Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

কলম এখন ক্ষমতার বন্দুকের নিশানায়, কলমকে নরেন্দ্র মোদীর কেন এত ভয়?

নকশালপন্থীদের সমালোচনা হয়েছে কলমের বদলে বন্দুককে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে। আজ সেই কলম ক্ষমতার বন্দুকের নিশানায়।

যে কলমকে তরবারির থেকে শক্তিশালী মনে করা হয়, সেই কলম যেন সরকারের অবাধ্যতা না করে।

যে কলমকে তরবারির থেকে শক্তিশালী মনে করা হয়, সেই কলম যেন সরকারের অবাধ্যতা না করে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২২ ০৮:২৪
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের আধুনিক ভারতের কল্পনায় ছিল, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়— ব্যক্তিজীবনে এই তিন প্রবৃত্তিকেই পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কিন্ত এখন সমাজ বা রাষ্ট্র, যে দিকেই তাকাই, মনে হয় আমরা ভয়ের রাজত্বে বাস করছি। ভয় এবং ঘৃণার জাল যেন আষ্টেপৃষ্ঠে চারদিক থেকে আমাদের বেঁধে রেখেছে। অদৃশ্য জুজুর ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের যেমন এক কালে চুপ করানোর চেষ্টা করা হত, এখন পুরো সমাজকেই তেমন এক গভীর ভয়ের ঘেরাটোপে আবদ্ধ রেখে শাসন পরিচালনার কাজ চলছে। কয়েকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা যাক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এন সাইবাবার কথা একটু গুগ্‌ল করলেই জানা যায়। ছোটবেলা থেকে পোলিও রোগে আক্রান্ত এই অধ্যাপক এখন শারীরিক ভাবে প্রায় ৯০ শতাংশ অকেজো। হুইলচেয়ার ছাড়া নড়াচড়া করার উপায় নেই। ‘মাওবাদী ষড়যন্ত্রকারী’ আখ্যা দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে তাঁকে মহারাষ্ট্রের জেলে পুরে রাখা হয়েছে বিগত কয়েক বছর। সম্প্রতি বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে মুক্তি দিলেও পর দিন সকালেই মহারাষ্ট্র সরকারের আর্জিতে তাঁর মুক্তি আটকে দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেন, সাইবাবার মস্তিষ্ক এখনও ক্রিয়াশীল এবং মস্তিষ্ক মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক অঙ্গ।

প্রসঙ্গত, জেলে বসে সাইবাবার লেখা কবিতা ও চিঠিপত্রের এক সংকলন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তার শিরোনাম ‘হোয়াই ডু ইউ ফিয়ার মাই ওয়ে সো মাচ’ (আমার পথকে তোমরা কেন এত ভয় পাও)?

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং ইতিহাসের গবেষক উমর খালিদ।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং ইতিহাসের গবেষক উমর খালিদ। ফাইল চিত্র।

সাইবাবার মতোই ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন)-তে গত দু’বছর ধরে জেলে আটক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং ইতিহাসের গবেষক উমর খালিদ। আড়াই বছর আগে দিল্লির সাম্প্রদায়িক গণহত্যার পরে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন বিরোধী আন্দোলনের বেশ কয়েক জন কর্মীকে মিথ্যা মামলায় ইউএপিএ-তে আটক করা হয়েছিল। উমর তাঁদেরই এক জন। উমরের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি বললেন, উমর এক জন বিপজ্জনক ব্যক্তি। কারণ, তাঁর ভাষণে ‘ইনকিলাবি সালাম’ ও ‘ক্রান্তিকারী ইস্তকবাল’ (বৈপ্লবিক অভিনন্দন)-এর মতো ‘বিপজ্জনক শব্দ’ ব্যবহৃত হয়। প্রসঙ্গত, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে উঠে-আসা অন্যতম জনপ্রিয় স্লোগান। বিজয়া দশমীর দিন দিল্লির সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাজেন্দ্রপাল গৌতমের উপস্থিতিতে কয়েক হাজার দলিত অম্বেডকরের ঐতিহাসিক ‘বাইশ প্রতিজ্ঞা’ পুনরুচ্চারণ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, মৃত্যুর দু’মাস আগে ১৯৫৬ সালের এই তিথিতেই নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে কয়েক লক্ষ অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে বাবাসাহেব অম্বেডকর জাতিপ্রথাকে অস্বীকার করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। সংবিধান সভার সভাপতি, স্বাধীন ভারতের প্রথম বিধি ও ন্যায়মন্ত্রী ১৯৫৬ সালে প্রকাশ্যে দৈব আরাধনা ও জাতিপ্রথাকে অস্বীকার করে সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকার অনুযায়ী ধর্ম পরিবর্তনের যে ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেছিলেন, ছেষট্টি বছর পর সেই পথে চলতে গিয়েই দিল্লি সরকারের মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা ছাড়তে হল। এখন ধর্ম পরিবর্তন মানে নাকি হিন্দুধর্মের বিপন্নতা! দেশদ্রোহ!

মস্তিষ্ক ও কলমের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালীর রণহুঙ্কার গণতন্ত্র বিসর্জনের পূর্বাভাস।

মস্তিষ্ক ও কলমের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালীর রণহুঙ্কার গণতন্ত্র বিসর্জনের পূর্বাভাস। ছবি: সংগৃহীত।

এই ভয়ের শাসনের আরও এক প্রতিধ্বনি শোনা গেল কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের ‘চিন্তন শিবিরে’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্যে। বিভিন্ন আন্দোলন দমন করার জন্য আন্দোলনবিরোধী কুৎসা অভিযান এই সরকারের শাসন পরিচালনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানবাধিকার আন্দোলনের অনেক কর্মী ও লেখককে ‘আরবান নকশাল’ (শহুরে নকশাল) বলে চিহ্নিত করে জেলে পুরে দেওয়া হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের দেগে দেওয়া হয়েছে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ হিসেবে। কৃষকদের লড়াকু মেজাজ ও আন্দোলনের ব্যাপক গণচরিত্রে বিচলিত প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সংসদে আন্দোলনকারীদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কটাক্ষ করতে শুনেছি। এ বার নতুন শব্দচয়ন শোনা গেল ‘কলমধারী নকশাল’। সংবিধান ও পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলাটাও এখন ‘নকশালপন্থা’। উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখ মেধা পটেকর এখন প্রধানমন্ত্রীর ভোটের ভাষণে ‘শহুরে নকশাল’।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে সাধারণত কোনও বিরোধী দল বা সরকারের প্রশংসা শোনা যায় না। যেন তেন প্রকারেণ বিরোধী শিবিরের সরকারকে চলতে না-দেওয়া বা ফেলে দেওয়া, মোটা টাকার বিনিময়ে বিরোধী বিধায়কদের কিনে নেওয়া, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই কামান দাগা— এটাই মোদী সরকারের পরিচিত শৈলী। কিন্ত ‘কলমধারী নকশালপন্থা’কে নির্মূল করার আহ্বান জানানোর আগে প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়েছেন সমস্ত সরকারকে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান— যে ভাবে সমস্ত সরকার একযোগে বন্দুকধারীদের পরাজিত করেছে, এখন সে ভাবেই কলমধারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চলুক। একই সঙ্গে গোটা দেশে পুলিশবাহিনীর জন্য একই পোশাক চালু করার প্রস্তাবও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে সাধারণত কোনও বিরোধী দল বা সরকারের প্রশংসা শোনা যায় না।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে সাধারণত কোনও বিরোধী দল বা সরকারের প্রশংসা শোনা যায় না। ফাইল চিত্র।

ইঙ্গিতবাহী এই ভাষণের ইশারা বুঝতে চাইলে বোঝা কঠিন নয়। যে কলমকে তরবারির থেকে শক্তিশালী মনে করা হয়, সেই কলম যেন সরকারের অবাধ্যতা না করে। আর গোটা দেশে পুলিশের এক পোশাকের প্রস্তাব হল আর এক সঙ্কেত। পুলিশ বিভাগ এবং বিধি-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রাজ্যের হাত থেকে কেন্দ্রের হাতে চলে আসুক। যে ভাবে সিবিআই-ইডি-এনআইএ এবং দিল্লি পুলিশকে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবহার করে, সে ভাবেই আগামী দিনে গোটা দেশের পুলিশবাহিনী পরিচালিত হোক।

আদালত যখন মস্তিষ্ককে বিপজ্জনক অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করছে, তখনই কলমের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বিষোদ্গার করছেন। সরকার, সংসদ, আদালত এবং সংবাদমাধ্যম— সংসদীয় গণতন্ত্রের এই চার স্তম্ভ যখন একই সুরে কথা বলে, তখন বুঝতে অসুবিধা নেই যে, রাষ্ট্র আর নাগরিকের মধ্যে কথোপকথনের সময় শেষ হয়ে আসছে। অধিকারসম্পন্ন নাগরিক নয়, সরকারের চোখে ভারতীয় জনগণ এখন নিছক আজ্ঞাবাহী প্রজা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, অধিকারের কথা অনেক হয়েছে। এখন কর্তব্যপালনের যুগ। কখনও নোটবন্দি, কখনও লকডাউন, যখন যেমন একুশে আইনের আদেশ হবে, চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে সেই আদেশ পালন করাই হল কর্তব্যপরায়ণ প্রজার দেশপ্রেমের পরীক্ষা।

জনতার ভাগে আদেশ ও কর্তব্যপালন। ক্ষমতাশালীর হাতে দেশ। তাঁদের হাতে দেশপ্রেম, জাতি, জাতীয়তাবাদের পরিভাষা ঠিক করা ও জনগণের প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত অধিকার। স্বাধীনতা ও সংবিধানের এই ব্যাখ্যা ও পরিণতির কথা স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে বা স্বাধীন ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক অনুশীলনে হয়তো কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্ত এখন আমরা সেই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি। মস্তিষ্ক ও কলমের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালীর রণহুঙ্কার গণতন্ত্র বিসর্জনের পূর্বাভাস। প্রশ্ন নকশালপন্থার অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ ঘিরে নয়, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের গণতন্ত্র এবং সেই গণতন্ত্রে নাগরিকের স্বাধীনতা ও অধিকার। অতীতে নকশালপন্থীদের সমালোচনা হয়েছে কলমের বদলে বন্দুককে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে। এখন সেই কলমই ক্ষমতার বন্দুকের নিশানায়।

কলমকে কেন এত ভয়? হিন্দি ও ভোজপুরী সাহিত্যে নকশালপন্থী ধারার প্রখ্যাত কবি গোরখ পাণ্ডের ১৯৭৯ সালে লেখা একটি ছোট কবিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বিহারের কৃষক আন্দোলনের উপর তীব্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পটভূমিতে গোরখ লিখেছিলেন: ‘ওয়ে ডরতে হ্যাঁয়/ কিস চিজ সে ডরতে হ্যাঁয় ওয়ে/ তমাম ধন-দওলত গোলা-বারুদ পুলিস-ফৌজ কে বাওজুদ/ ওয়ে ডরতে হ্যাঁয় কি এক দিন/ নিহত্থে অওর গরিব লোগ উনসে ডরনা বন্‌ধ কর দেঙ্গে… (ওরা ভয় পায়/ কিসের এত ভয় / এত ধন-দৌলত বন্দুক-তোপ সেনা-পুলিশ থাকা সত্ত্বেও / ওরা ভয় পায় যে এক দিন / নিরস্ত্র গরিব মানুষ ওদের আর ভয় পাবে না)।

অসির বিরুদ্ধে মসির লড়াইয়ে মসি জয়যুক্ত হোক। ক্ষমতার চোখ রাঙানিতে কলম কখনও ভয় পায়নি, পাবে না!

(লেখক সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক। মতামত নিজস্ব।)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Maoist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy