের নম্বর ডায়াল হয়ে চলে।

দুই বছরের কড়া অনুশাসনও যখন নিরাপদ পরিবেশ ফেরাতে পারেনি, তখন নাগরিকের ভরসা কোথায়? করোনা পরীক্ষার সরকারি নথিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন অনেকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বলছেন, “টেস্ট করব না, যান থানায় ডায়েরি করুন।” কেউ পরীক্ষা করে ফোনের ভুল নম্বর দিয়ে হাঁপ ছেড়ে একটু বাঁচতে চেয়েছেন। কেউ বা নিয়মে থেকেও আক্রান্ত হওয়ার জন্য হাহুতাশ করেছেন। এ ভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নিয়মবিধির প্রচার, পুলিশের কড়াকড়ির পাশাপাশি একটা বয়ান তৈরি হয়ে চলেছে। সরকার বা গণমাধ্যম তাকে মান্যতা দেবে না, কিন্তু জনজীবনের কতখানি প্রভাবিত হচ্ছে সেই বিকল্প বয়ানে, তার আন্দাজ পাওয়া সহজ নয়। কন্ট্রোল রুমে বসা কর্মীরা তার আভাস পান, কিছু করতে পারে না। সে দিন ছিয়ানব্বই বছরের বৃদ্ধ কাতর গলায় “বাঁচব তো?” বলে ফোন রেখে দিয়েছেন হঠাৎ।

কর্মীরা নীরবে শোনেন আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মায়ের কথা। ফোনের ও-পারে হাসপাতালের এক পজ়িটিভ মহিলা ‍ল্যাবকর্মী জানালেন দুর্দশার কথামালা। ব্রুফেন আর ‍প্যারাসিটামল সঙ্গে নিয়ে তিন রাত দু’বছরের শিশুর চড়া জ্বরের সঙ্গে লড়ছেন। শিশুটি পজ়িটিভ। বললেন, “মা হয়ে দুটো টিকা নিয়ে অপরাধী লাগছে জানেন?”

শিশুদের কাছে টিকার কোনও অঙ্গীকার রাখতে পারেনি দেশ। ফলে দেশের কত শিশু নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে, আপাতত শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। তাদের সবার করোনা পরীক্ষাও হয়তো হয়নি, করায়নি ভীতসন্ত্রস্ত পরিবার। তাই কোভিডের শিকার শিশুদের সংখ্যা কোনও দিনই হয়তো জানা যাবে না।

যা লেখা নেই সার্ভিস রুলে, তার সামনাসামনি ফেলে দেয় ভাগীরথী বর্মনের ফোন নম্বর। ট্রলিতে নিথর মায়ের শরীর ছুঁয়ে থেকে ছেলে ফোন ধরেছে। সরকারি বিধির নির্দেশাবলি থতমত খেয়ে তখন চার দেওয়ালের অফিসঘরে ঘুরতে থাকে। বড়বাবু ভাগীরথী দেবীর নামটা এক টানে কেটে দিলে পরের নম্বর ডায়াল করেন। “আপনি পজ়িটিভ। ক’টা ডোজ় নিয়েছেন?” উত্তর আসে না।

বেলাশেষে নীরবতা ঘুরে বেড়ায় কন্ট্রোল রুমে।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus COVID Positive
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy