অকালমৃত্যু তো বটেই। বয়স হয়েছিল মাত্র ৬২। কিন্তু, পল ফার্মারের (ছবিতে) মৃত্যু হয়তো আসতে পারত আরও আট বছর আগে, ২০১৪ সালে, লাইবেরিয়াতে ইবোলা মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে। সে সময় পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া, গিনি ও সিয়েরা লিয়নে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে। জীববাহিত এই সংক্রমণে শুধু যে রোগীর মৃত্যুর হার ভয়ানক বেশি তা-ই নয়, এতে চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীদের মৃত্যুর হারও এত বেশি যে, একে ‘কেয়ার গিভারস’ ডিজ়িজ়’ও বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু পল ফার্মারের তো না গেলেই নয়। যেমন জাপানি আক্রমণের সময় চিনের পীড়িত মানুষের সেবার জন্য জীবন বাজি রাখতে পিছপা হননি নর্মান বেথুন বা দ্বারকানাথ কোটনিস। দেশ বা জাতি নয়, তাঁদের ডাক দিয়েছিল বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। ২০১৪-র বসন্তে তাই পলের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল— শনিবার আফ্রিকা থেকে ফেরা, রোববার ক্লাসের প্রস্তুতি, সোমবার হার্ভার্ডে পড়ানো, এবং সে দিনই সন্ধ্যায় লাইবেরিয়ার প্লেন ধরা।
পল ছিলেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করা ডাক্তার। আবার মেডিক্যাল অ্যানথ্রপলজিতে পিএইচ ডি। গবেষণার কাজে গিয়ে থাকতে হয় হাইতিতে। আর বদলে যায় তাঁর জীবন। সেখানকার কানগে গ্রামে গিয়ে দেখলেন, কী ভাবে উন্নয়নের নামে নদীতে বাঁধ বেঁধে গোটা গ্রামটাকে ডুবিয়ে দেওয়া হল। সে গ্রামের মেয়ে অ্যাসিফিকে যেতে হল শহরে কাজের তাগিদে; মালিক ও মিলিটারির উগ্র যৌনলালসার পথ ধরে তাঁর দেহে বাসা বাঁধল এইচআইভি। ফার্মারের গবেষণা যতখানি চালিত হত মাথা দিয়ে, ততখানিই হৃদয় দিয়ে। এখানে হৃদয় তাঁর মস্তিষ্ককে নির্দেশ দিল, অ্যাসিফির কাহিনি থেকে হাইতির সামাজিক-আর্থনীতিক ইতিহাস, তার বর্তমান রাজনীতি, এবং তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের অনুসন্ধান করতে।
সেই খোঁজ থেকে তিনি তুলে আনলেন স্বাস্থ্যের সামাজিক সম্পর্কগুলোকে— গড়ে তুললেন স্বাস্থ্যের জৈব-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। স্বাস্থ্য মানে কেবল ওষুধ বা চিকিৎসা নয়, জীবাণু বা ভাইরাসের আক্রমণ নয়, স্বাস্থ্য হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত নরওয়েজিয়ান সমাজতাত্ত্বিক জোহান গ্যালটাং-এর সমাজ-কাঠামোগত হিংসা (স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স) ধারণার সাহায্য নিয়ে পল খুঁজে দেখতে লাগলেন, “কারা বাঁচে, কারা মারা যায়!” শুধুমাত্র আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, বা সোভিয়েট ভেঙে তৈরি হওয়া দেশগুলোতেই নয়, আমেরিকাতেও লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছেন রোগে, বিনা চিকিৎসায়, অপচিকিৎসায়। পল দেখলেন, কী ভাবে অনাহার, অশিক্ষা, দারিদ্র ও স্বাস্থ্য-পরিষেবার অভাবের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে মানুষের স্বাস্থ্য; আবার এ-ও দেখলেন, কী ভাবে অস্বাস্থ্যের কারণগুলোকে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আফ্রিকার স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করার পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শোষণে দেশগুলোকে যুগ-পরম্পরায় হতাশ্বাস রেখে দেওয়া হল, যার পরিণতি রোগের নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ ও অকালমৃত্যু।
অথচ, এর জন্য দায়ী করা হতে লাগল চাপিয়ে দেওয়া অসহায়তা বয়ে বেড়ানো মানুষগুলোকেই। বলা হল, অসংযমী জীবনযাপন তাঁদের রোগের মূলে। দোষারোপের খেলার সঙ্গে উন্নত বিশ্ব যোগ করল আর এক তত্ত্ব— এই সব রোগের চিকিৎসা ব্যয়-সাশ্রয়ী নয়। বলল, আফ্রিকা বা হাইতিতে এইচআইভি আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না, কারণ তাতে প্রচুর খরচ। এর বিরুদ্ধে পল ও তাঁর সহযোগীরা বললেন, উন্নত বিশ্ব তাদের শোষণের ভিতর দিয়ে রোগটা দেবে, ওষুধ দেবে না, এটা হতে পারে না। পলের বাস্তব গবেষণা দেখাল, কী ভাবে ‘রোগ নিরাময়ের চেয়ে ভাল হল রোগ প্রতিরোধ’— এই আপ্তবাক্যের আড়ালে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ প্রতিজ্ঞা বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করা হচ্ছে নির্বাচিত গুটিকয় ক্ষেত্রকে, অধুনা যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্বাস্থ্য বিমার মতো ঘোর অস্বাস্থ্যের কর্মসূচি।
পল এবং তাঁর বন্ধুরা দেখলেন, কেবল গবেষণা বা হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে বা অ্যানথ্রপলজি বিভাগে পড়ানো বা বিখ্যাত ব্রিঘহ্যাম অ্যান্ড উইমেন’স হসপিটাল-এ কাজ করা নয় (যদিও সে-কাজে তিনি ছিলেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ— হার্ভার্ডে অমর্ত্য সেন-সহ গোনাগুনতি যে ক’জন ‘ইউনিভার্সিটি প্রফেসর’ পদে বৃত, তিনি তাঁদের এক জন), বিশ্বজোড়া এই ভয়ানক অনাচার দূর করতে গেলে হাতেকলমে নিজেদেরও কাজ করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে তিনি ১৯৮৭ সালে বন্ধু ওফেলিয়া ডাল ও জিম ইয়ং কিম-এর সঙ্গে মিলে গড়ে তুললেন ‘পার্টনার্স ইন হেলথ’ সংগঠন। হাইতিতে সামান্য সঙ্গতি নিয়ে শুরু একটি হাসপাতাল থেকে সেই সংগঠন আজ বিশ্বের নানা দেশে কাজ করে চলেছে। পল বিশ্বাস করতেন, সরকারি ব্যবস্থা ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা অসম্ভব। তাই আজ তাঁর দিশায় পরিচালিত বারো হাজারের বেশি কর্মী যে বিভিন্ন দেশে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকে স্থানীয় সরকারি ব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলার কাজে নিবেদিত। গত ২১ ফেব্রুয়ারি পল মারা গেলেন রুয়ান্ডার বুতারোতে রুয়ান্ডা পার্টনার্স ইন হেলথ ও রুয়ান্ডা সরকারের গড়ে তোলা একটি স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালে। পল সেখানে পড়াতে গিয়েছিলেন।
দেশে দেশে স্বাস্থ্য উদ্যোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে যেমন তাঁর ফাঁকি ছিল না, তেমনই বিন্দুমাত্র আপস করতেন না গবেষণা ও পড়ানোর কাজে। এত বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যেও লিখেছেন এক ডজন বই ও প্রায় দু’শো অতি উচ্চমানের গবেষণা প্রবন্ধ। প্যাথলজিস অব পাওয়ার বা ফিভার, ফিউডস অ্যান্ড ডায়মন্ড— তাঁর বইগুলিতে পল ছোট কোনও কাহিনি থেকে পাঠককে নিয়ে যান, কী ভাবে লুট হয় হিরে ও অন্যান্য খনিজ, কী ভাবে উন্নয়নের নামে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রজন্মবাহী দারিদ্র, এবং মারণ রোগ, তার বিবরণ ও বিশ্লেষণে। আর সেই সঙ্গে দেখান, কী ভাবে ‘বাছাই কিছু বড়লোক ও শোষক নয়, সব মানুষের বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে’, এই দার্শনিক স্বীকৃতিটি থেকে আসলে মানব সমাজই পৌঁছে যেতে পারে
অন্য উচ্চতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy