অনুসরণ: দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালির পথে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, ও তাঁর সহযোগীরা। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে রেণুকা রায়ের সঙ্গে গাঁধীজির সাক্ষাৎ। “এক সাক্ষাৎকারেই আমার জীবন পরিবর্তিত হয়ে গেল।” ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশন এমনই এক ঘটনা, যা অনেক বাঙালি মেয়ের জীবনে ঢেউ তুলেছিল। তার আঘাতে অনেকেই অন্দরমহলের বাঁধা ছকের জীবন থেকে বেরিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন, যোগ দেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে। গাঁধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পথ হয়তো অনেক বাঙালি মেয়েই গ্রহণ করেননি, কিন্তু অনেক বাঙালি মেয়ের ঘর থেকে বাইরে আসার পথটুকু মসৃণ করেছিলেন গাঁধী। এর পর তাঁরা নিজেদের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন! এঁদের কয়েক জনের আত্মকথায় এই সব কাহিনি পাই আমরা। এই আত্মকথাগুলি বাংলার নারী-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বের দলিল। এক দিকে তখন পরাধীন দেশের শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া চলছে, আবার একই সঙ্গে বাঙালি সমাজে ও লিঙ্গ সম্পর্কের বিন্যাসের বিবর্তন ঘটছে। গাঁধীর ‘ম্যাজিক’ কাজ করছে দুই ক্ষেত্রেই।
গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে রেণুকা ও তাঁর বন্ধু ললিতা ডায়োসেশন কলেজ ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে গাঁধীকে দেখতে গেলেন দুই কন্যা। কিন্তু সামনাসামনি গাঁধীকে দেখে বাক্রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ফলে পরে দীর্ঘ চিঠি লিখে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগের আকুতি জানালেন। সে চিঠির উত্তর ওঁদের স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবের জমিতে আছড়ে ফেলল। আপাতত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ও প্রাত্যহিক কিছু নিয়ম মেনে চলার বিধান দিলেন গাঁধী। রেণুকা পরে লিখেছেন যে, অল্প বয়সে দেশের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁরা গাঁধীর সঙ্গে দেখা করেন ঠিকই, কিন্তু দেশসেবার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে তখনও কোনও পরিষ্কার ধারণা তাঁর ছিল না। গাঁধীকে দেখার পর মনে হয়েছিল যে, গাঁধীর দেখানো পথকে অনুসরণ করাই হবে প্রকৃত দেশসেবা। রেণুকার মতে, গাঁধীজির ক্ষমতা ছিল যে কোনও নারী বা পুরুষকে সেই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া, যে ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁদের নিজেদেরই কোনও ধারণা ছিল না।
গাঁধীর নির্দেশে টিলক স্বরাজ তহবিলের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থসংগ্রহ করা ছিল তাঁদের দায়িত্ব। কলকাতার অনেক বাড়িতেই পুরুষ অভিভাবককে ডিঙিয়ে অন্দরমহলে মেয়েদের কাছে পৌঁছনো কঠিন ছিল। অনেক সময় বাড়ির মেয়েরা বাড়ির পাশের গলি দিয়ে এসে অনুরোধ জানান, বাড়ির পুরুষদের অবর্তমানে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে এলে তাঁরা সাহায্য করতে পারবেন। হাতে নগদ অর্থ না থাকায় অনেকেই তাঁদের গয়না তুলে দেন তহবিলে। কংগ্রেসের অধিবেশনের পরে গাঁধীজি মহিলাদের একটি জনসভায় আবেদন করেন যে, তাঁরা যেন টিলক স্বরাজ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করেন। কলকাতার বহু পর্দানশিন মেয়ে, যাঁরা জীবনে এই প্রথম কোনও জনসভায় অংশগ্রহণ করছেন, তাঁরা গায়ের গয়না খুলে গাঁধীজির পায়ের কাছে জমা দিলেন, আর গয়নার একটি স্তূপ তৈরি হল। কলকাতার পর এ ধরনের জনসভা গাঁধী সারা ভারতেই করেছেন, এবং পর্দা সরিয়ে মেয়েরা সেখানে যোগ দিয়েছেন। একটি নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গিয়েছে সারা ভারতবর্ষব্যাপী।
সাবরমতী আশ্রমে কিছু দিন কাটানোয় রেণুকার গাঁধীকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়। আশ্রমের কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের মধ্যেও তিনি আনন্দ খুঁজে পান। অভিভাবকরা তাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে রেণুকা প্রতিবাদ করেন; গাঁধীজিই তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে, মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভবিষ্যতে রেণুকা দেশসেবায় মন দিতে পারবেন।
দেশে ফিরে এসেও রেণুকা গাঁধী-নির্দেশিত পথেই দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একই সঙ্গে সমাজে মেয়েদের সমান অধিকারের লড়াই চালিয়ে যান। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন (এআইডব্লিউসি)-এর মনোনীত সদস্য হিসাবে হিন্দু মেয়েদের আইনি অধিকারের জন্য গঠিত রাও কমিটির সুপারিশ যখন কেন্দ্রীয় আইনসভায় আলোচিত হচ্ছে, তখন হিন্দু কোড বিলের পক্ষে রেণুকা সওয়াল করেন। এই কাজে নিজের দলের পুরুষ সদস্যদের কাছ থেকেও বাধা পান তিনি। নোয়াখালির দাঙ্গার সময় গাঁধীজি রেণুকাকে দায়িত্ব দেন এআইডব্লিউসি ও অন্যান্য সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সদস্যদের একত্র করে নোয়াখালির বিভিন্ন গ্রামে ত্রাণের কাজ করতে।
ও দিকে, ফুলরেণু গুহ মাত্র পনেরো বছর বয়সেই যুগান্তর দলের সদস্য হন। বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর পরিবার তাঁকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাবার বন্ধু মহম্মদ আলির পরামর্শে ফুলরেণুকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দেশে ফিরে পরবর্তী কালে তাঁর কংগ্রেসে যোগদান বিষয়ে লিখলেন, “যে সাম্যবাদ আমার মনকে আকর্ষণ করেছে, সেই সাম্যবাদের লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় যদি গান্ধিজীর জীবনদর্শন সততার সঙ্গে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করা যায়।” নোয়াখালিতে
ছুটে যাওয়া মেয়েটির মনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বৈষম্যের কথা বললেই ভেসে উঠত গাঁধীজির কথা, যিনি বলতেন, মানুষের চিরন্তন অধিকার সত্যে, প্রেমে ও ত্যাগে।
গাঁধীজির আহ্বানে নোয়াখালির দুর্গতদের মধ্যে কাজ করলেও ফুলরেণু গাঁধীজির ক্যাম্পে কখনও কাজ করেননি। তিনি লিখছেন, “আমি জানতাম গান্ধিজির মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের ডাকে কর্মীর অভাব হবে না, কিন্তু আমি যে সব ছোটখাট কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলাম তাদের সক্রিয় কর্মীর একান্ত প্রয়োজন ছিল, হয়তো বা অভাবও ছিল।” আজীবন গাঁধীবাদী ফুলরেণু এআইডব্লিউসি-র বিভিন্ন পদ, সমাজকল্যাণ বোর্ডের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত থেকে শিশু ও মহিলাদের অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করেছেন। স্বাধীন ভারতে ফুলরেণু মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বীকারোক্তি: “আমি মনে করি, যখন আমি মন্ত্রী ছিলাম সে সময়ের চাইতে যখন সমাজকল্যাণ বোর্ডের সভানেত্রী ছিলাম তখন মানুষদের জন্য অনেক বেশি কাজ করতে পেরেছি।” মেয়েরা আত্মনির্ভর হয়ে উঠুক, এ ছিল তাঁর একান্ত কামনা। সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য দূর করে ছেলেমেয়েকে সমান সুযোগ ও সমদৃষ্টি দিয়ে মানুষ করলেই মেয়েদের মনে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে বলে তিনি মনে করতেন।
এমন আর এক জন হলেন জ্যোতির্ময়ী দেবীর কন্যা, আইসিএস শৈবালকুমার গুপ্তের স্ত্রী গৃহবধূ অশোকা গুপ্ত। ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি বাইরের পৃথিবীতে পা বাড়ালেন ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময়। ইতিমধ্যেই তিনি এআইডব্লিউসি-তে যোগদান করেছেন, এবং কস্তুরবার মৃত্যুর পর তাঁর সদ্যোজাত কন্যার নাম রেখেছেন কস্তুরী। অশোকার আত্মকথা দীর্ঘ নয় দশকের ইতিহাস— যে সময়ে এক দিকে যেমন এক নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে লিঙ্গ সম্পর্কগুলিরও পরিবর্তন ঘটছে।
গাঁধীজির নোয়াখালি আসার খবরে অশোকা চাঁদপুরে গিয়ে পৌঁছলেন। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে নেলী সেনগুপ্তের নেতৃত্বে একটি দল গঠিত হয়েছে এবং অশোকা নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে গিয়ে অপহৃতা মেয়েদের অনুসন্ধান করছেন। চাঁদপুর স্টেশনে গিয়ে জানলেন যে, ৭ নভেম্বর গাঁধীজি স্পেশাল স্টিমারে পৌঁছে গিয়েছেন, কিন্তু স্টিমার ঘাটে ভিড়বে না, মাঝ নদীতেই থাকবে। গাঁধীজির সঙ্গে তিনি ট্রেনে চেপে বসলেন। পথে প্রতি স্টেশন লোকে লোকারণ্য, সবাই এক বার গাঁধীজিকে দেখতে চায়। গাঁধীজি সুচেতা কৃপালনী, রেণুকা রায় ও অন্য মহিলা কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রকৃত অবস্থা জানা ও অপহৃতা মেয়েদের অনুসন্ধান করাই ছিল কর্মীদের প্রধান কাজ। অশোকার পরিচয় হল গাঁধীজির দুনিয়ার সঙ্গে।
গাঁধীজি চাইছিলেন যে, কর্মীরা যেন গ্রামে থেকে কাজ করেন, তা হলে গ্রামবাসীর বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা সহজ হবে। অশোকা এই কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে চাইলেন, কিন্তু শিশুকন্যাকে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকায় থাকার ব্যাপারে দ্বিধায় পড়লেন তিনি। গাঁধীজি সমাধান করে দিলেন: শিশু মা-র সঙ্গেই থাকবে। বড় দু’টি ছেলেমেয়েকে তাদের বাবার কাছে রেখে অশোকা শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ সাত মাস নোয়াখালির দাঙ্গাবিধ্বস্ত গ্রামগুলির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পরিবেশে ঘুরে ঘুরে পুনর্বাসনের কাজ করলেন। গাঁধীজির মত ও পথের প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস তাঁর মনের জোর বাড়িয়ে দিল।
রেণুকা, ফুলরেণু, অশোকার প্রজন্মের মেয়েরা কিন্তু জনপরিসরে অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। গাঁধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই মেয়েরা মধ্যবিত্ত লিঙ্গ মানসিকতার ঘেরাটোপ থেকে বার হয়ে লক্ষ্মণরেখা পার হতে পারেন, বহির্জগৎ তাঁদের খুঁজে পায়। কিশোরী রেণুকা, গৃহবধূ অশোকা বা একদা বিপ্লবী পথে অনুরক্ত ফুলরেণু, কত বিচিত্র পথ থেকে এসে মেয়েরা গাঁধীর অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে আকৃষ্ট হলেন। গাঁধীবাদী আন্দোলনে যুক্ত থেকে বঞ্চিত, দুর্গতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের আত্মনির্ভর করার চেষ্টাকেও জীবনের লক্ষ্য করলেন। আর তাঁদের হাত ধরে অনেকখানি পাল্টে গেল বাঙালি মেয়েদের চিত্তভুবন।
ইতিহাস বিভাগ, বিদ্যাসাগর কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy